1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বাংলাদেশ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র

সেলিমা কাদের চৌধুরী : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে যেসব অনুষঙ্গ ক্রিয়াশীল ছিল তার মধ্যে প্রধান ও অন্যতম হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। তাহলে বর্তমান সময়ে স্বাধীন দেশে হঠাৎ কেন ইসলাম ধর্মীয় ভাবধারার পুনরুত্থান ঘটছে? ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ– এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম।

স্বাধীন দেশে যে সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত হয়েছিল তাতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং সব ধরনের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে দীর্ঘ সময় সামরিক শাসন কায়েম ছিল। সে-সময়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাত ধরে ইসলাম ধর্মীয় ভাবধারার ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে এ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনাচরণে। তবে ইসলাম ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে মৌলবাদের যে উত্থান এ দেশে ঘটেছে, তার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় সবসময়ই সচেষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার। নানা পরিবর্তন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে এই সময়ে এসে বাংলাদেশের সংবিধানে যে বৈপরীত্য লক্ষণীয় সেখানে ইসলাম ধর্মের মুখোমুখি করে দেওয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাকে। ফলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ যে চরিত্র ছিল তার অনেকটাই আজ ক্ষুণ্ন।

প্রশ্ন হলো, মূলধারার রাজনীতিতে ইসলাম ধর্মের কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার অন্তরায় কোথায়? কোনও ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ নয়, বরং প্রতিটি ধর্মকে যার যার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব হিসেবে বিবেচনা এবং ধর্মীয় আচার-ব্যবহারকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করাই একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চরিত্র।

বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার বাধাসমূহ নিরূপণের জন্য এই ভূখণ্ডের রাজনীতিতে ইসলামি ভাবধারার পুনরুত্থান এবং সে কারণে রাষ্ট্র যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে, তা অতিক্রমের পথ খুঁজে বের করা এখন অত্যাবশ্যক বলেই প্রতীয়মান।

এ দেশের সমাজব্যবস্থার সর্বত্র ইসলামি ভাবধারার ব্যাপকভিত্তিক পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে নব্য উপনিবেশবাদের ছায়া আজ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উপনিবেশ-উত্তর তত্ত্ব অনুসারে, ঔপনিবেশিক শাসকদের থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরও উপনিবেশ-উত্তর সাম্রাজ্যে ঔপনিবেশিক প্রভাব অব্যাহত থেকে যায়। এ বিষয়ে সমাজ-বিশ্লেষক ও তাত্ত্বিক ফ্রানৎস ফেননের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ঔপনিবেশিক শাসনামলে যে মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গড়ে ওঠে, তারা উপনিবেশ-উত্তর সমাজে অধিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে। কারণ হিসেবে ফেনন বলেন, এই দুই শ্রেণি তাদের ঔপনিবেশিক প্রভুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজ ভূমিতে শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ-নিপীড়ন করার পাশাপাশি দুর্নীতির ধারা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে।

ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম থেকে জানা যায়, অখণ্ড ভারতবর্ষে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বি-জাতি তত্ত্বের উদ্যোক্তা মুসলিম লীগ। ধর্মভিত্তিক এই দলটি মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু-মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতের মুসলমানদের জন্য একটি মুসলমান-অধ্যুষিত ভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের এটিই ছিল মূল কারণ এবং এর চূড়ান্ত পরিণতিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম। ভারতকে মাঝখানে রেখে পূর্ব ও পশ্চিম অংশ নিয়ে গঠিত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বাঙালিরা। তাদের আশা ছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্রে তারা হিন্দু-অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশের শাসন ক্ষমতায়ও অধিষ্ঠান লাভ করবে, যেহেতু তার সংখ্যাগরিষ্ঠ; কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। উল্টো বাঙালিদের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নিদারুণ শোষণের শিকার হতে হয়।

এদিকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এবং সরকার গঠনের প্রাক্কালে বাঙালিদের কোনোরূপ অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়নি পাকিস্তানি শাসকরা। শুধু তা-ই নয়, দেশের সেনা ও সরকারি পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সব পদও তারা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। উপরন্তু, তারা চেষ্টা চালিয়েছিল বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ইসলাম ধর্মের নামে বিজাতীয় এক সংস্কৃতি দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে।

এ প্রসঙ্গে মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর জানান, যদিও পাকিস্তানের মতাদর্শ ছিল ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক, কিন্তু রাষ্ট্রের কোথাও এই ধর্মের মূলনীতির চর্চা ছিল না। এর পরিবর্তে সমাজের গভীরে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকড় বিস্তার লাভ করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাত শ্রেণি ধর্মকে ব্যবহার করতে থাকে মেহনতি শ্রেণিকে, বিশেষ করে বাঙালিদের, অবদমিত করে রাখার জন্য। এই অপপ্রয়াস আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতার মধ্য দিয়ে। ইসলাম ধর্মের নীতি অনুসারে কোনও ভাষাই বিশেষ কোনও মর্যাদাপ্রাপ্তির দাবিদার নয়; কিন্তু পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির ভাষা ছিল উর্দু। তাই তারা সেই ভাষাকেই বাঙালিদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, বাংলা ভাষাকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে।

মূলনীতি ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে যেকোনও সংস্কৃতিকেই স্বাগত জানিয়ে থাকে উদারনৈতিক ধর্ম ইসলাম। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করা পাকিস্তানি শাসকদের কর্মকাণ্ড ও আচরণের মধ্যে এই নীতির কোনও প্রতিফলন তো ছিলই না, উল্টো তারা বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির ওপরও চড়াও হয়েছিল। তারা বাংলা ভাষাকে এমনকি আরবি হরফে বদলে দেওয়ারও চেষ্টা করেছিল। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নববর্ষ উৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’ পালন নিয়ে চরম বৈরী মনোভাব পোষণ করতো পাকিস্তানি শাসকরা। শুধু তা-ই নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, কবিতাসহ সব ধরনের সাহিত্যকর্মের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল পাকিস্তানের বেতার ও টেলিভিশনে। বাংলা সংস্কৃতির প্রতি এমন হীন-নেতিবাচক আচরণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কঠোর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এছাড়া তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বাঙালি সংস্কৃতি মূলত নিম্ন শ্রেণির হিন্দু জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে আহরিত। তাই বাংলা সংস্কৃতির কোনও অনুষঙ্গ ইসলামি ভাবধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলেও শাসকগোষ্ঠী কখনোই তা সুনজরে দেখেনি। বরং পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাত শ্রেণি বরাবরই তাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।

পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটেছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বোধ থেকে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সাংস্কৃতিক দমননীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বোধ ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে উন্মেষ ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। ধর্মনিরপেক্ষতা, ভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের এবং বিশেষ করে মুসলমানদের ভেতর গড়ে উঠেছিল, তা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে তাদের উদ্বুদ্ধ করে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার পাশাপাশি সব ধরনের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চর্চার পুনরুত্থান পরিলক্ষিত হয়। আগেই বলা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল পূর্ব পাকিস্তানে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। কিন্তু সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সেই ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’কে সংবিধান থেকে মুছে দিয়ে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ নামক নতুন শব্দমালা যুক্ত করেন, যা সে সময় নতুন জাতীয় আদর্শ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কথাটি তুলে দিয়ে তার পরিবর্তে যুক্ত করেন ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা’। তাঁর পথ ধরে আরেক সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে ‘ইসলাম’কে দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদে গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল ভাষা, আঞ্চলিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির ওপর। কিন্তু বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা ছিল ভিন্ন। সেখানে ভাষা ও আঞ্চলিকতা থাকলেও এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ইসলাম ধর্ম ও ভারতবিদ্বেষী মনোভাবকে এবং এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলে যে ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের, মানুষদের থেকে বাংলাদেশিরা একেবারেই আলাদা। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তত্ত্বে কখনও সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আদিবাসীদের স্বীকার করা হয়নি।

উপনিবেশ-উত্তর বাংলাদেশে সেনাশাসনকালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় দেশ শাসনের ক্ষেত্রে ‘ইসলাম’ একটি শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে সময় ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ‘মুসলমান পরিচয়ে’র ব্যাপক জাগরণ ঘটে, যেমনটি লক্ষ করা গিয়েছিল পাকিস্তান আমলে। ফলে আরও একবার এটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে যে বাংলাদেশের তৎকালীন শাসকশ্রেণি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের মতোই জনসাধারণের ওপর প্রয়োগের জন্য শোষণমূলক নানা কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করবে এবং বাস্তবে ঘটেছেও তাই। এ বিষয়ে আগেই উপনিবেশ-উত্তর বিষয়ক তাত্ত্বিক ফ্যানৎস ফেননের মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে।

‘বাংলা সংস্কৃতি, ভাষা, লোকসাহিত্য ও অন্যান্য’ বিষয় নিয়ে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গঠিত তা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদেরও সংস্কৃতি। রাজনীতিতে ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্তি এবং ভারতবিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে গঠিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতি একটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়, যা মনে করিয়ে দেয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালি সংস্কৃতি মুছে দেওয়ার নানা প্রচেষ্টাকে। পাকিস্তান আমলে ইসলাম ধর্মের নামে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নস্যাতের যে প্রয়াস লক্ষ করা গিয়েছিল, জেনারেল জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনামলে, সেটাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসানের মতে, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দৃষ্টিতে ইসলাম ছিল অবৈধ শাসন বৈধকরণের উপাদান।’

সমাজে ইসলামি আদর্শ ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নানা বেসরকারি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও, যেমন– মাদ্রাসা (যেখানে মূলত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়), মসজিদ এবং তাবলিগ জামাত (স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী, যারা ইসলামি জীবনব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারণা এবং তত্ত্ব প্রচার ও প্রসারে নিবেদিত), সে সময় নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও বাংলাদেশের জনগণের মনে ধর্মীয় পরিচিতির বিষয়টি ভালোভাবে গেঁথে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং ধর্মীয় নেতা বা ওলামারা।

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর মধ্যে প্রধানতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। সে সময় সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা ছিল সব ধর্মের প্রতি সম-মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন তার ভুল ব্যাখ্যা করেছিল বেশিরভাগ মানুষ। তাদের অনেকের কাছে মনে হয়েছিল, তাঁর পদক্ষেপ হচ্ছে রাষ্ট্রকে অনৈসলামিককরণের প্রক্রিয়া। ফলে এর বিরুদ্ধে দ্রুত নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছিল। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ও অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইদুলের মতে, মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি-আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হলেও বেশিরভাগ মানুষ এ বিষয়টি সম্পর্কে ততটা সচেতন ও অবগত ছিল না। তারা মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে মুক্ত করার জন্য। বাংলাদেশে এখনও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইসলাম পরিপন্থী হিসেবে অনেকে বিবেচনা করে।

২০১০ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করলেও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে থেকে গেছে ‘ইসলাম’। কারণ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায়নি রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’কে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামের মধ্যে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা রয়েই গেছে। তবে পরিপ্রেক্ষিত যা-ই হোক না কেন, আমাদের উপলব্ধি করা আবশ্যক কেন আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ-বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে নানা চড়াই-উতরাইয়ের সম্মুখীন হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।

সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে এদেশে মৌলবাদ ও ইসলামিকরণের যে উত্থান ঘটেছিল তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তারা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ইসলামি মূল্যবোধ ও আদর্শের নানাবিধ প্রয়োগ সম্পর্কে জনগণকে উৎসাহী করার পাশাপাশি তাদের ইসলামি আচার-আচরণ ও ধ্যান-ধারণা চর্চায় অনুপ্রাণিত করেছে। সে সময় যুক্তি নয়, মানুষকে পারলৌকিক সুখ-শান্তির কথা বলে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা লক্ষণীয়।

এদিকে কট্টরপন্থী কিছু ওলামাদের উত্থান ও মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার রাজনীতিকে ইসলামিকরণে উৎসাহ জোগাতে থাকে। তার ফলে ইসলামি-পরিচিতির দিকে ঝুঁকে পড়ে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এবং জাতিগত ও অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীদের সঙ্গে ইসলাম বিশ্বাসীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। উনিশ শতকে ঠিক এভাবেই বাঙালি মুসলমান ইসলামি ভাবধারার পুনরুজ্জীবনকেন্দ্রিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল।

ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে কিছু মানুষ ‘বিশ্বাসে’র মূল অনুষঙ্গগুলো থেকে বহুদূরে সরে গিয়ে নিমজ্জিত হয়েছে অথৈ অন্ধকারে। এতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে জনসাধারণের, বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের, ব্যক্তিত্বের বিকাশ। কার্যত এসব পাঠ্যসূচি প্রণীত হওয়া উচিত ইসলামি মূল্যবোধ ও মৌলিক মতবাদের ভিত্তিতে। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ মাসুদা বানু বলেছেন, ইসলামি যুক্তিবাদ মূলত সুন্নি মুসলমানদের বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর বিস্তার মুসলমানদের প্রাচীন ধর্মীয় কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে ইসলামের মূল্যবোধ ও সত্য-অন্বেষণে আগ্রহী করে তোলে। একইসঙ্গে সামাজিক অনেক সমস্যা সমাধানেরও পথ দেখায়। মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্মীয় সভা-সমাবেশে নানা বক্তব্য-বিবৃতি ও গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা জনসাধারণের মধ্যে ইসলামি যুক্তিবাদের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটিয়ে ধর্ম সম্পর্কিত কাল্পনিক ও অযৌক্তিক চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে সন্দেহাতীতভাবে। এ ধরনের পদক্ষেপ সামাজিক-সচেতনতাকে উৎসাহিত করবে। শুধু তা-ই নয়, জনসাধারণকে ইসলামের মূলনীতিগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া গেলে ব্যক্তিত্বের উন্মেষের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।

ইসলামি সংস্কারক ও চিন্তাবিদ সৈয়দ আহমেদ খানের দৃষ্টিতে, উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের পশ্চাৎমুখী যাত্রার অন্যতম কারণ ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি। আমরা যদি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি, তবে দেখতে পাবো, ‘অনৈসলামিক’ আখ্যা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ থেকে মানুষকে সরিয়ে আনা হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, ব্যক্তি ও সমাজ-জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের যে ইতিবাচক বিস্তৃতি ঘটেছিল তাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। আরবীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আলিয়াব্দ আল-রাজিকের ভাষ্য অনুসারে, ‘মানুষ-আবিষ্কৃত নতুন নতুন মতবাদ ও বিভিন্ন দেশের নানামুখী অভিজ্ঞতার আলোকে নব্য রাজনৈতিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় কখনোই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি ইসলাম ধর্মে।’ ফলে এটা সহজেই অনুমেয়, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামের মূলনীতিগুলো বরাবরই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে যুক্তিবাদ ও যুক্তি। এর অর্থ হলো, ইসলামি যুক্তিবাদের আলোকে সাধারণ মানুষের এই ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়া যে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় এবং ধর্ম ও রাজনীতির বিভক্তি রাজনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে থাকে।

পরিশেষে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে ইসলামিকরণের উত্থান এবং ধর্মনিরপেক্ষকরণে সৃষ্ট বাধার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় ক্রিয়াশীল। সামরিক শাসকরা তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য ইসলামকে ব্যবহার করেছে, যেমনটা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। এর মধ্য দিয়ে ‘উপনিবেশ-উত্তর তত্ত্ব’ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

নিজের স্বার্থের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠানও ইসলাম ধর্মের প্রতি সাধারণ মানুষের আনুগত্যকে কাজে লাগিয়েছে। অতি বিশ্বাস এবং ইসলাম সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞানের কারণে মানুষ অজ্ঞানতাকে আঁকড়ে ধরেছে। এতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের ধারণা।

তবে মাদ্রাসা শিক্ষা, ওলামাগণের সঠিক বক্তব্য-ব্যাখ্যা এবং গণমাধ্যমের ইসলাম সম্পর্কিত সঠিক প্রচার-প্রচারণাই পারে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ার পথে বড় ভূমিকা রাখতে। ইসলাম ধর্মের মূলনীতির আলোকে যথাযথ শিক্ষা মানুষকে মৌলিক ন্যায়বিচার বিষয়ে জ্ঞান ও বিশ্বাস অর্জনে সর্বতো সাহায্য করতে পারে। এই শিক্ষা মানুষকে মৌলবাদিতা ও জ্ঞানশূন্য অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর দিকে ধাবিত করবে। একই সঙ্গে তারা বুঝতে সমর্থ হবে যে মানবতার কল্যাণের জন্যই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পৃথকীকরণ অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: সেলিমা কাদের চৌধুরী – শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ