মান বজায় রেখে দেশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রপ্তানির এ ধারাবাহিকতা রাখতে পারলে আগামীতে বিদেশে নতুন বাজার তৈরি হবে; যা দেশের রপ্তানি খাতে বৈচিত্র আনতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে দেশে নার্সারি শিল্পেরও বিকাশ হবে।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সমুদ্রপথে পাঠানো হয়েছে চার হাজার ৪৬০টি বিভিন্ন প্রজাতির আমের চারা।
কুমিল্লার মেসার্স বিজরা ইন্টারন্যাশনাল এসব চারা পাঠিয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষায়িত কন্টেইনারে; যা ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যে পৌঁছানোর সূচি রয়েছে।
সমুদ্রপথে বিদেশে গাছের চারা রপ্তানির এটি দ্বিতীয় চালান। এর আগে গত বছরের জুনে প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতারে আট প্রজাতির ফলের মোট তিন হাজার ৭৪৭টি চারা পাঠায় একই কোম্পানি।
রপ্তানিকারক বিজরা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামসুল আলম বলেন, নতুন করে কী রপ্তানি করা যায় সে চিন্তা থেকেই আমাদের কোম্পানি চারা রপ্তানির চিন্তা করে। পরে চাহিদার বিপরীতে সমুদ্রপথে চারার দুটি চালান পাঠানো হয়।উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র, চট্টগ্রামের বিভাগীয় উপ-পরিচালক নাছির উদ্দিন জানান, গত বুধবার চারা ভর্তি কন্টেইনার জাহাজে তোলা হয় এবং বৃহস্পতিবার সেটি চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যায়।
দেশি ১২ প্রজাতির আমের গাছের চারার সবশেষ এ চালানের আমদানিকারক দুবাইয়ের আবু সোহেল নার্সারি।
এর আগে কাতারের আল নাইমি অ্যান্ড স্ক্যাপিং নামের কোম্পানিটি ২০২১ সালের জুনে বিজরা ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো সমুদ্রপথে চারা আমদানি করে। ওই চালানে কমলা, লেবু, নিম, ডুমুর, বাদাম, সফেদাসহ আট প্রজাতির চারা ছিল।
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার বিজরা ইন্টারন্যাশনালের মালিক কাতার প্রবাসী মো. আবদুল মোমিন। ওই দেশে তার নার্সারি ব্যবসা রয়েছে।
রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ থেকে সীমিত আকারে সারা বছর বিভিন্ন ধরনের সবজি রপ্তানি হয়ে থাকে, যার বেশির ভাগই যায় আকাশপথে। আগে খুবই কম সংখ্যায় উড়োহাজাজে গাছের চারা গেলেও সমুদ্র পথে এবার বেশি পরিমাণে চারা রপ্তানি শুরু হল।
উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রের উপ পরিচালক নাছির বলেন, অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে গাছের চারা রপ্তানি আমাদের জন্য খুশির খবর। আর্ন্তজাতিক সব নিয়ম মেনে এসব চারা বিদেশে পাঠানো হচ্ছে।
“এতে নতুন একটি খাত উন্মুক্ত হচ্ছে। স্বল্প পরিসরে শুরু হলেও ভবিষ্যতে অন্যান্য নার্সারির মালিক এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি।“
উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র-চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৈয়দ মুনিরুল হক বলেন, আমাদের দেশের চারাগাছের চাহিদা বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বেশি। ভিয়েতনাম-ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে আগে চারা গাছ যেত। নতুন করে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে চারা রপ্তানি শুরু হল।
মানতে হয় বেশ কিছু নিয়ম
দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রপ্তানির উপযুক্ত করে নার্সারিতে এসব গাছের চারা তৈরি করা হয়। চারা তৈরির সময় সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপায় অনুসরণ করতে হয় বলে জানালেন রপ্তানিকারক বিজরা ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীন ‘উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রের’ নিয়ম অনুযায়ী ছাড়পত্র মিললেই চারা বিদেশে পাঠানোর উপযুক্ত বলে ধরে নেওয়া হয়।
বিজরা ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তারা বলেন, আর্ন্তজাতিক আইন অনুযায়ী শিকড়ে মাটিযুক্ত কোনো চারা বিদেশে পাঠানো যায় না। মাটিমুক্ত করে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি বিশেষ ‘কোকোপিটের’ মাধ্যমে শিকড় বাঁচিয়ে রেখে রপ্তানির চারা তৈরি করা হয়।
নার্সারিতে গ্রিন হাউস প্রক্রিয়ায় এসব চারা বড় করে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পোকা ও কীটনাশকমুক্ত করতে হয়। রপ্তানির জন্য চারাগাছ তৈরির প্রক্রিয়ায় স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তরা প্রত্যক্ষ তদারকিও করে থাকেন।প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুনিরুল বলেন, কোনো প্রজাতির একটি চারাগাছ রপ্তানির আগে যে দেশে পাঠানো হবে সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। শর্ত অনুযায়ী রপ্তানিযোগ্য চারা গাছের শিকড়ে কোনো ধরনের মাটি থাকতে পারবে না।
“রোগজীবাণু থাকতে পারবে না, এতে কী পরিমাণ কীটনাশক দেয়া হয়েছে সেই রেকর্ডও থাকতে হবে।“
রোগবালাইমুক্ত এবং রপ্তানির শর্ত মানার প্রক্রিয়ায় পূরণ হলে ‘উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সনদ’ দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এরপর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ কন্টেইনারে করে সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠানো হয়।
বর্তমানে শুধু একটি কোম্পানি এতে যুক্ত হয়েছে জানিয়ে উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রের এই কর্মকর্তা বলেন, এর মাধ্যমে রপ্তানির নতুন একটি খাত উন্মুক্ত হয়েছে। অন্যান্য নার্সারি এগিয়ে আসলে এটি আরও সম্প্রসারিত হবে এবং রপ্তানিতে বৈচিত্র আনবে।
চারা তৈরি হয় গ্রিন হাউজে
সাধারণ নার্সারির চারার সঙ্গে রপ্তানিযোগ্য চারার উৎপাদন প্রক্রিয়া অনেক ভিন্ন উল্লেখ করে বিজরা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী শামসুল আলম বলেন, কলম করা থেকে চারা তৈরি পর্যন্ত প্রায় ৯০ দিন সময় লাগে। এসময় বিভিন্ন ধাপে চারাগুলোকে যত্ন নেওয়া হয়। শুরুতেই চারার শিকড় থেকে মাটি অপসারণ করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি কোকোপিট ব্যবহার করা হয়।
তিনি জানান, এসব চারা ৪০-৪৫ দিন নার্সারিতে তৈরি গ্রিন হাউসে রাখা হয়; এরপর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এসময় পুরনো পাতা ঝরে গিয়ে নতুন পাতা, শিকড় গজায়।
“গ্রিন হাউস থেকে বের করে নেটের শেডে একমাস প্রাকৃতিক আলো বাতাসে রাখা হয়। তিনটি ধাপ পেরিয়ে চারাগুলো রপ্তানি পর্যায়ে পৌঁছায়।“
এরপর স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মীদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা করা হয় এবং উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে পোকামাকড় মুক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর রপ্তানির যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
উৎপাদনের এ প্রক্রিয়া আর্ন্তজাতিক আইন মেনে করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আগে সীমিত পরিসরে উড়োজাহাজে চারা রপ্তানি করেছি। কিন্তু সেটা সংখ্যায় ছিল খুবই কম। বিভিন্ন দেশ থেকে চাহিদার প্রেক্ষিতে সমুদ্রপথে প্রথমবারের মতো চারা রপ্তানি শুরু করি। সমুদ্রপথে সময় বেশি লাগলেও খরচ পরে কম।
আকাশপথে রপ্তানিতে একটি চারায় এক ডলারের বেশি খরচ হয়। আর জাহাজে গেলে লাগছে ৮০ সেন্টের মত।