1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

শিক্ষকদের মনোবল ভেঙে যায় এমন অপচেষ্টা রুখতে হবে

নিরঞ্জন রায় : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

কোনো এক বিখ্যাত লেখকের লেখায় পড়েছিলাম, ‘আমি আমার জন্মের জন্য পিতামাতার কাছে ঋণী, আর আমার জীবনের জন্য আমি আমার শিক্ষকের কাছে ঋণী। ’ আমি সারা জীবন এই মূল্যবান কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি, ব্যক্তিজীবনে অনুসরণ করেছি এবং আগামী দিনেও করব। আমার মতো দেশের বেশির ভাগ মানুষ এই মূল্যবোধটি বিশ্বাস করে, ধারণ করে এবং মেনেও চলে। আর এ কারণেই আমাদের সমাজে শিক্ষকের স্থান অনেক ওপরে।

যিনি যত বড় বিখ্যাতই হোন আর সুপ্রতিষ্ঠিতই হোন না কেন, তিনি তাঁর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষককে দেখামাত্র মাথা নত করে দাঁড়িয়ে যান এবং সেই শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে সালাম বা প্রণাম করেন। শুধু তা-ই নয়, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকরাও একইভাবে সম্মান করেন তাঁদের সন্তানের শিক্ষকদের।
মা-বাবার পরই শিক্ষকদের স্থান দিয়ে তাঁদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করার ঐতিহ্য আমাদের দেশে দীর্ঘদিনের, যা নানা প্রতিকূলতা, উত্থান-পতন ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যেও অটুট আছে। অথচ সেই শিক্ষকদের লক্ষ্য করে তাঁদের অপদস্থ ও নির্যাতন করার এক নতুন চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখন তিনি জামিনে মুক্ত হয়েছেন। এ ঘটনার পরপরই নওগাঁর এক স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের হিজাব পরার বিষয় নিয়ে এক অপপ্রচার চালিয়ে তাঁকেও অপদস্থ করার চেষ্টা চালানো হয়; যদিও স্থানীয় জনগণ, বিশেষ করে সেই বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ায় ঘটনাটি আর বেশিদূর এগোয়নি।

আমাদের দেশের শিক্ষকরা কোনো অবস্থায়ই ধর্ম অবমাননার মতো কোনো কাজ করতে পারেন না এবং করেনও না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকরা কোনো অবস্থায়ই এ ধরনের কাজ করার ঝুঁকি নেবেন না।

আমাদের দেশে কারণে-অকারণে একটি স্বার্থান্বেষী মহল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা মাঝেমধ্যেই করে থাকে; যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিবেকবান মানুষের প্রতিরোধের মুখে সেসব ঘটনা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না। কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। সেই ১৯৪৭-এর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের শুরু থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যে ঘটনা ঘটে আসছে। অতীতের ঘটনা থেকে এবারের ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কারণ অতীতের সাম্প্রদায়িক হামলার লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির, উপাসনালয় ও বাড়িঘর। এবার স্কুলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকদের টার্গেট করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের প্রথম শিকার হলেন হৃদয় মণ্ডল। এ ঘটনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনার চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর ও উদ্বেগের। কারণ এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী ও মারাত্মক। এভাবে শিক্ষকদের অপদস্থ করার অর্থই হচ্ছে একটি দেশের শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিজয়ের প্রাক্কালে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। এখন একইভাবে শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিতভাবে দেশের শিক্ষকদের ওপর এভাবে নির্যাতন চালানো শুরু হয়েছে।

হৃদয় মণ্ডলকে অপমান-অপদস্থ করে কারাগারে বন্দি রাখা হয় শুধু ক্লাসে বিজ্ঞান পড়ানোর সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে। নওগাঁর আরেক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে একই রকম প্রচেষ্টা হয়েছিল। এসব ঘটনার কারণে দেশের শিক্ষকসমাজের মনোবল ভেঙে যাবে। তাঁরা সব সময় এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে থাকবেন। এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার কারণে যে শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকদের মনোবল ভেঙে যাবে, তেমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব বিবেকবান শিক্ষকের মনোবলই ভেঙে যাবে। শিক্ষকরা আর সাবলীলভাবে পাঠদান করতে পারবেন না। কী বললে কী হয়—সব সময় যদি এই আতঙ্কে থাকতে হয়, তাহলে কোনো কাজই নিষ্ঠার সঙ্গে করা যায় না। শিক্ষাদান তো আরো সম্ভব নয়। কারণ সঠিকভাবে শিক্ষাদান পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ।

শিক্ষকদের মনোবল ভেঙে গেলে যে কী হয় তার প্রমাণ তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। হৃদয় মণ্ডলের ঘটনার পর কিছু সাংবাদিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তাঁরা প্রথমে মন্তব্য করেন এই বলে যে হৃদয় মণ্ডল কাজটি ঠিক করেননি। অর্থাৎ বিস্তারিত না জেনেই হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে এবং যারা এই অপকর্ম ঘটিয়েছে, তাদের পক্ষে মন্তব্য করে বসলেন। পরে যখন এ ঘটনার নিন্দা জানানো শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন মহল থেকে এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশসহ অনেক সংগঠন যখন এ ঘটনার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করল, তখন সেই শিক্ষক নেতারা বক্তব্য পরিবর্তন করে এ ঘটনার নিন্দা জানালেন। আমি নিশ্চিত যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যে ইচ্ছা করে প্রথমে এ ঘটনার নিন্দা জানাননি তেমন নয়। তাঁরা নিন্দা জানাতে সাহস করেননি। কারণ তাঁদের মনোবলও ভেঙে গেছে। এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যেই ছিলেন যে কি থেকে কি বলে নিজেরা আবার কোনো সমস্যায় পড়েন। এমন আতঙ্ক থেকেই তাঁরা প্রথমে নিন্দা জানাতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন।

শিক্ষকদের কখনো ধর্মের ভিত্তিতে বিচার করার সুযোগ নেই। শিক্ষক হলেন শিক্ষাগুরু, তা তিনি যে ধর্মেরই অনুসারী হোন না কেন। যেকোনো কারণেই হোক না কেন, হিন্দু শিক্ষকদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সুনামটা একটু বেশি। আমি আমার ছাত্রজীবনে দেখেছি, আমাদের জগন্নাথ হলের ছাত্ররা ঢাকার বিভিন্ন বাসায় গৃহশিক্ষকতার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ও অগ্রাধিকার পেয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমাদের মুসলিম শিক্ষকরা ভালো পড়ান না। তাঁরাও যথেষ্ট ভালো পড়ান এবং তাঁদের কাছ থেকে অর্জিত জ্ঞান মনে রাখার মতো। আমার স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন শামসুল আলম স্যার। সেই স্যার এত সুন্দর করে ইংরেজি পড়াতেন, যা আজও আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে। সত্যি বলতে কী, স্যারের শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করেই ইংরেজির মতো একটি ভাষা রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছি। সেই স্যারের শিক্ষা নিয়ে ইংরেজি কতটুকু শিখতে পেরেছি, তা হয়তো বলতে পারব না। তবে সেই শিক্ষা নিয়েই পশ্চিমা বিশ্বের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ব্যক্তিদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করে যেতে পারছি এবং দেশের একাধিক ইংরেজি পত্রিকায় কলামও লিখছি।

আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের মাসুদ স্যারের পাঠদান আমার মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মাসুদ স্যার এত সুন্দর করে ফিন্যান্স বিষয়গুলো পড়িয়েছিলেন যে তাঁর বিষয়ে পাস করার জন্য আর বিশেষভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়নি। শুধু তা-ই নয়, এই পশ্চিমা বিশ্বে এসে যখন পেশাগত লেখাপড়া শুরু করলাম, তখনো সেই মাসুদ স্যারের শেখানো জ্ঞান দিয়েই অনায়াসে পার পেয়ে গেছি। এমনকি পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও সেই স্যারের কাছ থেকে শেখা জ্ঞানই কাজে লাগছে। আসলে ভালো শিক্ষকের কোনো তুলনা হয় না এবং তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সব শিক্ষকই শিক্ষাগুরু, তবে কিছু শিক্ষকের থাকে বিশেষ দক্ষতা, যার কারণে তাঁরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটু বেশি জনপ্রিয় হন। কিন্তু এ কারণে একজন শিক্ষককে অপদস্থ করার জন্য ইন্ধন জোগাতে হবে কেন? আর এই ইন্ধনে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা এবং তাদের অভিভাবকরা সাড়া দেবেন কেন? হৃদয় মণ্ডল যাদের পাঠদান করেন, তাদের ৯০ শতাংশই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী। তারা কি বোঝে না যে এতে তাদেরই ক্ষতি হবে।

আমাদের দেশে শিক্ষকদের ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবক যেভাবে সম্মান করে, তেমনটা পাশ্চাত্য বিশ্বে তো নয়ই, অন্য কোনো দেশে দেখা যায় কি না জানা নেই। শিক্ষকদের বিশেষ সম্মান করা আমাদের দেশের ঐতিহ্য এবং আমাদের শিক্ষকসমাজের কাছেও এই সম্মানটুকুই জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। এখানে যদি কোনো রকম ছন্দঃপতন ঘটে, তাহলে জাতির যে ক্ষতি হবে, তা আর সহজে পূরণ হবে না। আমাদের শিক্ষকদের কোনো রকম অসম্মান হয় বা তাঁদের মনোবল ভেঙে যায় এমন ঘটনাকে কোনো অবস্থায়ই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। বরং এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তা এখানেই বন্ধ করতে হবে। আর এই কাজটি করতে হবে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের এবং তাদের অভিভাবকদের। যে ছাত্ররা ভালো শিক্ষা লাভের জন্য এক স্যারের কাছ থেকে আরেক স্যারের কাছে ছুটে বেড়ায় এবং যে অভিভাবকরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের এক শিক্ষকের কাছ থেকে আরেক শিক্ষকের কাছে ছোটেন, তাঁরা কেন শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন ঘটনা প্রতিহত করবেন না। তাই সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষকদের মনোবল ভেঙে যায় এমন অপচেষ্টা একযোগে রুখে দিতে হবে।

লেখক : নিরঞ্জন রায় – সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার টরন্টো, কানাডা।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ