তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তখন স্বৈরাচার আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহূরুল হককে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও স্বৈরাচারবিরোধী তুমুল আন্দোলনে শরিক হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ছাত্রধর্মঘট, পুলিশ বিনা উস্কানিতে এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জ করে, আহত ১৩ জন রাবি ছাত্রকে রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশের একটি ছোট ভ্যানে গাদাগাদি করে ফেলে রেখে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় গ্রেপ্তার দেখিয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রোক্টর, রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা ছিলেন তখন এ বিপদগ্রস্ত ছাত্রদের সাথে। সে সময় ক্যাম্পাসে চলছিল একুশের অনুষ্ঠান যা প্রতিবাদ সভায় পরিণত হয়। ড. জোহা এই প্রতিবাদ সভায় বলেছিলেন, “সিরাজদ্দৌলাকে অন্ধকূপ হত্যার মিথ্যা দুর্নাম দেয়া হয়েছিল। আজ অন্ধকূপ দেখে এসেছি। ছোট্ট একটা গাড়িতে বার চৌদ্দজন রক্তাক্তদেহী ছাত্রকে ঠাসাঠাসি করে তোলা হয়েছিল। আমার ছাত্রদের রক্তের দাগ আমার গায়েও লেগেছে, সেজন্য আমি গর্বিত।”
১৮ ফেব্রুয়ারি, বেলা ১১ টা।
রাজপথে ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলের মুখোমুখি পাক আর্মির একটি ইউনিট। প্রোক্টরের পক্ষ থেকে ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফেরানোর আশ্বাস দেয়া হলেও তা কর্ণপাত না করে পাক আর্মি গুলিবর্ষণ শুরু করলে প্রোক্টর ড. জোহা চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন, “ডোন্ট ফায়ার! ডোন্ট ফায়ার! আমি বলছি কোন গুলি বর্ষণ হবে না। কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।” তাই হলো, উর্দুভাষী ক্যাপ্টেন হাদী নিজের পিস্তল বের করে আচমকা গুলি করে দিলো প্রোক্টর ড. শামসুজ্জোহার বুকে, সেই সাথে নির্মম বেয়নেট চার্জ! ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি।
এমন শিক্ষক আজ কোথায়? স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল ড. জোহাদের মত নীতিনিষ্ঠ শিক্ষকদের। আজ এঁদের মতো মানুষের বড় অভাব। চারিদিকে কেবল ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা আর ভোগ সর্বস্বতার প্রতিযোগিতা। তাই জোহাদের মত মানুষ, শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না। পুঁজিবাদী দুনিয়ার শ্লোগান, “PAY FIRST, ITS MY LIFE.” এ সমাজকে টিকিয়ে রাখতে মেরে দিতে হয় মানবিকতা, মুছে ফেলতে হয় মনুষ্যত্বকে। বিত্ত-বৈভবের তাড়নায় মানুষ কেবল ছুটছে। ফলে ড. জোহার মতো মূল্যবোধের মানুষ নেই। সেই চরিত্র নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর কেউ নেই। কবি নজরুল যেমন বলেছিলেন, “সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়, নেই কি রে কেউ সত্য সাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?”
যেখানেই থাকেন, শান্তিতে থাকবেন প্রিয় শামসুজ্জোহা স্যার। আমরা আপনাকে ভুলি নাই, ভুলবো না। আপনি আছেন সারা বাংলার প্রতিটি বিপ্লবী ছাত্রের হৃদয়ে।
লেখক : হামজা রহমান অন্তর – কলামিস্ট, ছাত্রনেতা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক