1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বাঙালির মুক্তির সূচনা ভাষা আন্দোলন

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
বাঙালির মুক্তির সূচনা ভাষা আন্দোলন

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। এই আন্দোলনকে নিছক বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াই মনে করলে সবটা বলা হবে না। এর পরিপ্রেক্ষিত ছিল ব্যাপক। ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ মানুষের জীবনচলার সবকিছুর সঙ্গেই আছে তার নিবিড় সংযোগ। সেই ভাষার ওপর আঘাত এলে সকল শ্রেণীর মানুষই আক্রান্ত বোধ করেন। এর প্রতিবাদে তাই শ্রেণী নির্বিশেষে সকলেই সাড়া দেন। আর সে কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অসামান্য। এর শিকড় প্রোথিত ছিল ওই সময়ের সমাজ ও অর্থনীতিতে। ১৯৪৮ সালের শুরু থেকেই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব-বাংলার উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দিলেও তাঁর সাথে গভীর সংযোগ ছিল এদেশের কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্ত সহ সাধারণ মানুষের।

তাই তো একুশে ফেব্রুয়ারির গণ-বিস্ফোরণের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার দাবিতে ছিল না, সেটা ছিল আমাদের জীবন-মরণের লড়াই। আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। আমরা খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয় চাই, নাগরিক অধিকার চাই। আমরা কথা বলার অধিকার চাই, শোষণমুক্ত সমাজ চাই।’ (‘সিক্রেট ডকুমেন্টস’, প্রতিবেদন নং ৪৭, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩)। মূলত ভাষা আন্দোলনই সকল শ্রেণির বাঙালিকে তাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা পূরণের সংগ্রামে এক করতে প্রধান সহায়কের ভূমিকা রেখেছিল।

পাকিস্তানি রাষ্ট্রটি ছিল আমলা-মিলিটারি-ব্যবসায়ী ধনীক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে। অভিজন শ্রেণীর প্রভাবে এই রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনচলাকে মসৃণ না করে বরং সমাজে বৈষম্যের বীজ বপন করে চলছিল। এমন পরিপ্রেক্ষিতেই সূচিত হয় ভাষা আন্দোলন। তাই এই আন্দোলন মূলত ছাত্ররা শুরু করলেও এর ব্যাপ্তি ছিল পুরো সমাজ জুড়েই। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি তার জাতি-সত্ত্বার পরিচয় খুঁজে পায়। তারা অনুভব করে বাঙালিরা একই ভাষাভাষী স্বতন্ত্র একটি জাতি। এই অঞ্চলে আগেও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কৃষক-জনতার বিক্ষিপ্ত আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মতো জাতীয় সামাজিক আদর্শ ভাষা আন্দোলানের আগে এমন করে বের হয়ে আসেনি। ঔপনিবেশিক আমলে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছে অসম ভাবে। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শোষণের অবসান হলেও তাদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকেই যায়। পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এলাকাসমূহের ওপর উন্নত এলাকাসমূহের আঞ্চলিক আধিপত্য আরও বেশি করে লক্ষ্য করা যায়। এ যেন এক নয়া-ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা জেঁকে বসলো। এই নয়া-আঞ্চলিক আধিপত্য অনুন্নত অঞ্চলের বঞ্চিত সকল শ্রেণীর মনেই জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়কে উসকে দেয়।তাদের ঐক্যবদ্ধ করে। ভাষার ওপর আক্রমণ আসায় এই জাতীয় ঐক্য আরও জোরদার হয়। সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকেই বাংলার উদ্বৃত্ত ইংল্যান্ডে চালান হয়ে যায়। বাংলার উৎপাদক শ্রেণীর টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যায়। অথচ সেদিনের পশ্চিম পাকিস্তানে কোম্পানির শাসন কায়েম হয় ১৮৪৮ সালে।

কোলকাতা-কেন্দ্রিক পাটশিল্পের পশ্চাৎভূমি ছিল পূর্ব-বাংলা। কলকাতা-কেন্দ্রিক আর্থ-সামাজিক বিকাশেও পূর্ব-বাংলার কৃষক শ্রেণী (মূলত মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দু) উপেক্ষিতই থেকে যায়। তবে কৃষক সন্তানেরাও খানিকটা শিক্ষার সুযোগ পেয়ে বাড়তি শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগের প্রত্যাশা করে। কিন্তু সে সুযোগ না পেয়ে আঞ্চলিক চেতনার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ইংরেজ সরকার এই আঞ্চলিক চেতনার সুযোগ নিয়ে কোলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বাংলা ভাষা-ভাষী অঞ্চলের প্রধান অংশ পূর্ব-বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এক পর্যায়ে বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। অন্যদিকে পূর্ব-বাংলাকে যুক্ত করা হয় আসামের সাথে। ঢাকাকে করা হয় নতুন প্রদেশের রাজধানী। চট্টগ্রাম বিকল্প রাজধানী। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে এটা করা হয়। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে আঞ্চলিক চেতনা আরও জোরদার হয়। তদ্দিনে বোম্বাই-ভিত্তিক পুঁজিপতিদের নেতৃত্বে বিদেশি পণ্য বর্জনের আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করেছে। এই সময়টায় কোলকাতা-ভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) বোম্বাই-ভিত্তিক শিল্প-পুঁজিপতিশ্রেণীর সমন্বয় ঘটে।

মূলত: পূর্ব-বাংলার কাঁচামাল ও বাজার হারানোর আশঙ্কায় গড়ে ওঠে সারা-ভারতব্যাপী বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। এখানে বোম্বাই ভিত্তিক পুঁজিপতি শ্রেণী বিদেশি পণ্য বর্জনের আবরনে অসহযোগ আন্দোলনের নামে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসে। ফলে কোলকাতা-ভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একচ্ছত্র নেতৃত্ব আংশিক ভাবে ক্ষুন্ন হয়। অন্যদিকে পূর্ব-বাংলার কৃষক-শ্রমিক ও উঠতি মধ্যবিত্ত এ আন্দোলনকে দৃঢ় ভাবে সমর্থন করতে পারেনি। কেননা, পূর্ব-বাংলা আলাদা প্রদেশ হওয়ায় ঢাকা-কেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের বাড়তি কিছু লাভ হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার ছাড়াও প্রশাসন, আদালত ঢাকা ও চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক হওয়ায় তাদের সমৃদ্ধি লাভের সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। তদুপরি বিদেশি পণ্য বর্জনের কারণে বিদেশি সুতো আমদানি ব্যাহত হয়। পূর্ব-বাংলার তাঁত শিল্প ক্ষতির মুখে পড়ে। তা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষের মনে। কিন্তু পূর্ব-বাংলার জণগনের বিকাশের এই প্রত্যাশা বেশি দিন স্থায়ী হয় না।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। ইংরেজদের ওপর পূর্ব-বাংলার মুসলিম তথা বাঙালি মুসলিম সমাজের আস্থার অবনতি ঘটে। তারাও ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে নেতৃত্ব দেবার জন্য নবাবদের পরিবর্তে উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী এগিয়ে আসতে শুরু করে। এক পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম যৌথ আন্দোলন স্বদেশী ও খেলাফত আন্দোলনের সমন্বয় ঘটে। বৃহৎ শিল্পপতিদের স্বার্থে জোরাদারে নেতৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থেই গান্ধী এ আন্দোলনের সমাপ্তি টানেন। আর কিছু ধর্মীয় রক্ষণশীল ধারণার সংযোজন ঘটালে ভারতবর্ষের যৌথ জাতীয় আন্দোলনে ফাটল ধরে। হিন্দু-মুসলমান আলাদা আলাদা পথের সন্ধান করতে শুরু করে। এভাবেই পাকিস্তান ধারণার জন্ম হয়।

ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমদের নেতৃত্বেই পূর্ব বাংলার সামন্তবাদ-বিরোধী কৃষক শ্রেণী পাকিস্তান আন্দোলনে ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করে। শেখ মুজিব তখন তরুণ নেতা। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে রাজনীতি করছিলেন। সিলেট গণভোটের সময় তাদের সক্রিয় ভূমিকার কথা অনস্বীকার্য। তাদের প্রত্যাশা ছিল পূর্বাঞ্চলে এমন পাকিস্তান হবে যেখানে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটবে, কৃষক-সন্তানদের শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বাড়বে। এই প্রত্যাশায় বাংলা ফের বিভক্ত হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে অস্বাভাবিক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তৈরি হলো তাঁকে মধ্যবিত্ত কৃষক সন্তানদের কাছে ‘ভ্রান্ত প্রত্যুষ’ বলেই আবির্ভূত হলো। পূর্ব-বাংলার সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আশা করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকেরা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশি মনোযোগী হবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো উল্টোটা। রাজধানী চলে গেল পশ্চিম পাকিস্তানে। ব্যবসা-বাণিজ্য, দপ্তর, আদালত ঐ অঞ্চলকে ঘিরেই গড়ে ওঠে। শিল্পায়ন, আমদানি, বিদেশী সাহায্য-সবকিছুই কেন্দ্রিভূত হতে থাকে পশ্চিমাংশে। কিন্তু রপ্তানির সিংহভাগ (পাট) আসে পূর্ব-বাংলা থেকে। আর সেই রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। চাকরি-বাকরি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব কিছুতেই বৈষম্য। শেখ মুজিবের সরব বিরোধিতা সত্ত্বেও জমিদারি প্রথা ক্ষতিপূরণসহ উচ্ছেদ হবার ফলে জোতদাররা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। বিদেশি সাহায্য নির্ভর উন্নয়নের সুবিধে পায় পশ্চিম পাকিস্তান। ছিটে ফোটা সুবিধে পায় পূর্ব-বাংলার মধ্যসত্ত্বভোগীরা। নতুন উন্নয়ন কৌশলে সম্পদের সমাবেশ করা হয় ভেতর ও বাইরে থেকে। কৃষি দেয় ভেতরের সম্পদ। আর শর্ত সাপেক্ষ বিদেশি সাহায্য দেয় বাইরের সম্পদ। রপ্তানি ক্ষেত্রে দেশি, অপ্রচলিত পণ্যের বাজার সংকোচিত হতে থাকে। পূর্ব বাংলা শুধু আমদানি-বিকল্প শিল্পের কাঁচামাল যোগান দিত। পূর্ব বাংলার কৃষকদের কাছে তাই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসনে ঔপনিবেশিক শাসনেরই আরেক রূপ বলে মনে হতো।

পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পায়নের ‘বন্দী বাজারে’ই পরিণত হলো পূর্ব বাংলা। এর জন্য প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মুসলিম লীগের সমর্থক তরুণ কর্মীরা। তারা তখন দারুণ হতাশ। তাই পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের বিরোধীতা শুরু করে এই তরুণ কর্মীরা। এদের বেশির ভাগই ছিল কৃষক সন্তান। কেউ কেউ আবার এক-প্রজন্মের শহরবাসী। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মনিরপেক্ষ। আধুনিক। অনেকেই অস্পষ্ট-ভাবে হলেও বামঘেঁষা। তারাই আওয়ামী মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মীদল হিসেবে বেড়ে ওঠে। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব। কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেই, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীরা এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের কৃষকদের আকাক্সক্ষার প্রতি সংবেদনশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদী এক সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বাংলা ভাষার ওপর আঘাত এলে এরাই তীব্রভাবে প্রত্যাঘাত হানে। ভাষা-প্রশ্নটি ছিল সামনের প্রসঙ্গ। পেছনে ছিল আঞ্চলিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তীব্র আকাক্সক্ষা। তাই এ বিদ্রোহ ছিল অনিবার্য। পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর ভাওতাবাজীর প্রধান শিকার কৃষক-শ্রমিকরাই তৈরি করেছিল ভাষা আন্দোলনের নির্মাণ-রসদ। তাই বিকাশমান মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঐ আন্দোলন দ্রুতই জাতীয় রূপ নেয়।

এই আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীগণ প্রায় সবাই এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতো শ্রেণী অবস্থান থেকে। তাদের চাওয়া পাওয়াও ছিল প্রায় একই রকম। ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণী থেকেই বের হয়ে এসেছিল উনসত্তর এবং একাত্তরের জাতীয়তাবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব। ১৯৪৮-৫২ পর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে শুভ সূচনা হয় তারই সফল উত্তরণ ঘটে একাত্তরে। ঔপনিবেশিক ও তার সহযোগী শ্রেণীর বিরুদ্ধে অধঃস্তন শ্রেণী সমূহের (তথা পেটিবুর্জোয়া, ধনী ও মাঝারি ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, কৃষক) এক অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল বলেই এই উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল। তাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথাও প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেন। এ সময়টায় তাঁর নেতা জনাব সোহরাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে সারা পূর্ব বাংলা সফর করেন এবং জনসভা করেন। তাঁর বক্তৃতায় গরিব চাষীদের ভাগ্যোন্নয়ন ছাড়াও পাট ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষানীতির ব্যাপক সমালোচনা করেন। জনগণের দুঃখ বঞ্চনার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে বলে তিনি বারে বারে দাবি করেন। তিনি তাঁর ভাষণে প্রশাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার কথা বলেন। কর কাঠামোতে গরিবের স্বার্থ যে বিঘ্নিত হচ্ছিল সে কথাও তুলে ধরেন। খাদ্য সংকটে সরকারের উদাসীনতারও তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। আর বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের কথা তো সর্বক্ষণই বলতেন। এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে গণমানুষের পছন্দের নেতায় পরিণত হন। বাঙালির মুখপাত্র হয়ে ওঠেন।

এর পর পরই আসে চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচন। ঐ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং তার নির্বাচনী ইশতেহার একুশ দফা প্রণয়নেও শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ওই একুশ দফাতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ছাড়াও পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির উপায়ের নানা কর্মসূচি যুক্ত করতে ভূমিকা রাখেন তিনি। এসব দাবির মূলেই ছিল পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মাঝে বিরাজমান বৈষম্য কি করে দূর করা যায়। এসব দাবি জনমনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যার ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ বিপুল ভাবে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ভোট দেন। চুয়ান্নের নির্বাচনে বিজয়ের পর মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য শেখ মুজিব কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী হয়েছিলেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি এ অঞ্চলের শ্রমিক, কৃষক তথা সাধারণ মানুষের কল্যাণে সমবায়ের বিকাশসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে এই সরকার বেশিদিন টিকতে পারে নি। সরকারের পতনের পরপরই তাঁকে আটক করা হয়। এরপর জেল থেকে বের হয়ে তিনি সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদাসহ গরিব-দুঃখী মানুষের পক্ষে সর্বক্ষণ সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৬ সালে আবার তিনি আতাউর খানের মন্ত্রিসভায় শিল্প, বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময়টায় তিনি পূর্ব বাংলায় শিল্প ও ব্যবসায়ে কেন উদ্যোক্তা শ্রেণী গড়ে উঠতে পারেনি সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র পূর্ব-বাংলাকে তাদের ‘কলোনি’ হিসেবে ব্যবহার করতো বলে এখানে খুব বেশি শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে নি। যাও বা গড়ে উঠেছে সেগুলোর মালিকানাও ছিল অবাঙালি উদ্যোক্তাদের হাতে। কাঁচামাল আমদানির লাইসেন্স দিতো রাজধানী করাচি থেকে। দুই অঞ্চলের মাঝে শ্রম ও পুঁজির সহজ লেনদেন সম্ভব ছিল না। পাটের রপ্তানি থেকে আয় করা বিদেশি মুদ্রা খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে। পূর্ব বাংলায় বিদ্যুত উৎপাদন হতো খুবই সামান্য। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য বাঙালি উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশের পক্ষে বেশ কিছু সহায়ক নীতি তিনি গ্রহণ করেন।

দুই অঞ্চলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের কথা বলতে তিনি ছিলেন সদাই সোচ্চার। আর তাই সামরিক শাসন জারি করার পর সবার আগে তাঁকেই গ্রেফতার করা হয়। দুই বছরেরও বেশি সময় দুর্বিসহ জেল জীবন শেষে তিনি ফের ‘দুই অর্থনীতির’ বিপদ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তদ্দিনে জনাব সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয়েছে। এরপর তিনি আওয়ামী লীগকে তাঁর মতো করে ঢেলে সাজান। আর বৈষম্যের অর্থনীতির অবসানকল্পে ছয়-দফা ঘোষণা করেন। এই ছয়-দফা ছিল বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিসনদ। এই ছয়-দফার পক্ষে জনরায় নিতেই তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নেন এবং বিপুলভাবে বিজয়ী হন। এই বিজয় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে পারে নি। আর তাই তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন।স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির’ অভিযাত্রার সূচনা করেন। মাত্র ন’মাসে জাতিকে উপহার দেন অধিকার-ভিত্তিক উন্নয়নের জন্য একটি চমৎকার সংবিধান। চালু করেন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। আর ধ্বংসস্তূপ থেকে সমৃদ্ধির অভিযাত্রায় পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এগোতে থাকেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে এই ‘দিঘল পুরুষ’কে বিশ্বাসঘাতকের দল হত্যা করে। সাময়িকভাবে হলেও থমকে দাঁড়ায় ভাষা আন্দোলনের পাটাতনে দাঁড়ানো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। দেশ চলতে থাকে উল্টো পথে। অনেক সমগ্রামের পর ফের দেশ ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে। এই নবযাত্রা অক্ষুণ্ন থাক সেই কামনাই করছি।

লেখক : ড. আতিউর রহমান – বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ অধ্যাপক।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ