1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

গণশত্রুদের ওপর অমোঘ ইতিহাসের বজ্রপাত অনিবার্য

অধ্যাপক ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২২

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বিজয় দিবসের আনন্দ ও বেদনায় আমরা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি তিরিশ লাখ শহিদ এবং সম্ভ্রম হারানো আড়াই লাখ নারীর মহান আত্মত্যাগ। স্মরণ করছি স্বাধীনতার মহান স্থপতি বিশ্বরাজনীতির নবতর মানবিক পটভূমি বিনির্মাণের অসাধারণ স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে তিরিশ লাখ শহিদ এবং আড়াই লাখের বেশি নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাঙালির কাক্সিক্ষত বিজয়।

গর্বিত বাঙালি আজ উদযাপন করছে বিজয়ের ৫১তম বার্ষিকী। মহান বিজয় দিবসে আমাদের মনে পড়ে ১৯৭১ সালের মার্চের উত্তাল দিনগুলোর কথা, ৭ মার্চ প্রদত্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দ্বিধাহীনচিত্তে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এদেশের লাখো মানুষ। তাদের রক্তের বিনিময়েই আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক। পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসরদের কাছে শহিদ হয়েছিলেন তিরিশ লাখ তরুণ আর নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন আড়াই লক্ষাধিক নারী।

১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম আজ তারা বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় এদেশের রাজনীতিতে সক্রিয়। অগণিত শহীদের রক্ত আর মা-বোনদের সম্ভ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আজ আমরা যখন বিজয়ের ৫১তম জয়ন্তী উদযাপন করছি তখন পুরোনো শংকা আমাদেরকে পুনরায় পেয়ে বসেছে। আমরা প্রায়শই বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম, সভা-সমাবেশের নামে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের হুংকার শুনতে পাই! বিজয়ের মাসে সেই হুংকার স্বাধীনতাকামী কোনো নাগরিকের কাছেই প্রত্যাশিত নয়।

মূলত ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল- যদিও তা সশস্ত্র রূপ পেতে পক্ষকাল অপেক্ষা করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়েই দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিক, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। দীর্ঘ নয় মাস বাঙালি বীর তরুণেরা বীরত্বের সাথে লড়াই করেছেন। ২৫ মার্চ গভীর রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক এদেশে নির্বিচার গণহত্যা চালায়। নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর এমন হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ‘নিউইয়র্ক টাইমসের’ সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ ঢাকায় অবস্থানের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বিশ্ববাসীকে যে সংবাদ জানিয়েছিলেন তা ছিল এরূপ : ‘৭৫ মিলিয়ন মানুষের পূর্বপাকিস্তান প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কামান ও ভারী মেশিনগান ব্যবহার করছে। [..] কোনো সতর্কিকরণ ছাড়াই বৃহস্পতিবার রাতে আক্রমণ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা, সেনাবাহিনীতে রয়েছে যাদের সংখ্যাধিক্য, প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন শক্ত ঘাঁটি অবরোধের উদ্দেশ্যে। [..] বিদেশী সাংবাদিকরা সকলেই অবস্থান করছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কি ঘটছে বোঝার জন্য বাইরে যেতে চাইলে ব্যাপকভাবে মোতায়েন সেনাপ্রহরীরা তাদের জোর করে ভেতরে ঠেলে দেয় এবং বলে ভবনের বাইরে পা বাড়াবার চেষ্টা নিলে তাদের গুলি করা করা হবে।’ পাকিস্তানিরা শুধু বাঙালি নিধন করেই ক্ষান্ত ছিল না, তাদের অপকর্মের খবর বিশ্ববাসী যেন জানতে না পারে সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে নানা রকমের ফন্দিফিকিরও করেছে। গ্রেপ্তারের শংকা থেকেই ২৫ মার্চ ভোর রাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই দীর্ঘ নয় মাস বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ চলে।

বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্ব বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় শতবর্ষ পূর্বে পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তি কামনায় তাঁর কবিতার মাধ্যমে আবাহন করেছিলেন নায়কোচিত কল্পিত এক নেতৃত্ব। তিনি সমকালীন রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বগুণের অভাব দেখে অনুভব করেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন আরও অধিক প্রজ্ঞাবান, দৃঢ়চিত্ত, দিকনির্দশক নেতৃত্বের। তাই তিনি রচনা করেছিলেন ‘ওই মহানব আসে’। সহস্রবর্ষের আত্মগ্লানি মুছে দেওয়ার জন্য একজন রাজনৈতিক মহামানবের আবির্ভাব ঘটবে এবং তা যে ভারতবর্ষের জন্য একান্ত প্রয়োজন সে কথা গভীরভাবে ভেবেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথের অন্তর্জগত কল্লোলিত হয়ে ব্যক্ত হয়েছিল : ‘ওই মহানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।’

রবীন্দ্রনাথ যখন সম্ভাব্য মহামানবের আগমন-অভ্যুদয়ের এই আশীর্বচন রচনা করেন তখন শেখ মুজিবের বয়স মাত্র একুশ। সেই বয়সেই তাঁর পরিচয় ঘটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের সাথে। মানুষের জন্য তাদের কল্যাণচিন্তা বঙ্গবন্ধুর চিত্তকে অনুপ্রাণিত করেছে। ভারতবর্ষ এবং বিশেষত বাংলার বুকে প্রবহমান ব্রিটিশ অপশাসনের অমানবিক, অন্যায়, শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দৃঢ় মনোবল নিয়েই বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। বাংলার মাঠ-ঘাট, প্রান্তর-লোকালয় যেখানেই মানবতার অপমান আর লাঞ্ছনা সেখানেই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। শৈশব থেকেই তিনি দাঁড়িয়েছেন দুঃখী মানুষের পাশে। অসংকোচে মিশেছেন দুঃখিনী বাংলার হতদরিদ্র মানুষের সঙ্গে। আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি করেছেন শ্রেণি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে। উপলব্ধি করেছেন সেইসব মানুষের বেদনার্ত হৃদয়ের কান্না ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন বাঙালির হাজার বছরের সংস্কার-সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও কালচার। তাই বঙ্গবন্ধুর হৃদয় হয়ে উঠতে পেরেছে বিশাল বিস্তৃত দিগন্তের সমতুল। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘আওয়ামী লীগ’ গঠনের প্রাক্কালে তাই আমরা তাঁর মধ্যে দেখতে পাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। গভীর অনুভূতি দিয়েই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বাঙালির মুক্তির অনিবার্যতা। অনুভব করেছিলেন অপমানে হতমান বাঙালিকে মুক্ত করতে না পারলে ইতিহাসের পাতায় জাতি হিসেবে বাঙালির করুণ পরিণতির এক ব্যর্থ বয়ানই রচিত হবে। বাঙালির শেষ পরিণাম ব্যর্থতার মধ্যে প্লাবিত হতে দেননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এক তেজোদীপ্ত জাতি হিসেবে বাঙালিকে তিনি বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করিয়েছেন। বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে তিনি যে ব্রত গ্রহণ করেছিলেন বয়স আর অভিজ্ঞতার আলোয় তা পরিণত হয়েছে প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস অনন্য উচ্চতায় উদ্ভাসিত। জাতি ও রাষ্ট্রের ইতিহাস যেন তাঁরই নির্দেশে অনিকেত অভিমুখ থেকে যথাযথ উচ্চতায় আলোক-উজ্জ্বল অহংকারে ঠাঁই করে নিয়েছে ন্যায় ও সত্যের চূড়ান্ত গন্তব্যে।

বাংলাদেশ ও বাঙালিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অজস্র গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গান আর প্রবন্ধ সাহিত্যে ‘বাংলাদেশ’ স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয় সামগ্রিক সাহিত্যকর্মে ‘বাঙালি’ শব্দটিকেও নানামাত্রিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতায় বিশ্বের বুকে ‘বাঙালি’ তার নবতর অস্তিত্ব ঘোষণার মাধ্যমে আত্মপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি ঘোষণা করেছিলেন ‘আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ’! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ কবিতাকে তো বঙ্গবন্ধুই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায়ই অভিষিক্ত করেছেন! তাই আমরা বলি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই রবীন্দ্রনাথের কল্পনার সেই ‘মহামানব’। বঙ্গবন্ধুরই আগমনী-ধ্বনিতে মানব অভ্যুদয়ের কলরোল মহাকাশ ব্যাপ্ত করে রবীন্দ্রচিত্তে জয় জয় রবে মন্দ্রিত হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের কল্প-জগতের ‘আমার সোনার বাংলা’কে প্রকৃত সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর যে রাজনৈতিক অভিযান তাও যেন রবীন্দ্রনাথেরই স্বপ্নপূরণের ইংগিতবহ। বাঙালির শাশ্বত স্বপ্ন ও আবেগ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। বাঙালির এই আবেগকে রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি স্থির বিশ্বাসে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে বলেছিলেন ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত না হলে রবীন্দ্রকল্পনার ‘সোনার বাংলার’ শতচ্ছিন্ন ধূলিমলিন অবয়বের পরিবর্তন সম্ভব নয়। সোনার বাংলার বাস্তব রূপ দেখতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভৌগোলিক মুক্তি। রবীন্দ্রচেতনার স্ফূরণ বঙ্গবন্ধুর বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়েছে। বাঙালির কীর্তিমান মহাপুরুষদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু দার্শনিক অভিপ্রায়ের দিক দিয়ে ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ট একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়।

বাঙালির অমর ইতিহাসের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের জনক ও বাঙালি জাতিসত্তা বিনির্মাণের স্থপতি বলে এদেশের মানুষকে তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি নিজেই কেবল উজ্জীবিত ছিলেন এমন নয়- তৃণমূল থেকে মানুষকে জাগ্রত করে তাদেরকেও মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পশ্চাতে এসে তাই দাঁড়িয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ, সাতকোটি বাঙালি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান তিলে তিলে নিজেকে গঠন করেছিলেন। নিজেকে তিনি গঠন করেছিলেন এই ভূখণ্ডের নবতর এক ইতিহাসের জন্মদাতারূপে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা পেয়ে বাংলাদেশ ধন্য, ধন্য হয়েছে বিশ্বমানবের সভ্যতার ইতিহাস। তাই আজ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গর্ব ও অহংকারে মাতোয়ারা বাংলাদেশের ন্যায় সমগ্র বিশ্ব। অমিত অহংকারে আমাদের বক্ষ স্ফীত হয়ে ওঠে এই ভেবে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, আর শেখ মুজিবের এই বাংলায় আমরা জন্মগ্রহণ করেছি। বঙ্গবন্ধুর মতো মহমানবের জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না। সৃষ্টি হতো না এই ভূগোল বাংলার ইতিহাসের নবতর আখ্যান। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসও করতেন দেশবাসীকে- সাধারণ মানুষ আপনজনকে যেমন বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে তারচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন। তাই তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা-তথ্যকে তিনি দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

কিন্তু বাঙালিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অহংকৃত বিশ্বাস ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল ঘাতকেরা। তারা নির্মমতার আরেক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বিশ্বাস-ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে সেদিন সপরিবারে হত্যা করেছিল। এদেশীয় ক্ষমতালোভীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পঙ্কিলতার মধ্যে নিজেদের ডুবিয়ে দিয়ে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তারা দখল করেছিল বটে, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা তারা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল- বইয়ের পাতা, ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি, সিনেমার ফিতা সকল জায়গা থেকে! বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলবার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। আমরা বিস্মিত হই! কতটা প্রতিহিংসা-পরায়ণ হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে উত্তর-প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার এমন অপপ্রয়াস কেউ নিতে পারে! বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলবার সকল প্রকার অপকৌশল বিএনপি-জামায়াত প্রয়োগ করেছিল। সাময়িকভাবে কিছুটা সফল হলেও ‘আখেরে’ তারাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তারাই পরিণত হয়েছে ‘গণশত্রু’ হিসেবে- জাতীয় শত্রু হিসেবে। হত্যাকারীদের প্রকৃত পরিচয়ও জাতির কাছে স্পষ্ট হয়েছে- স্পষ্ট হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিবলয়ের সঙ্গে ক্ষমতালোভীদের আঁতাতের বিষয়টিও। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। হত্যাকারীদেরও ক্ষমা করেনি। বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নানা রকমের কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল তারাই আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। আর মধ্যাহ্নসূর্যের প্রখর দীপ্তির ন্যায় বঙ্গবন্ধুই ভাস্বর।

বর্তমানে দেশে ও বিদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতোপূর্বেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গ্রহণীয় ও বরণীয়। এদেশে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে মুজিব-অনুরক্ত বাঙালির সংখ্যা। ক্রমে এই সত্যই প্রকট হয়ে উঠছে যে, দলমত নির্বিশেষে অচিরেই সকলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুণের কাছে প্রশ্নহীন আত্মসমর্পনে নিজেকে নিবেদন করবে। বাংলাদেশ যদি কারো আত্মপরিচয়ের তীর্থস্থান হয় তবে তার মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রখর দীপ্তি থেকে কেউ নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু যারা এখনো জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করেন না তাদের ওপর অমোঘ ইতিহাসের বজ্রপাত অনিবার্য- কারণ পৈত্রিক পরিচয়হীনেরা কখনো কোনো সমাজেই গ্রহণীয় হয় না, বরণীয় হওয়ার প্রশ্নও ওঠে না।

লেখক : ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম – অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ