1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা

ড. মিল্টন বিশ্বাস : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ৭ মার্চ, ২০২২

ড. মিল্টন বিশ্বাস

১৯৭১ সালের মার্চ মাস বিষয়ক নথির একটি পৃষ্ঠায় ৭ মার্চ ভাষণ সম্পর্কে কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহকারী জোসেফ সিসকো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, “সব ইঙ্গিত স্পষ্ট করেছে যে ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন এবং সম্ভবত সেটা হবে স্বাধীনতার সমতুল্য প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সামগ্রিক ইতিহাসের পটভূমিতে ৭ মার্চের ভাষণে উল্লিখিত স্বাধীনতার তাৎপর্য অনেক আগেই জাতির পিতার কণ্ঠে একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে। ১৪ খণ্ডের সিক্রেট ডকুমেন্টেসের প্রকাশিত ১০টি খণ্ডের
মধ্যে সপ্তম থেকে (১৯৬২-৬৩) দশম খণ্ডের (১৯৬৬) বিবরণসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় একাধিক জায়গায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কথা বলেছেন (বিশেষত দশম খণ্ডে বর্ণিত দেশব্যাপী ৬ দফার সমাবেশ সভাগুলোতে বক্তৃতা দেয়ার সময় তার কণ্ঠে সরাসরি স্বাধীনতার কথাই শোনা গিয়েছে। তবে ১৯৭১ সালের মার্চের পটভূমি ছিল পুরোটাই আলাদা। আর সে কারণেই ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে।

আমাদের এই বহুধা বিভক্ত সমাজ- রাজনীতির আঙিনায় প্রাণের আনন্দদায়ক সংবাদ খুব বেশি আসে না। কারণ এই সমাজে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস নিয়ে বিকৃত করার পাকিস্তানি চেতনাধারী লোকের সংখ্যা এখনো অনেক। তবু আন্তর্জাতিক খ্যাতি বয়ে এনেছে জাতির পিতার অবিস্মরণীয় ভাষণ । ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের এতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ড এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। যে তালিকার মাধ্যমে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে সেখানে বঙ্গবন্ধু তখন থেকে আরো ঔজ্জ্বল্য নিয়ে মূর্ত। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭ মার্চের ভাষণটিকে কেন্দ্র করে দশ লাখেরও বেশি মানুষের সেই সমাবেশ মানব সভ্যতার ইতিহাসের বিরল ঘটনা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনা থেকে বঙ্গবন্ধু যখন জনগণের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ভুট্টো গংয়ের বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্ব মেনে নিতে হতো সেটা না মানার জন্যই পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো বলেছিল তাদের দল বাদ দিয়ে অধিবেশন বসলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব নিথর করে দেয়া হবে। ইয়াহিয়া তার হুমকির কাছে মাথা নত করে। আর তার ঘোষণার পরে বাংলাদেশ অগ্মিগর্ভ উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয় “জাগো জাগো বাঙালি জাগো”, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা”, – অস্ত্র ধরো সোনার বাংলা মুক্ত করো”, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, “পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা”, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো” এসব স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশ তখন মিছিলের সমুদ্র। বঙ্গবন্ধু জানান বিনা চ্যালেঞ্জে তিনি কোনো কিছুই ছাড়বেন না। ৬ দফার প্রশ্নে আপস না করারও ঘোষণা আসে। ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট ঘোষণা ও নির্দেশনা তাকে, সম্রাটের উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত করে।

৭ মার্চের ভাষণের পর সারাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে: আর ৮ মার্চ থেকে ৭ টি সেনানিবাস বাদে বঙ্গবন্ধুর শাসন সমগ্র প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের শাসন সংহত করার জন্য ৩১টির, ওপর নির্দেশ জারি করা হয়। নির্দেশাবলি সমাজের সর্বস্তরে যথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অফিস-আদালত, কল কারখানা, রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ, রেডিও-টিভি সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাসভবন থেকে প্রাদেশিক সরকারের কাজ চলছিল। মুলত সরকারের নিয়ন্ত্রণ বঙ্গবন্ধু দখল করেছিলেন। বাস্তবে একটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শাসকের প্রতি একে একে আনুগত্য প্রকাশের পালা শুরু হয়। রেডিও-টিভির পর কারাগার কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশপ্রধান আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে। ১২ মার্চ সকল সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসাররা বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করেন এবং আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণের ইচ্ছার কথা জানান। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে খাজনা-ট্যাক্স বর্জন এবং অন্যান্য কর্মসূচিসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশব্যাপী সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের কাছে খুবই যথার্থ ছিল। ১২ মার্চ লন্ডনের ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড” পত্রিকায় বলা হয়, জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়। সরকারি অফিসার, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, শিল্পপতি এবং অন্যান্য মহলের লোকজন তার সাঙ্গে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শুধু মিলিটারি যারাক ও সৈন্যবেষ্টিত বিমানবন্দরের ওপর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের কর্তৃত্ব রয়েছে বলে মনে হয়। পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগসহ অন্যান্য কর্মসূচি শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। জনগণের সমর্থন নিয়ে সর্বাত্মক ঐক্য সৃষ্টির অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি হয়েছিল এদেশে ।

একাত্তরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার জন্মদিনে বলেছিলেন, “আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন” সাতকোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য তার সেই সংগ্রাম সফল হয়েছিল একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার নির্মম হত্যাকাণ্ড সবকিছু স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে পুনরায় তার সেই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের চেতনা ফিরে এসেছে। তাই ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের মতো শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আহ্বান ২০২১ সালেও জাগে দিকে দিকে । বস্তুত, ১৯৬৯ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল– ‘মুজিব প্রকৃতপক্ষেই পূর্ব পাকিস্তানের মুকুটহীণ সম্রাট’। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে এসে সেই মুকুটহীণ সম্রাট জনগণের প্রিয় শাসকে পরিণত হলেন এবং দেশ চলতে আরাম্ভ করল তারই নির্দেশে ।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান এ জন্যই লিখেছিলেন_ “আমার ধারণায়, ১৯৭১ সালের পহেলা থেকে ছাব্বিশ মার্চ — এই ছাব্বিশ দিনেই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে এক স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিল…। কারণ এ সময় দেশ পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। আর সে সময় থেকেই কর্মনিষ্ঠ, ধৈর্য, সংগ্রামী চেতনা, আপসহীনতা আর অসীম সাহসিকতার জন্য যুগস্রষ্টা নেতা হয়েছিলেন তিনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীর, শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহানায়ক, মহামানব হিসেবে চির স্মরণীয় একটি নাম। এতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ‘ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ স্বীকৃতি পাওয়ায় এখন সারাবিশ্ব আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জানতে পারছে। এই ভাষণেই জেগে উঠেছিল পুরো জাতি। এই ভাষণে স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয় বাঙালিরা। মুক্তিযুদ্ধ ঝাপিয়ে পড়ে। এই ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, আগামীতেও যুগিয়ে চলবে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোর মধ্য স্বাধীনতার ঘোষণা চূড়ান্তভাবে উচ্চারিত হয়েছে এই ভাষণেই।

লেখক:ড. মিল্টন বিশ্বাস- অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ