1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সৌভাগ্যের বরপুত্র মির্জা ফখরুল

চিররঞ্জন সরকার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০২৩

শুরুতেই একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। কলেজ জীবনে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে আমার শিক্ষক ছিলেন বর্তমান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শিক্ষক থাকাকালে তিনি আমাদের অর্থনীতি পড়াতেন। আমরা কলেজে সবাই তাঁর ভক্ত ছিলাম। শুধু ইকবাল নামে এক ফাজিল বন্ধু স্রোতের বাইরে গিয়ে মন্তব্য করত, ‘আলমগীর স্যার হল রাজাকারের বাচ্চা। আর রাজাকারের বাচ্চারা কখনও সাচ্চা হয় না!’

আমরা তখন সবাই মিলে ইকবালকে বয়কট করেছিলাম। একজন স্যারকে এভাবে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলাটাকে আমরা সেদিন ভালোভাবে নিতে পারিনি। কিন্তু নির্মম পরিহাস, পরবর্তী সময়ে তিনি দলীয় রাজনীতিতে জড়ালেন। ক্রমে ক্রমে তিনি বিএনপির শীর্ষ নেতা বনে গেলেন। রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী তার গভীর মিত্র হয়ে গেল। অসত্য ভাষণ আর কান্নাকাটিতে তিনি অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করলেন!

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবরই মৃদুভাষী। নম্র-ভদ্র স্বভাবের। সুন্দর উচ্চারণ। গুছিয়ে কথা বলেন। পরিচ্ছন্ন ফিট-ফাট। রাজনীতিতে একটা ‘ক্লিন’ ইমেজ আছে। তিনি সৌভাগ্যের বরপুত্রও বটে। জন্মসূত্রেই তিনি অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন। পিতার পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে পেশাগত ও রাজনৈতিক জীবনেও আশাতীত সাফল্য পেয়েছেন। তার জন্ম এক ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ পরিবারে। তার বাবা মির্জা রুহুল আমিন (চোখা মিয়া) মুসলিম লীগ করতেন, ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনার ও চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। অপছন্দের ব্যক্তিকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই উদ্যোগী। তাইতো সবাই তাকে ডাকতেন ‘চোখা’ মিয়া। ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় এলাকায় যে খুব কড়া তাকে ‘চোখা’ (ধারালো) বলা হয়। আমরা কৈশোরে তার ‘বীরত্বের’ অনেক কাহিনী শুনেছি।

১৯৭১ সালে রুহুল আমীন ছিলেন ঠাকুরগাঁও জেলার শান্তি কমিটির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি ভারতে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালে দালাল আইনের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর একাত্তরের ঘাতক দালালদের আটক করে বিচার করা শুরু করে।

১৯৭৩ সালের ৩০ শে নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও আটক থাকা মোট ১১ হাজার দালালের একজন ছিলেন রুহুল আমিন। যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় ৭১০ নম্বরে ছিল তার নাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট দালাল আইন বাতিল করে ১৯৭২ সালের দালাল আইনে আটক কৃত অপরাধীদের মুক্ত করে দেন। মুক্তি পেয়ে রুহুল আমিন জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে যোগ দেন।

মির্জা রুহুল আমিন ওরফে চোখা মিয়ার জন্ম ঠাকুরগাঁও জেলার নিকটবর্তী পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী থানার মির্জাপুর পাড়ায়। সে সময় সে এলাকার নেতা ছিলেন মির্জা গোলাম হাফিজ। মির্জা গোলাম হাফিজের কাছে রাজনীতিতে সুবিধে করতে না পেরে চোখা মিয়া ঠাকুরগাঁও জেলায় চলে আসেন। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সে সময় ঠাকুরগাঁও জেলার একক পেট্রোল পাম্প ও সিনেমা হল ব্যবসায়ী ছিলেন, আজও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরদের পেট্রোল পাম্প ও সিনেমা হল ব্যবসা আছে, সিনেমা হলের নাম বলাকা টকিজ, পেট্রোল পাম্প নাম মির্জাস পেট্রোল পাম্প।

জিয়াউর রহমানের আমলে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ১৯৭৯ সালে ঠাকুরগাঁও ২ আসন থেকে ১ম এমপি হন। সে সময় ঠাকুরগাঁও ১ আসন (সদর) থেকে বিএনপির এমপি হন হাজী দানেশের জামাতা রেজওয়ানুল হক চৌধুরী তথা ইদু চৌধুরী।

১৯৮৬ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে মির্জা রুহুল আমিন জাতীয় পাটিতে যোগ দেন এবং টেকনোক্রেট মন্ত্রী হিসেবে এরশাদ সরকারের কৃষি মন্ত্রী হন। ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে এরশাদ সংসদ বাতিল করে দেয়। এরপর ১৯৮৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও ২ আসন থেকে জাতীয় পাটি থেকে এমপি হন। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের কৃষি মন্ত্রী থেকে বাদ পড়েন। তিনি ১৯৮৮সাল থেকে ১৯৯০ এরশাদ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত জাতীয় পাটির এমপি ছিলেন। ইতিহাসের গভীর তামাশা হচ্ছে, যে মির্জা রুহুল আমিন ঠাকুরগাঁও জেলার বিএনপিকে পথে বসিয়ে ১৯৮৬ সালে এরশাদের জাতীয় পাটিতে যোগ দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ওপর চালিয়েছিল সীমাহীন দমন-পীড়ন, তার সন্তানই পরে বিএনপির মহাসচিব হন!

যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান মির্জা ফখরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র থাকাকালে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। শুরুতে মোনায়েম খানের এনএসএফ, পরে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে (মেনন গ্রুপ) যোগ দেন । ১৯৬৯ সালে তিনি সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। সেই সময়ের ঠাকুরগাঁওর মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, তিনি তখন গোপনে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেছেন। তিনি নিজে অবশ্য বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একাত্তরে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে দাবি করেছেন। যদিও তার এই দাবির পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ নেই। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা কেউ-ই তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কোনো নমুনা দেখেননি। ঠাকুরগাঁওর হাজীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা ডা. শেখ ফরিদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক আখতার হোসেন রাজা, দবিরুল ইসলাম এমপি (যার বাবা আকবর আলীকে বাড়ি থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে লাশ তিরনই নদীতে ফেলে দেয়া হয়), সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমসহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

১৯৭২ সালে মির্জা ফখরুল ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রশাসনের অধীনে দায়িত্ব পালন করেছেন। জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এসএ বারী এটি। তার ব্যক্তিগত সচিব পদে মির্জা আলমগীর দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর এসএ বারী উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান মির্জা আলমগীর। এবার নিজ শহর ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক পদে। ঠাকুরগাঁও ফিরে তিনি ধীরে ধীরে আবার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৮৮ সালে এরশাদের আমলে তিনি শিক্ষা বিভাগের ডিজি ছিলেন। এরশাদের আমলে অন্যান্য সরকারি দায়িত্বের মধ্যে মির্জা ফখরুল বাংলাদেশ সরকারের পরিদর্শন ও আয়-ব্যয় পরীক্ষণ অধিদপ্তরে একজন অডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। বাবা জিয়া সরকারের এমপি ও এরশাদ সরকারের মন্ত্রী থাকায় দু সরকারের আমলে মির্জা ফখরুল সরকারি আনুকূল্য পেয়েছেন বলে মনে করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

১৯৮৮ সালে এরশাদ মির্জা ফখরুলের বাবা মির্জা রুহুল আমিনকে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দিলে, তিনি তার ছেলেকে পারিবারিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ন্তা হিসেবে খাঁড়া করতে শিক্ষকতা পেশা থেকে ফিরিয়ে এনে পৌরসভার মেয়র পদে দাঁড় করিয়ে দেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মির্জা ফখরুল ১৯৮৯ সালের পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে এরশাদ ঠাকুরগাঁও এলে জনসভায় তিনি ঠাকুরগাঁও পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে বক্তব্য রাখেন, এরশাদ ঠাকুরগাঁও পৌরসভার জন্য ২ কোটি টাকা দেন।

এরশাদের পতনের পর ঠাকুরগাঁও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারা মিছিল নিয়ে তার বাড়ি ঘেরাও করে। এ সময় পিতা-পুত্র উভয়েই ছাত্রজনতার ক্ষোভের মুখে আত্মগোপন করেন। ১৯৯১ সালে মির্জা ফখরুল যখন বিএনপির মনোনয়ন পান তখন তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। তার দুঃসম্পর্কের চাচা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা গোলাম হাফিজ তাকে সহযোগিতা করেন।

দলীয় নেতাকর্মীদের বিরোধিতা ও ক্ষোভের মুখে ফখরুল ১৯৯১ সালে নির্বাচনে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। উল্লেখ্য, ঠাকুরগাঁওয়ে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যে এরশাদের দোসরদের যে তালিকা বানান, সে তালিকায় তার বাবা ও মির্জা ফখরুলের নাম ছিল। মির্জা ফখরুলের নামে দালাল প্রতিরোধ কমিটি বিভিন্ন পোস্টার বের করে । সে সময় ঠাকুরগাঁও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যে সাথে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের যে সব নেতা জড়িত ছিলেন, মির্জা ফখরুল তাদের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করেন ১৯৯১ সালের পর।

এরপর রাজনীতিতে তিনি কেবলই উজিয়েছেন। এখন বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের মুক্তির জন্য চোখের জলে নদী বানিয়ে ফেলেন।

অনেকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মির্জা ফখরুলের নাম মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে রয়েছে। হ্যাঁ, তিনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট তুলেছেন যখন বিএনপির মন্ত্রী ছিলেন তখন। দলিলপত্রেও তারপরেই নাম তুলেছেন। এসব তথ্য ঠাকুরগাঁওর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাওয়া।

প্রথমে কলেজ শিক্ষক, সেখান থেকে পৌরসভার মেয়র, এরপর দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব। আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্ট সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলে তিনি সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হবেন। সৌভাগ্যের বরপুত্র বুঝি একেই বলে!

লেখক: চিররঞ্জন সরকার – কলামিস্ট।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ এমদাদুল হক রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধ ঠাকুরগাঁও’।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ

নির্বাচিত