1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও জামায়াতের পরিকল্পনা

ডা. এম এ হাসান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

বাংলাদেশে গণহত্যার সবচেয়ে বর্বর ও ঘৃণ্য অধ্যায়টি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। জামায়াতে ইসলামীর দফতর সম্পাদক মওলানা এবিএম খালেক মজুমদারকে দেওয়া হয়েছিল ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সমন্বয়ের দায়িত্ব।

বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি খসড়া পরিকল্পনা করে জামায়াতের আব্বাস আলী খান ও গোলাম আযম। এই পরিকল্পনা যথাযথ অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়েছিল রাও ফরমান আলীর কাছে। সেটা করেছিল গোলাম আযম নিজেই। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল বদর বাহিনীর সদস্য আলী আহসান মুজাহিদ, নিজামী, কামরুজ্জামান, মাঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান এমরান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. এহসান, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা জলিল। ফরমান আলীর পরিকল্পনা ও এদের কাজের মধ্যে সমন্বয় করছিল পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার বশির ও ক্যাপ্টেন তারেক। ইপিসিএফ, ওয়েস্ট পাকিস্তান রেঞ্জার্স, পুলিশ ও রাজাকারের কিছু সদস্য এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিল। অনেক বিহারিও এদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করছিল। শান্তি কমিটির যেসব শীর্ষ নেতা এ কাজে তাদের ছায়া হয়ে কাজ করছিল তারা হলো– সৈয়দ খাজা খয়ের উদ্দীন, একিউএম শফিকুল ইসলাম, গোলাম আযম, মাহমুদ আলী, আব্দুল জব্বার খদ্দর, মোহন মিয়া, মওলানা সাইয়েদ মোহাম্মদ মাসুম, আব্দুল মতিন, গোলাম সরওয়ার, এএসএম সোলায়মান, এ কে রফিকুল হোসেন, নুরুজ্জামান, আতাউল হক খান, তোহা বিন হাবিব, মেজর আফসার উদ্দীন ও হাকিম ইরতেজাউর রহমান।

মুক্তির জন্য বাঙালির প্রাণপণ লড়াইকে যখন কোনোভাবেই আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না তখনই পাকিস্তান তার শেষ চাল হিসেবে বাংলাদেশকে প্রশাসনিক ও বুদ্ধিভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে নিঃস্ব করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এ কারণে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে ঘাতককুল। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানিরা এ দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ারসহ শিক্ষিত শ্রেণির বাঙালিকে হত্যার উদ্যোগ নেয়। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা প্রগতিশীল ছিলেন তাদেরই বিশেষ করে টার্গেট করা হয়।

অক্টোবর মাস থেকেই আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রস্তুতি নেয়। নভেম্বর মাসে অনেক বুদ্ধিজীবীর কাছে তারা হুঁশিয়ারিপত্র পাঠাতে শুরু করে এবং মধ্য নভেম্বরে তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করে। এটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার দ্বিতীয় পর্ব।

ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় ব্রিগেডিয়ার রাজা, রমনা থানা এলাকায় ব্রিগেডিয়ার আসলাম, তেজগাঁ এলাকায় ব্রিগেডিয়ার শরীফ ও ধানমন্ডি এলাকায় ব্রিগেডিয়ার শফি ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। আলবদর হাইকমান্ড সদস্য আশরাফুজ্জামান খান এই বাহিনীর প্রধান ঘাতক ছিল বলে জানা যায়। ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য বদর বাহিনীর পাঁচশ’ সদস্যকে নিয়োজিত করা হয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭২ ‘দৈনিক বাংলা’য় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৭১ সালের মে মাসে কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর কাছে ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ ফরম পাঠানো হয়। মনে করা হয়, এদের সম্পর্কে তল্লাশি চালানোর উদ্দেশ্যেই এই ফরম পাঠানো হয়েছিল। ‘লন্ডন টাইমস’ বাংলাদেশের শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও সাহিত্যিকদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা ফাঁস করে দেয়। ফলে পরিকল্পনাটি সাময়িকভাবে স্থগিত থাকে।

’৭১-এর ২৬ মার্চ সকালে জগন্নাথ হলের হাউজটিউটর অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে আরও দুজনের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের রিডার এএনএম মুনিরুজ্জামানকে তাঁর পরিবারের তিন সদস্যসহ শহীদ মিনার সংলগ্ন ৩৪নং বাড়িতে হত্যা করা হয়। অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকেও গুলি করা হয় সেদিন। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে ২৭ মার্চ ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয়। তাঁর পরিচয় জেনেই পাকিবাহিনী গুলি করেছিল তাঁকে। জিসি দেবকেও হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল তাঁর নিজ গৃহে। এসব ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রথম পর্ব।

শিক্ষকদেরই জাতির মাথা ও মেরুদণ্ড ভেবেই পাকিবাহিনী তাদের সমূলে ধ্বংস করতে  চেয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাঁটি তৈরির পর পাকবাহিনী পরিসংখ্যান বিভাগের কাজী সালেহ, গণিত শাস্ত্রের প্রভাষক মুজিবর রহমান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের ড. রফিক এবং বাংলা বিভাগের ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পাকিস্তানি তৎকালীন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন এই তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে পাকিবাহিনীকে সাহায্য করে। সংস্কৃত ভাষার সহকারী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কাজলার পুকুর পাড়ের একটি গর্তে ফেলে রাখা হয়। ২৫ নভেম্বর মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক মীর আব্দুল কাইয়ুমকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায় পাক আর্মির অনুগত উপাচার্যের স্টেনো তৈয়ব আলী। ৩০ ডিসেম্বর পদ্মার চরের বাবলা বনে পাওয়া যায় তাঁর লাশ। গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানকে ১৫ এপ্রিল ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রিগেডিয়ার আসলাম ও কর্নেল তাজের অতিথি ভবনের ছাদে। পরে আর ফিরে আসেননি তিনি।

৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘পূর্বদেশ’-এ প্রকাশিত রিপোর্টে একটি ডায়েরির কথা উল্লেখ করা হয়। সে ডায়েরিটি বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খানের বলে উল্লেখ করা হয়। এই আশরাফুজ্জামান মিরপুর গোরস্থানে সাত জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে বলে আগেই সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। যে গাড়িতে করে শিক্ষকদের নিয়ে যাওয়া হয় তার চালক মফীজ উদ্দীন পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে এ তথ্য জানায়।

এ ডায়েরিটির দুটো পৃষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষক শিক্ষিকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক গোলাম মুর্তজার নাম ও ঠিকানা উল্লেখ ছিল। এই ২০ জনের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর যে ৮ জন নিখোঁজ হন। তাঁরা হলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), অধ্যাপক রশীদুল হাসান (ইংরেজি), অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস), ড. ফয়জুল মহী (ইসলামী শিক্ষা) ও ডা. মুর্তজা।

এ ছাড়াও ডায়েরিতে যাঁদের নাম ছিল তাঁরা হলেন– অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ (বাংলা), ড. নীলিমা ইব্রাহীম (বাংলা), ড. লতিফ (শিক্ষা), ড. মনিরুজ্জামান (ভূগোল), ড. সাদউদ্দীন (সমাজতত্ত্ব), ড. এএসএস শহীদুল্লাহ (গণিত), ড. সিরাজুল ইসলাম (ইসলামের ইতিহাস), ড. আখতার আহমদ (শিক্ষা), ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজি) এবং বাংলা একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। এই ডায়েরিতে ব্রিগেডিয়ার বশির, ক্যাপ্টেন তাহিরসহ অনেকের নাম ছিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ১৬ জন শিক্ষকের নাম ছিল যাদের কেউ নিখোঁজ হননি। এই শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন পাকবাহিনীর দালাল ড. মোহর আলী। এই আশরাফুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল বলে পরবর্তীতে জানা যায়। বুদ্ধিজীবী হত্যার  শেষ অধ্যায়টি শুরু হয় স্বাধীনতার মাত্র ক’দিন আগে ১০ ডিসেম্বর থেকে। এতে প্রথম শিকার হয়েছিলেন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর বার্তা সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন। এর পরপরই নিখোঁজ হতে থাকেন অনেকে। স্বাধীনতার আনন্দ ম্লান হয়ে যায় ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমি আবিষ্কারের পর। এখানে ইটখোলার মধ্যে পাওয়া যায় দেশের অনেক কৃতী সন্তানের লাশ। কারও চোখ হাত বাঁধা, কারও চোখ তুলে নেওয়া, কারও বুক চিরে উপড়ে নেওয়া হয়েছে হৃৎপিণ্ড।

৫ জানুয়ারি মিরপুর গোরস্থানে মাটির নিচে পাওয়া গেলো শ্রী সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক, ড. ফয়জুল মহী, ডা. মুর্তজার লাশ। অন্য তিনটা লাশ ছিল ভয়ানকভাবে গলিত ও বিকৃত, যা শনাক্ত করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আলবদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, সাবেক পিআইর ব্যুরো চিফ ও বিবিসি সংবাদদাতা নিজামুদ্দিন আহমেদ ও চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হকের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

আলী আহসান মুজাহিদ, কামরুজ্জামান ও নিজামী গং নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাদের অভিভাবক ও সহায়ক হিসেবে যারা কাজ করেছে তারা হলো মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, জেনারেল রহিম, জেনারেল জামশিদ, ব্রিগেডিয়ার শরীফ, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ব্রিগেডিয়ার শফি, ব্রিগেডিয়ার বশির, ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ, লে. কর্নেল তাজ, মেজর রিয়াজ, মেজর ইফতেখার, মেজর নাদের পারভেজ, ক্যাপ্টেন তাহির, তৈয়ব আলী, আশরাফুজ্জামান খান, এবিএম খালেক মজুমদার, চৌধুরী মঈনউদ্দিন, ভিসি সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন ও ড. মোহর আলী। এরমধ্যে জেনারেল জামশিদ বিহারিসহ ইপিসিএএফ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। আর ঘাতকদের দলিল এবং আন্তর্জাতিক সংযোগ সুরক্ষা করছিলেন জেনারেল রহিম। যে কারণে তাকে আত্মসমর্পণের একদিন আগে দলিল দস্তাবেজ এবং ঘনিষ্ঠ অনুচরদের নিয়ে কৌশলে একটি বিমানে বার্মায় সরিয়ে নেয় পাকিস্তান ও আমেরিকা যৌথভাবে।

এ প্রেক্ষাপটে ইন্টারপোলের মাধ্যমে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনউদ্দিনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। ইপিসিএএফ সদস্য শতাধিক ঘাতক বিহারিকেও খুঁজে পাওয়া যাবে।

লেখক: ডা. এম এ হাসান – চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ; প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড চিফ সায়েন্টিস্ট, এলার্জি অ্যাজমা অ্যান্ড এনভারনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ। 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ