1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও পরিসমাপ্তি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

ভাসানী জানতেন যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে দর-কষাকষির মাধ্যমে পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করা যাবে না, ওই কাজের জন্য আন্দোলন ভিন্ন অন্য কোনো উপায় নেই।

দ্বিতীয়ত, তাঁর লক্ষ্য ছিল মেহনতি মানুষকে মুক্ত করা; সেটি তো গোলটেবিলের আলোচ্যসূচিতে ছিল না।

ফিরে যাই উনসত্তরের ২৪ জানুয়ারিতে। সেদিন যা ঘটেছিল তাকে গণ-অভ্যুত্থান বলাটা মোটেই বাড়িয়ে বলা নয়। কিন্তু তবু সেটি অসম্পূর্ণই ছিল; কেননা তার লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়নি। ১১ দফা বাস্তবায়িত হয়নি, এমনকি দুঃসহ স্বৈরশাসনেরও অবসান ঘটেনি। এরপর কী ঘটবে তা তখনকার ঘটনার সঙ্গে জড়িতরাও আন্দাজ করতে পারেননি; ছাত্ররা পারেনি, রুশপন্থীরা পারেননি। অন্যদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি ধারণা করা। তবে ইতিহাস বলছে যে এই অভ্যুত্থান প্রসারিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত।

২৪ জানুয়ারির পরে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। কুর্মিটোলায় আটক অবস্থায় শহীদ হন আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং তারপরেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শহীদ হন প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহা, উভয় ক্ষেত্রেই সেনাসদস্যদের গুলিতে। ১৬ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী পল্টনের এক বিশাল জনসভায় ভাষণে বলেন, প্রয়োজনে লাখো জনতা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে শেখ মুজিবকে বের করে আনবে; বাস্তিলের দুর্গের মতো ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটবে। ঢাকা শহর মিছিল, বিক্ষোভ, ঘেরাও, ধর্মঘটের শহরে পরিণত হয়। একপর্যায়ে টানা দুই দিন কারফিউ বলবৎ ছিল। কিন্তু জনতা মানেনি। ১৮ ফেব্রুয়ারি কারফিউ অমান্য করে রাতের অন্ধকারেই মগবাজার ও খিলগাঁওয়ে শত শত মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছিল, তাদের গুলিতে কয়েকজন প্রাণ হারান। ভাসানীর পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়ে বলা হয় যে কারফিউ তুলে না নিলে পরের দিন তিনি তা ভঙ্গ করবেন। পরের দিন কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল। এসব ঘটনার পরে আইয়ুব খান সুর নরম করতে বাধ্য হন। প্রথমে বলেছিলেন বিরোধী দলের দায়িত্বশীল লোকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি আছেন; পরে আরও নরম হয়ে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন এবং ‘ডাক’-এর নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহকে বলেন কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে, তা ঠিক করতে। আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীন আহমদকে কারামুক্ত করা হয়, যাতে তিনি গোলটেবিলে যোগ দিতে পারেন। আরও কয়েকজন রাজবন্দী মুক্তি পান। আইয়ুব খান ঘোষণা দেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আর প্রার্থী হবেন না। অনেকটা মাফ চাওয়ার মতোই ব্যাপার ছিল সেটা। শেখ মুজিব প্রথমে রাজি হয়েছিলেন প্যারোলে গোলটেবিলে যেতে; পরে বাইরের পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক আবহাওয়া সম্পর্কে অবহিত হয়ে এবং আপনজনদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেন মুক্ত না হলে তিনি কোনো বৈঠকে যাবেন না। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় ২২ ফেব্রুয়ারিতে; আগরতলা মামলাও তুলে নেওয়া হয়, অভিযুক্তরা সবাই মুক্তি পান।

২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে গণসংবর্ধনা জানানো হয়, রেসকোর্স ময়দানে। আয়োজন করে এককভাবে ছাত্রলীগই, সহযোগিতা ছিল আওয়ামী লীগের। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একাংশের প্রস্তাব ছিল মওলানা ভাসানীকেও সংবর্ধনা জানানো হোক, আরেকাংশ চাইছিল মণি সিংহকেও সংবর্ধনা জানাতে; আগরতলা মামলার মুক্তিপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের কথাও উঠেছিল; কিন্তু ছাত্রলীগ অনড় থাকে। তাদের বক্তব্য, প্রথমে মুজিব ভাইকে সংবর্ধিত করা হবে, তারপর অন্যদের জন্য পৃথক আয়োজন করা যাবে।

বলা বাহুল্য তেমন আয়োজন আর করা সম্ভব হয়নি। ঐক্য ভেঙে যাবে—এমন শঙ্কা দেখা দেওয়ায় অন্যরা ছাত্রলীগের উদ্যোগকে মেনে নেয়, তবে শর্ত থাকে যে সংবর্ধনা সভায় বলা হবে যে ১১ দফার ব্যাপারে মুজিব কোনো আপস করতে পারবেন না।

সংবর্ধনা সভায় বিপুল জনসমাবেশ ঘটে। শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়, যে ব্যাপারে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কোনো পূর্বসিদ্ধান্ত ছিল না। উদ্যোগ ছিল এককভাবে ছাত্রলীগেরই। সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন ১১ দফা তাঁরও দফা এবং এ ব্যাপারে কোনো আপস তিনি করবেন না, প্রয়োজনে আন্দোলন করে আবারও জেলে যাবেন। তিনি বললেন, ১১ দফা আদায়ের জন্যই তাঁর গোলটেবিলে যোগ দেওয়া দরকার এবং জনসভা থেকে এ ব্যাপারে তিনি ম্যান্ডেটও পেয়ে গেলেন। যেটির প্রয়োজন ছিল।

২৪ জানুয়ারিকে গণ-অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নিজেদের জন্য যে কর্তব্যগুলো স্থির করেছিল, সেগুলোর মধ্যে ১ নম্বরে ছিল, ‘প্রদেশের সকল জেলা, মহকুমা, থানা, গ্রাম, মহল্লাসহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং প্রত্যেক শ্রমিক অঞ্চলে সর্বদলীয় ছাত্রসমাজের উদ্যোগে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা।’

এরপর ৯ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সারা দেশে যে শপথ দিবস অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ঢাকা শহরে লোক জমায়েত হয়েছিল দুই লাখের বেশি। সেই সমাবেশেও সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ২৩ ফেব্রুয়ারির গণসংবর্ধনার পর ওই সর্বদলীয় তৎপরতাটা আর রইল না। এক দলের, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের রাজনীতিই প্রধান হয়ে উঠল। স্মরণীয় যে সাতই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণেও বঙ্গবন্ধু গ্রামে, মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তবে নেতৃত্ব যে থাকবে আওয়ামী লীগের, তার স্পষ্ট উল্লেখ ছিল।

গণমানুষের মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল জাতীয় স্বাধীনতার ওই সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের দিকে, অর্থাৎ সামাজিক বিপ্লবের অভিমুখে নিয়ে যাওয়ার। সে কাজ আওয়ামী লীগের করার কথা নয়; করার দায়িত্ব বামপন্থীদের। কিন্তু হায়, তাঁরা সেটা করতে চাইলেন না।

এরপর আন্দোলনে আর তেমন একটা প্রাণ থাকেনি। মুজিব মুক্ত হয়েছেন, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, গোলটেবিলে আইয়ুব খান আরও ছাড় দেবেন—এমন আশার সঞ্চার ঘটেছে। সেই আশা পূরণ না হলেও ছাত্রলীগ তাদের লক্ষ্যের বেশ কিছুটা অর্জন করতে পেরেছে বৈকি।

ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে প্রথমে প্রবল আওয়াজ এসেছিল, ‘গোলটেবিলে যাবে যারা আইয়ুবের দালাল তারা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ এবং ‘গোলটেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’। পরিস্থিতি তখন কিছুটা অন্য রকম ছিল; মুজিব তখনো মুক্তি পাননি, আগরতলা মামলা চালু আছে। ২৩ ফেব্রুয়ারির পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গোলটেবিল আর অতটা অগ্রহণযোগ্য রইল না। এর কারণ যে শুধু ছাত্রলীগের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন তা নয়, রুশপন্থীদের প্রসিদ্ধ আপসকামিতাও পেছনে কাজ করেছে বটে।

তাঁরা বললেন, গোলটেবিল একটা বিজয়, এই বিজয়কে আরও সংহত করার জন্য আলোচনায় যোগ দিয়ে স্বায়ত্তশাসনসহ ১১ দফার দাবিকে দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরা দরকার।

গোলটেবিলের ব্যাপারে তাঁদের সম্মতির একটি অতিরিক্ত কারণও ছিল, সেটি হচ্ছে ওই বৈঠকে যোগ দিতে ভাসানীর অসম্মতি। ভাসানী যে কোনো ভালো কাজ করতে পারেন না, ওই সময়ে এটা তো ছিল রুশপন্থীদের জন্য স্বতঃসিদ্ধ। ভাসানী কেবল যে বৈঠকে যেতে অসম্মতি জানালেন তা-ই নয়, গোলটেবিল বয়কট করার আওয়াজও তুলেছিলেন।

গোলটেবিলের পরিণতি কী দাঁড়ায়, সেটা তো ব্রিটিশ আমলেই তিনি দেখেছেন, দেশভাগের মধ্য দিয়ে। ভাসানী জানতেন যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে দর-কষাকষির মাধ্যমে পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করা যাবে না, ওই কাজের জন্য আন্দোলন ভিন্ন অন্য কোনো উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, তাঁর লক্ষ্য ছিল মেহনতি মানুষকে মুক্ত করা; সেটি তো গোলটেবিলের আলোচ্যসূচিতে ছিল না। গোলটেবিলে যোগ দেওয়ার বিরোধিতায় তাই তিনি অনড় ছিলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েও গোলটেবিলের বিরুদ্ধে বলেছেন। সে সময়ে আরও একটি জরুরি বক্তব্য তাঁর ছিল, সেটা হলো জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আবশ্যকতা। এর একমাত্র কারণ তারা যে তাঁকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল সেটা নয়, মূল কারণ তিনি জানতেন জামায়াতিরা ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে বিপথগামী করবে এবং মেহনতিদের স্বার্থের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে কাজ করে যাবে।

ভাসানী যা আশঙ্কা করেছিলেন, সেটাই ঘটেছে। গোলটেবিলে ততটাই অর্জিত হয়েছে আইয়ুব খান যতটা দিতে সম্মত ছিলেন; অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং সংসদীয় সরকার। লাভ হয়েছে আইয়ুব খানের, তিনি নিরুপদ্রবে প্রস্থানের পথ পেয়ে গেছেন; লাভ হয়েছে ঔপনিবেশিক পাঞ্জাবি শাসকদের, পূর্ববঙ্গে তারা গণহত্যা ঘটাতে পেরেছে।

ক্ষতি হয়েছে আন্দোলনের। আন্দোলন থেমে গেছে। কেবল থামেনি, বিভক্তও হয়ে গেছে এবং বিভ্রান্ত হয়ে চলে গেছে নির্বাচনের দিকে।

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ