1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

‘মিতব্যয়ী’ হতে প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী আহ্বান

অধ্যাপক ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০২২

মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য প্রথম ধারণা বা জ্ঞান লাভ করি শৈশবে বাবার কাছে। যে কোনো জিনিস যা সাধারণত শেষ হয়ে যায় তা প্রয়োজনের বেশি করতে নিষেধ করেছিলেন। আমাকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে মিতব্যয়ী হওয়া যায়। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে শিখেছি সক্রেটিসের জীবনীতে। তিনি বলতেন How many things I can do without! অনেকে কৃপণ বলে বদনাম করলেও বিপদে মানুষকে সাহায্য করতে অন্যান্য অনেকের আগে বাবাই এগিয়ে আসতেন। অন্তত যেসব ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য-সহায়তার প্রয়োজন ছিল। আর সক্রেটিসের বাণী হজম হওয়ার পর মানুষ কৃপণ বলে বাবার সমালোচনাও আমার আর খারাপ লাগতো না। পারিবারিক ও সামাজিক নানা প্রসঙ্গে মিতব্যয়, অপচয় ও সাশ্রয় এই শব্দগুলোর সঙ্গে বাবাই আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। না, সরাসরি নয়- সাম্প্রতিককালে নানা প্রসঙ্গে মনে পড়ে আমার বাবাও তো এভাবেই ভাবতেন। এভাবেই সংসার চালাতে পরিবারের সবাইকে প্রায়শই নির্দেশ দিতেন। শৈশবে আমরা দেখেছি প্রতি বছর আমাদের দেশে বছরে দুটি আকাল দেখা দিত- কার্তিক ও চৈত্র মাসে অভাব-অনটন তীব্র আকার ধারণ করতো। মিতব্যয়, অপচয় ও সাশ্রয় প্রসঙ্গে কখনো কখনো কার্তিক ও চৈত্র মাসের নামগুলোও বাবার মুখে উচ্চারিত হতো। নানা রকমের টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে গেলেও বাবার সঞ্চয়ী মনোভাবের জন্যই কার্তিক ও চৈত্র মাসের তীব্র অভাবের স্পর্শ আমরা সব সময়ই এড়িয়ে যেতে পেরেছি।

সন্তানের কথা-বার্তা, খাওয়া-দাওয়া, চাল-চলন, হাব-ভাব, পোশাক-আশাক সব বিষয়ে একজন অভিভাবকই সব সময় নজর রাখেন। কারণ পরিবারের তিনিই কর্তা। তার ওপরই পরিবারের সকলের ভার ন্যাস্ত- তাই তার নির্দেশ, তার শাসন-অনুশাসন, তার বেঁধে দেওয়া নিয়ম-কানুন মেনে চলা অন্যান্য সদস্যদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কারণ এসব যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও নির্দেশের পশ্চাতে পরিবারের সকলেরই কল্যাণ নিহিত, একসাথে সকলের ভালো থাকা নিহিত। অভিভাকের নির্দেশে স্বাধীনতা হরণের ভয় নেই- বরং আছে শাশ্বত শৃঙ্খলা বোধ। সৃশঙ্খল জীবনই তো মানুষের কাম্য- সুশৃঙ্খল জীবন, মিতব্যয়ী জীবন এবং সবশেষে পরিণতিতে সফল জীবন। দিনশেষে আমরা সবাই সফল মানুষই হতে চাই।

মিতব্যয়ীতা সর্বকালীন সদগুণের একটি। প্রাচীনকাল থেকেই দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা তাদের চিন্তা ও আবিষ্কারে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য আবাসস্থলে পরিণত করেছেন। তাদের অনেকের সুচিন্তা ও মিতব্যয়িতার দিকনির্দেশনা আমাদেরকে সফল মানুষ হওয়ার প্রেরণা সঞ্চার করে চলেছে। প্রাচীনকালের জ্ঞানীরাও অপচয়ের বিরুদ্ধে বলেছেন, সব ধর্ম প্রচারকরাও বলেছেন অপচয়ের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত ভোগবিলাসকে তীব্র ঘৃণা করেছেন, গুনাহের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। মনে পড়ে সক্রেটিসের বিখ্যাত সেই উক্তি ‘কত কিছু বাদ দিয়ে আমি বাঁচতে পারি’। আমাদের ধর্মেও ‘অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং খাদ্য-দ্রব্য, পোশাক-আশাক, চাল-চলন, হাব-ভাবেও আমাদের মিতব্যয়ী হওয়ার বিকল্প নেই। বিকল্প নেই অন্যান্য বহুবিধ অপচয় রোধ থেকেও। সাধারণত এতে আমরা অন্তত দুই ভাবে উপকৃত হতে পারি- এক. অহেতুক খরচ বাঁচাতে পারি, দুই. সাশ্রয়ের মাধ্যমে সঞ্চয়ী হতে পারি।
আমাদের বৃত্তি, প্রবৃত্তি ও স্বভাবের মধ্যে কিছু খামখেয়ালিপনা আছে। মোটামুটিভাবে কেউ কেউ সচেতন থাকলেও অনেকের মধ্যেই একটা উদাসীনতা বা আলস্য যেন গোপনেই বাসা বেঁধে আছে। আমরা অনেক সময় ঘরে না থেকেও ফ্যান, লাইট, গিজার, এমনকি এসি চালিয়ে রাখি। বাইরে বেরোনোর সময় সামান্য কষ্ট করে সুইচগুলো ইচ্ছা করেই অফ করতে ভুলে যাই- কিংবা ঘরটি শীতল হোক ভেবে চলে যাই বাইরে। ঘর ঠাণ্ডা রাখার উদ্দেশ্যে আমরা নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়ি। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অহেতুক ঘর ঠাণ্ডা হতে থাকে- ঠাণ্ডা উপভোগের কোনো মানুষ ঘরে থাকে না! ঘরের ভেতর লাইট জ্বলে, ফ্যান চলে, এসি চলে! এভাবে যে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ অপচয় হয় তার হিসেব রাখাও কঠিন!

নিজের একটি দিয়াশলাই কাঠির খরচ বাঁচাতে একসময় আমরা সারাদিন গ্যাসের চুলার বার্নার জ্বালিয়ে রেখে জাতির প্রাকৃতিক সম্পদের কী ব্যাপক অপচয়ই না করতাম! কিন্তু সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে সে স্বভাবটি আমাদের মধ্যে থেকে দূর হয়েছে বলে মনে হয়। ভরা গ্রীষ্মে আমরা আমাদের কৃষ্টি-কালচার, রুচি বিসর্জন দিয়ে স্যুট, কোট পরে অফিস করি- অফিসে ব্যবহার করি সরকারি খরচে বিদ্যুৎ-চালিত হাজার হাজার টনের এসি- সেন্ট্রাল এসি হিসেবে এই শীতাতপ ব্যবস্থা পরিচিত। সরকারি কর্মকর্তাদের মিতব্যয়ী হওয়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরপর কোনো কোনো গণমাধ্যম সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় অপ্রয়োজনে এসি চালানোর যে খতিয়ান জনসমক্ষে হাজির করেছে তা সত্য হলে এখানেও আমরা সেই প্রচলিত প্রবাদ ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ দেখারই অবকাশ পাই! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে বিপর্যস্ত বিদ্যুৎপরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই সরকারি কর্মকর্তাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে সময়ও তিনি গরমকালে স্যুট-কোট পরে সরকারি কর্মকর্তাদের অফিস করার সমালোচনা করেছিলেন। তখন আমাদের বিদ্যুৎ ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যুৎ উপাদন অনেক বাড়লেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক জ্বালানির যে সংকট দেখা দিয়েছে তাতে আগামী অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই আমাদের অভিভাবক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যেন আমরা সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলা করতে পারি। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে তিনি সবসময়ই আমাদেরকে ঘরের বাইরে বেরোনোর সময় সুইচটি বন্ধ করতে বলেছিলেন। তিনি নিজ হাতে এ কাজটি করেন বলে সবাইকে সে তিনি এটি করতে আহ্বানও জানিয়েছিলেন।

গরমকালে স্যুট-কোট পরা ‘ফর্মালিটিজ’ না মানসিক দৈন্য তা ভেবে দেখারও সময় এসেছে। আমরা যদি মানসিক দৈন্য দূর করতে পারি তাহলে আমাদের ছোটখাট অনেক সংকট আপনা থেকেই দূর হতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অবুঝ শিশুকিশোরদের মতো আচরণ করি। শিশুকিশোরদের এমন বালসুলভ আচরণ দূর করার জন্য যেমন একজন অভিভাবকের প্রয়োজন জাতির বালসুলভ আচরণ দূরকরার জন্যও একজন নেতা প্রয়োজন। আমরা ভাগ্যবান যে, আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। জননেত্রী শেখ হাসিনা এমন একজন অভিভাবক যিনি রাষ্ট্রের সব সদস্যের চলা-ফেরা, চাল-চলন, হাব-ভাব, আচার-আচরণ প্রভৃতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর কাকে কোন সময় কী করতে হবে সে নির্দেশটি দেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র একটি পরিবার এবং সেই পরিবারের প্রধান অভিভাবক জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গত ১৯ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় আবারো মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সরকারের সব পর্যায়ের সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মাননীয় প্রধামনন্ত্রীর এই আহ্বান সরকারের সংশ্লিষ্টদের মতো সমগ্র দেশবাসীর জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য বলে আমরা মনে করি। আমরা জানি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়শই বিভিন্ন সভায় সরকারি কর্মচারীসহ দেশের মানুষের প্রতি যাবতীয় সম্পদের অপচয় রোধের আহ্বান জানান- যা একজন প্রধানমন্ত্রীকে বাস্তবিক অর্থেই দেশের অভিভাবকরূপে প্রতিপন্ন করে তোলে। প্রকৃত অভিভাবক বলেই অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থায়ও তিনি বিভিন্ন সময় আমাদেরকে ভবিষ্যতের বিষয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিতেন।

সাম্প্রতিককালের সম্ভাব্য বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায়ও তিনি অনেকটা অগ্রিমভাবেই আমাদের সচেতন করেছেন। বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন মহামন্দায় আক্রান্ত তখন দেশের অর্থনীতির চাকা সচল ও সক্রিয় রাখার স্বার্থে আমাদের মিতব্যয়ী এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন না হওয়ার কোনো পথই যে খোলা নেই তা তিনি উপলব্ধি করছেন। একইসাথে সবাইকে সংকট মোকাবিলায় সংযমি অর্থাৎ মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বানও করেছেন।

অন্তত পক্ষে ৭০টি কারণে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশ কখনো শ্রীলংকার ন্যায় পরিণতি বরণ করবে না। তবু, শ্রীলংকার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করেছে। একদল মানুষের ‘অতিরিক্ত’ প্রচারণার কারণে সাধারণের মধ্যেও সে উদ্বিগ্নতা বিস্তৃত হতে যচ্ছিল- কিন্তু অর্থনীতিবিদদের নানা রকমের বিশ্লেষণ এবং বিদেশি একাধিক সংস্থার জরিপে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ততটা দুর্বল নয় সে চিত্র ওঠে আসায় সাধারণের মধ্যে উদ্বিগ্নতা থাকলেও অস্বস্তি নেই। অপপ্রচারকারীদের কল্পিত পরিণতি সম্পর্কে মানুষ প্রকৃত বাস্তবতা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করে স্বস্তি পেয়েছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ সামগ্রিকভাবে বিশ্বে যে প্রভাব ফেলেছে তারই আঁচ বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও কিছুটা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। বিশেষ করে জ্বালানি অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই প্রভাব অনেকটাই প্রবল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি মূল্য ও সরবরাহ চেইনে যে নেতিবাচক প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইউরোপের অনেক দেশও বহুমুখী সংকটের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।

সম্প্রতি আমাদের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়ে গেছে। যদিও জুন মাসে খাদ্যসামগ্রী মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত অন্যান্য ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, করোনা অতিমারির মহাস্থবিরতা সব মিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি বিরাট চাপের সম্মুখীন। এরূপ অবস্থায় সব দেশেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি বিগত কয়েক মাস ধরেই অব্যাহত আছে- বিশেষত খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব দেশের মানুষই যেন দিশেহারা! খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সব দেশের মানুষেরই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। বাংলাদেশও এই পরিস্থিতির শিকার। আমাদের ১০০ টাকায় কিনতে হয় ১ ডলার! শুধু তাই নয়- ভারতেও মুদ্রারমান দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। সেখানেও সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে রুপি ও ডলারের কেনা-বেচা চলছে। এক কথায় সমগ্র বিশ্বের মানুষই এখন কোভিড- ১৯ উত্তর যুদ্ধজাত সংকটের মধ্যে আপতিত। আমরা ভাগ্যবান যে, জননেত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বগুণে আগেই তা টের পেয়ে বহু আগে থেকেই জনগণকে সংকট মোকাবিলায় মিতব্যয়ী ও সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা তার নেতৃত্বেই জাতীয়ভাবে এই সংকট মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন করবো। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম – অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ

নির্বাচিত