1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

কুসংস্কারকে পিছনে ফেলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকে নজর প্রয়োজন

ডা. মুনতাসীর মারুফ : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৩

সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রায় তিন কোটি মানুষ ভুগছে বিভিন্ন মানসিক সমস্যায়। এ বছর জুলাইয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লিখিত জনসংখ্যা আর বুধবার (২৮ ডিসেম্বর, ২০২২) ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য রিপোর্ট ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল ২০২০-৩০’-এর অবহিতকরণ অনুষ্ঠানে মানসিক রোগ বিষয়ে গবেষকদের প্রদেয় তথ্য মেলালে অনুসিদ্ধান্তটি তা-ই দাঁড়ায়। এই তথ্য থেকে দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ব্যাপকতাটুকু বুঝে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ওই অনুষ্ঠানে যে গবেষণাটির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, সেই গবেষণাটি করা হয়েছে ২০১৮-১৯ সালে অর্থাৎ কভিড-পূর্ববতী সময়ে।

প্রায় তিন বছরের কভিড অতিমারির প্রভাবে জীবন ও অর্থনীতির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যও। সারা বিশ্বের মতো নিশ্চিতভাবেই আমাদের দেশেও বেড়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, বেড়েছে মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা।

উদ্বেগজনক এ সংখ্যার পাশাপাশি আরো উদ্বেগজনক যে তথ্যটি পাওয়া গেছে, তা হলো অনূর্ধ্ব-১৮ বছর বয়সী রোগীদের ৯৪ শতাংশ এবং প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের ৯২ শতাংশই রয়ে গেছে চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে। অর্থাৎ মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা পেয়েছে বা নিয়েছে মাত্র ৬ থেকে ৮ শতাংশ মানুষ। বিপুলসংখ্যক মানুষ কী কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগছে বা আক্রান্ত হচ্ছে, কিভাবে মানসিক রোগ প্রতিরোধ করা যায়—এ ব্যাপারে আলোচনা-গবেষণা-পদক্ষেপ যেমন দরকার, তেমনি এরই মধ্যে যারা রোগাক্রান্ত হয়েছে, তারা কেন চিকিৎসা পাচ্ছে না বা তাদের কিভাবে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়—সেদিকটাতেও নজর দেওয়া জরুরি। আলোচ্য গবেষণাপত্রে মানসিক রোগীদের চিকিৎসাবিহীন থাকার যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—মানসিক সমস্যা বা রোগ বিষয়ে কুসংস্কার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট, পর্যাপ্ত সেবার ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি।

এ যুগেও অনেকের কাছেই ‘মানসিক রোগী’ মানে ‘পাগল’, ‘মানসিক রোগ’ মানে ‘পাগলামি’। ‘পাগল’ বলতে তারা বোঝে উলঙ্গ অথবা ময়লা, জীর্ণ, শতচ্ছিন্ন কাপড় গায়ে, রুক্ষ জটপাকানো চুলে পথে পথে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো ভীতিপ্রদ কোনো ব্যক্তি—যে কি না ডাস্টবিন ঘেঁটে খাবার কুড়ায়, অশ্রাব্য গালাগালের তুবড়ি ছোটায়, যখন-তখন তেড়ে ওঠে, আক্রমণ করে ইত্যাদি। ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ বা ‘মানসিক রোগী’ বলতে অনেকের চোখে রোগী বা অসুস্থ ব্যক্তিটির শুধু এ ধরনের চিত্রই ফুটে ওঠে, আদতে যা অজ্ঞতাপ্রসূত। ‘পাগল’ বলতে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে অজ্ঞ মানুষের মানসপটে, মানসিক রোগীদের মধ্যে যারা ‘সাইকোসিস’-জাতীয় রোগে ভোগে তাদেরও শুধু একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সে রকম লক্ষণ-উপসর্গ দেখা যায়। এই ক্ষুদ্র অংশেরও বেশির ভাগ চিকিৎসা নেয় না বা চিকিৎসার আওতায় আসে না বলেই উপসর্গগুলো এই পর্যায়ে পৌঁছায়। সময়মতো যথাযথ চিকিৎসায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর অতটা অবনতি সহজেই রোধ করা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পরিচালিত যে গবেষণাটির কথা বলা হলো তাতে দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ সিজোফ্রেনিয়া রোগের মতো সাইকোসিসে আক্রান্ত, যারা রোগের প্রকৃতির কারণই বুঝতে পারে না তারা মানসিক রোগে আক্রান্ত। বাকি প্রায় ১৭ শতাংশ রোগীর বলতে গেলে সবাই তাদের যে সমস্যা বা কষ্ট হচ্ছে তা নিজেরাই বুঝতে পারে। কিন্তু এই বুঝতে পারা সত্ত্বেও তারা চিকিৎসা নিতে যায় না। কারণ সমস্যা বুঝলেও সেটা যে ‘মানসিক রোগ’ বা মানসিক কারণে সমস্যা তা তারা বুঝতে পারে না। ওই যে মানসিক রোগী মানে তো ‘পাগল’! তারা ভাবে, “আমি তো আর পাগল না! দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকে, কিছু করতে উৎসাহ পাই না, একই চিন্তা বারবার ঘোরে মাথায়, সব কিছুতেই অতিরিক্ত উদ্বেগ; কিন্তু আমি তো ‘পাগল’ না! অথবা রাতের পর রাত, দিনের পর দিন ঘুম আসে না; কিন্তু কোনো ‘পাগলামি’ তো আমি করি না! তাহলে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাব কেন? সাইকিয়াট্রিস্ট বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে তো যাবে ‘পাগল’রা!”

অনেকে আবার তাদের সমস্যাটিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলেও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায় না। মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যাব? মানসিক রোগের হাসপাতালে যাব? লোকে কী বলবে! লোকে তো ‘পাগল’ ভাববে! ‘পাগল’ অভিধায় মানসিক রোগী যেন সমাজে অচ্ছুত, তার পরিবার যেন একঘরে। শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য পরিবার বা সমাজে যতটা আন্তরিকতা দেখা যায়, মানসিক রোগে তা মোটেও দেখা যায় না। বরং মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারকে করুণার চোখে, হেয় করে দেখার প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। এ জন্য ‘পাগল’ আখ্যায় সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তিই চিকিৎসকের কাছে যায় না, পরিবারও তাকে চিকিৎসা না করিয়ে ব্যাপারটি গোপন রাখতেই তৎপর হয়।

মানসিক রোগ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায় না অনেকে। গায়েবি আওয়াজ শোনা, ভ্রান্ত বিশ্বাস, অহেতুক সন্দেহ, আচরণের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, কনভার্সন ডিস-অর্ডার (যা হিস্টিরিয়া বা মূর্ছারোগ নামেই বেশি পরিচিত)-এর উপসর্গগুলোকে জিন-ভূতের আছর, জাদুটোনা-তাবিজ-আলগা বাতাসের প্রভাব বলেই বিশ্বাস করে অনেকে। নিকটজন এসব সমস্যায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসাও করায় তেলপড়া, পানিপড়া, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, শিকল বা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে। অনেকের কাছে মানসিক রোগের উপসর্গগুলো ‘বয়সের দোষ, বিয়ের জন্য টালবাহানা, ঢং বা ভং ধরা। ’ বিয়ে করানোই তাদের কাছে এর ‘চিকিৎসা’। কখনো কখনো শারীরিক উপসর্গ যে মানসিক রোগের কারণে হতে পারে তা-ও অনেকে মানতে চায় না। ফলে নেপথ্যের মানসিক সমস্যা বা কারণের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শারীরিক রোগের চিকিৎসকের কাছেই বারবার যেতে থাকে তারা।

অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারটিও মানতে হবে যে আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা এবং চিকিৎসাসেবা দানে সক্ষম দক্ষ, বিশেষজ্ঞ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশলের অবহিতকরণ অনুষ্ঠানটিতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) রয়েছেন মাত্র ৩৫০ জন, আর মনোবিজ্ঞানী (সাইকোলজিস্ট) ৫০০ জনের কিছু বেশি। সরকারি পর্যায়ে মানসিক রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৫০০ শয্যা এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ৪০০ শয্যা রয়েছে (তথ্য সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২)। এর বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগ এবং কিছু সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগে ভর্তি রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এসব বিভাগে সাইকিয়াট্রিস্টের পাশাপাশি সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিক নার্স, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কারসহ অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সংকট তীব্র। অপ্রতুল প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহও।

আশার কথা, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে বর্তমান সরকার গুরুত্ব দিয়েই অনুধাবন করেছে। জনগণের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে গত কয়েক বছরে প্রণয়ন করা হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল অ্যাক্ট, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিস-এবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্টসহ মানসিক স্বাস্থ্যবান্ধব নানা আইন ও পরিকল্পনা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল ২০২০-৩০। ’ তবে দেশের মানুষের সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে শুধু সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়, নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক রোগীদের ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার শিক্ষা শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই।

লেখক : ডা. মুনতাসীর মারুফ – সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ