1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ফিরে দেখা একাত্তরের ১০ এপ্রিল

মোহাম্মদ শাহজাহান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২২

১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ওই ভাষণে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা বিশ্ববাসীকে জানান। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ঢাকাসহ সারা বাংলায় গণহত্যা শুরু করে। সামরিক চক্র বাঙালি জাতির ওপর এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা ওই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ভাষণের মাধ্যমে দেশবাসী ও বিশ্বের মানুষ জানতে পারে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১০ এপ্রিল রাতে এবং ভারতীয় বেতার আকাশবাণী থেকে ১১ এপ্রিল একাধিকবার প্রচারিত হয়।

২৫ মার্চ রাতে অনেক নেতাই বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে তিনি অন্য সবাইকে নিরাপদে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে, কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে এবং ঘাড়ে একটি রাইফেল নিয়ে নিজের বাসা থেকে বের হন। আরহাম সিদ্দিকীর মাধ্যমে আগেই তিনি এই রাইফেল সংগ্রহ করেন। এরই মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ রাইফেল প্রশিক্ষণও গ্রহণ করে ফেলেন।

তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও আমীর-উল ইসলাম ২৫ মার্চ রাতে এক বাড়িতে একত্র হওয়ার কথা ছিল। এই তিনজন ’৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে সকল কর্মসূচি প্রণয়ন করতেন। ড. কামাল হোসেন শেষ পর্যন্ত ওই রাতে নির্ধারিত বাড়িতে একত্রিত হননি। পরে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকেন। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি একই বিমানে স্বদেশে ফিরে আসেন। ২৫ মার্চ রাতে ড. কামাল হোসেন কী কারণে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে একত্রিত হননি- এই বিষয়টি আজও পরিষ্কার হয়নি। ড. কামাল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে স্বেচ্ছায় কারাবন্দিত্ব গ্রহণ করেছিলেন কি না, গত পাঁচ দশকে একবারও তিনি এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। দুই রাত একদিন গোলাগুলির মধ্যে আটক থেকে ২৭ মার্চ তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলাম ঢাকা ছাড়েন। এ দুজন নানা জনপদ ঘুরে ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় ঝিনাইদহে এসে উপস্থিত হন। ৩০ মার্চ বিকেলে তারা মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমদকে নিয়ে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হন।

সেখান থেকে তারা স্থানীয় বিএসএফের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে একটি বার্তা পাঠান, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতা হিসেবে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করার জন্য তারা ভারতে প্রবেশ করতে চান। ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানালে তারা ভারতে প্রবেশ করতে আগ্রহী। কয়েক ঘণ্টা পর স্থানীয় বিএসএফ কমান্ডার এসে তাদের বিএসএফের ছাউনিতে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ এবং আমীর-উল ইসলামকে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে যান। গভীর রাতে এই দুই নেতা যখন কলকাতায় পৌঁছান, তখন ৩১ মার্চের প্রথম প্রহর। সেখানে বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান কে এফ রুস্তমজীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তিনি তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ভারতীয় বিএসএফের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গোলক মজুমদারের সহায়তায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর সীমান্ত অতিক্রম করে ওই রাতে কলকাতা পৌঁছেন। রাতেই একটি সামরিক বিমানে তারা দিল্লি চলে যান। প্রকৃতপক্ষে ২৫ মার্চের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের এটাই ছিল প্রথম যোগাযোগ। তবে ভারত সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের একটা পূর্ব যোগাযোগ ছিল। তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের অন্যতম মঈদুল হাসান তার ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে এই তথ্য উল্লেখ করেছেন। ওই গ্রন্থে রয়েছে, শেখ মুজিবের নির্দেশে ’৭১-এর ৬ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকাস্থ তৎকালীন ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কেসি সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা করেন। দুর্যোগে পড়লে ভারত বাংলাদেশকে কীভাবে কতটুকু সাহায্য-সহায়তা করবে, ওই বৈঠকে তাই নিয়ে আলোচনা হয়। এই বৈঠকের পর কেসি সেনগুপ্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য দিল্লি যান। ঢাকা ফিরে কেসি সেনগুপ্ত ১৭ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদকে আশ্বস্ত করেন যে, পাকিস্তান সামরিক আঘাত হানলে ভারত যথাসম্ভব সাহায্য-সহায়তা করবে। ভারতীয় সাহায্যের রূপরেখা কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ২৪ মার্চ মিলিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ওই বৈঠকটি আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এই অসমাপ্ত সংলাপের কারণে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ ও ভারতের মাটিতে মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ বেস গঠনের বিষয়টি আর স্থির হতে পারেনি।

৩০ মার্চ ১৯৭১ রাতে দিল্লি পৌঁছার পর তাজউদ্দীন আহমদ ৩ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভারতরত্ন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে কোনো সহযোগী ছিল না।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করার পূর্বে তাজউদ্দীন আহমদকে কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বঙ্গবন্ধু শত্রুর হাতে বন্দি। দলের কেন্দ্রীয় কোনো নেতার সঙ্গে তখন পর্যন্ত তার দেখা হয়নি। সঙ্গী আমীর-উল ইসলামের সঙ্গেই বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। দলের বড় নেতাদের মধ্যে কে জীবিত কে মৃত, কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন কি না, কে কে সীমান্তের পথে রয়েছেন, কিছুই তাদের জানা নেই। এমন অবস্থায় তাকে স্থির করতে হয়, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে তার নিজের ভূমিকা কী হবে। তিনি কি শুধু আওয়ামী লীগের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে আলোচনা করবেন? তাতে বিস্তর সুযোগ সহানুভূতি ও সমবেদনা লাভের সুযোগ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার উপযোগী পর্যাপ্ত অস্ত্র লাভের আশা আছে কি? কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে, একটি স্বাধীন সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে, ভারত বা অন্য কোনো বিদেশি সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করা নিরর্থক। এমতাবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের পর জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠন করা যুক্তিসংগত এবং সেই সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তাজউদ্দীনের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দিল্লিতে আসা ও সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া যুক্তিসংগত বলে তাজউদ্দীন মনে করেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগের দিন (২ এপ্রিল ১৯৭১) দিল্লিতে তার এক ঊর্ধ্বতন পরামর্শদাতা তাজউদ্দীনের সঙ্গে আলোচনাকালে জানতে চান, আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে কোনো সরকার গঠন করেছে কি না। এই জিজ্ঞাসা ও আলোচনা থেকে তাজউদ্দীন বুঝতে পারেন, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়েছে কি হয়নি এই বিষয়ে ভারত সরকারের কাছে কোনো প্রকৃত সংবাদ নেই এবং সরকার গঠনের সংবাদে তাদের বিস্মিত বা বিব্রত হওয়ারও কিছু নেই। বরং সরকার গঠিত হয়েছে জানলে পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ৩১ মার্চ ভারতের পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তা এক নির্দিষ্ট ও কার্যকর রূপ নেবে বলে তাজউদ্দীনের বিশ্বাস জন্মায়। যুদ্ধকালীন সরকারের সচিবালয়ে কর্মরত গবেষক মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ গ্রন্থে এসব কথা উঠে এসেছে।

এমনসব চিন্তাভাবনা থেকেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার শুরুতে তাজউদ্দীন জানান, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সরকার আক্রমণ করলে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং একই সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী দলের সকল প্রবীণ সহকর্মী (হাইকমান্ড নামে পরিচিত) সেই মন্ত্রিসভার সদস্য। নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই উপস্থাপন করেন তাজউদ্দীন।

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী সংসদীয় দলের হুইপ ছিলেন। আরেকজন হুইপ ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের ছায়াসঙ্গী।

আগেই বলেছি, ড. কামাল হোসেনসহ এই দুজন বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনের সকল কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পূর্বে আলোচ্যসূচি নিয়ে আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করেন তাজউদ্দীন। আমীর-উল ইসলাম বলেন, দলের সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর হাইকমান্ডের অন্য নেতারা হবেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য। ১৯৭৮ সালে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণবিষয়ক ৬০-৭০ পৃষ্ঠার এই লেখাটিতে এমনই তথ্য আছে।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্যরিস্টার আমীরের পদবি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রিন্সিপাল এইড’। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির রচয়িতাও আমীর-উল ইসলাম। সুবৃহৎ এই লেখাটির পুরোটাই হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশ খণ্ডের একটিতে ছাপা হয়েছে।

সাক্ষাৎ শেষে সহকর্মী আমীর-উল ইসলামকে জানান, মিসেস গান্ধী বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের গাড়ি পৌঁছার পর তাকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তার স্টাডি রুমে নিয়ে যান। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস গান্ধী প্রশ্ন করেন- ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অলরাইট?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। ২৫ মার্চের পরে তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়নি।’ তাজউদ্দীন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যেকোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আগত শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন আশ্রয় ও খাদ্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার আমাদের পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাবে। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা কোনোভাবেই সফল হতে দেয়া যাবে না।’ তিনি জানান, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। বাংলার মানুষের সংগ্রাম, মানবতার পক্ষে ও হিংস্র ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহযোগিতা আমরা চাই।’ মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।

প্রথম সাক্ষাতের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে মতবিনিময় করেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপ্রধান করে তাজউদ্দীন নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। শত্রুর হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং তখনও দেখা মিলেনি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি করাটাও কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল না।

১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা বেতারের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জেনে যায়। ১০ এপ্রিল প্রচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণও রেকর্ড করা হয়। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পূর্বাপর পরিস্থিতি বর্ণনা করে এক গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক অমূল্য দলিল হিসেবেই বিবেচিত হয়।

১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের এক আবেগময়ী, ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্য শক্তি সঞ্চার করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সরকারের আবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। অতিশয় দ্রুততার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন খুবই সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের দ্বিতীয় বৈঠকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য অবাধ রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালানোর অধিকার প্রদান করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী দু দফা বৈঠকের পর এপ্রিল মাসেই ভারত সরকার ২টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর একটি হচ্ছে ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়া এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে- বাংলাদেশ সরকারকে ভারতীয় এলাকায় রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালানোর অধিকার প্রদান করা।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার পর বাংলাদেশের জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নেতারা কে কোথায়, কে কেমন আছেন, তা কারো জানা নেই। বেতার-টিভি প্রশাসনসহ সবকিছু দস্যু বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তানি সেনারা সারা বাংলায় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ভাষণ বাংলার মানুষকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ১০ এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক চিরস্মরণীয় দিন হিসেবে বাংলার মানুষের কাছে চিরকাল ধ্রুততারার মতো জ্বল জ্বল করবে।

১০ এপ্রিলের পর প্রথমে এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান, তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান এবং আরও পরে খোন্দকার মোশতাকসহ অন্য নেতারা কলকাতা পৌঁছেন। মোশতাক ও কিছু যুবনেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানসহ আরও অনেকের সমর্থন ও সহযোগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষিত সরকার বহাল থেকে যায়।

১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি অমূল্য দলিল হয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তাৎক্ষণিকভাবে প্রবাসী সরকারের রাজধানীর নামকরণ করেন মুজিবনগর।

স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস রচনা করতে গেলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু মুজিবের পরে অবধারিতভাবেই তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং যুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রী মনসুর-কামারুজ্জামানের নাম আসবে। ইতিহাস বিকৃতকারীরা বিগত বছরগুলোতে যাকে বা যাদের অন্যায়ভাবে টেনে এনে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি দাঁড় করিয়েছে, তাদের মুখোশও একদিন উন্মোচিত হবে।

লেখক: মোহাম্মদ শাহজাহান – বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, কলাম লেখক-সিনিয়র সাংবাদিক।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ