1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ

ড. আতিউর রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০২৩
ড. আতিউর রহমান

চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও যে বাংলাদেশ জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে তা নতুন করে অনুভব করলাম। ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘স্মার্টভার্স’ শিরোনামে বেসিস আয়োজিত ‘সফট এক্সপো ২০২৩’-এর একটি অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম। পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল আসলেই এক চৌকস বাংলাদেশের পথেই আমরা এগোচ্ছি। চওড়া মসৃণ রাস্তা। আন্ডারপাস। নির্মাণাধীন সড়ক ডিভাইডার। দুই পাশে এখনো স্থাপনা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আধুনিক সুবিশাল সড়কে চলমান গাড়িতে বসে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ মোটেও বসে নেই। অনেকটাই উন্নত দেশের হাইওয়ের মতো। পদ্মা সেতু পেরিয়ে ভাঙ্গার পথে যাওয়ার সময় একই অনুভূতি হয়। রাতের সবুজ উজ্জ্বল রাজশাহী ঘুরতে বেরিয়ে একই অনুভব আমার মনকে সতেজ করেছিল। পূর্বাচলের অবকাঠামো যেভাবে গড়ে উঠছে তাতেই মনে হয় এক নতুন স্মার্ট ঢাকার সন্ধান আমরা অচিরেই পাব। শুরুতে রাস্তাঘাটই উন্নত করতে হয়। এরপর এসবের আশপাশে উপযুক্ত বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্থাপনা গড়ে উঠবেই। অনেক আধুনিক শহর বা শহরতলি এভাবেই বেড়ে উঠেছে। কলকাতার নিউটাউন যখন গড়ে উঠছিল তখনো এমনটিই মনে হচ্ছিল। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে মূল শহরে যাওয়ার সময় দুর্গন্ধময় যে পথে মুখে রুমাল না দিয়ে যাওয়া যেত না সেই পথ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্মিত হয়েছে বিশাল উড়াল সড়ক। দুই পাশে আধুনিক সব হোটেল ও অফিস স্থাপনা। বিশেষ করে নিউটাউনে আন্তর্জাতিক মানের আইসিটি শিল্পের নানা অফিস গড়ে উঠেছে। আমার বিশ্বাস, একটু সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারলে আমাদের পূর্বাচলেও এমন আধুনিক চৌকস নগরায়ণ সম্ভব। তা যে সম্ভব সেটা টের পেলাম সেমিনার ভেন্যুতে গিয়ে। কী বিশাল আয়োজন! তরুণদের মুখর পদচারণ। চোখেমুখে কিছু একটা করার ছাপ স্পষ্ট। সাধারণের চলাচলের জন্য উপযুক্ত পরিবহন কাঠামো এই মুহৃর্তে গড়ে না উঠলেও আগামী দিনের ডিজিটাল উদ্যোক্তারা সব চ্যালেঞ্জ পায়ে দলে যেভাবে বেসিসের ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। নিশ্চয় গড়ে উঠবে স্মার্ট পূর্বাচল।

আমাদের নেতৃত্বের পরম্পরায় আশা করার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার এক অসামান্য ঐতিহ্য রয়েছে। আমাদের জাতির পিতা সদ্যঃস্বাধীন দেশের উন্নয়ন নিয়ে খুবই আশান্বিত ছিলেন। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েই তিনি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন। আর পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের মাটি তাঁর রক্তে ‘উর্বর হয়েছে’। ‘তাঁর রক্তে সব কিছু সবুজ হয়েছে।’ এই তিনিই জাতিসংঘে তাঁর আশা-জাগানিয়া ভাষণে বলেছিলেন যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসামান্য উন্নতির এই যুগে মানবসভ্যতা বিপুল সাফল্যের সুফল পাবে। এমন স্পষ্ট করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মানবকল্যাণধর্মী অগ্রগতির কথা কয়জন রাষ্ট্রনায়ক বলতে পারতেন। তাঁর এই সাহসী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ খানিকটা দূর করা গেছে বলা চলে। ‘লক্ষ্য ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমরা যে কি আশা করিতে পারি, তাহা বেশ মোটা লাইনে বড়ো রেখায় দেশের কোথাও আঁকা নাই। আশা করিবার অধিকারই মানুষের শক্তিকে প্রবল করিয়া তোলে।’ নিঃসন্দেহে আশার অভিমুখে যাত্রাই একটি জাতির বড় সম্পদ। সেটিই সত্যিকারের উন্নয়ন অভিযাত্রা। সেই সম্পদের উৎস আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু জানতেন এই বাংলাদেশ একসময় পৃথিবীর অন্যতম ধনী অঞ্চল ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপে সেই সোনার বাংলা নিঃশেষ হয়ে যায়। তাইতো তিনি ঐশ্বর্যমণ্ডিত সেই বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনার সোনালি অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন বারবার। আজ তাঁর সেই আশার অধিকারকে আরো বিস্তৃত করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ স্লোগান দিয়ে ২০০৯ সাল থেকে তিনি আধুনিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। পুরো বাংলাদেশকে উন্নত অবকাঠামোর জালে বেঁধে ফেলার পাশাপাশি তাঁর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ তথ্য-প্রযুক্তির প্রসারে সত্যি সত্যি বিপ্লব ঘটিয়েছে। তাইতো তরুণ প্রজন্ম ডিজিটাল উদ্যোক্তা হওয়ার এক অভাবনীয় প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসারে চাই আর্থিক লেনদেন। চাই সার্ভিস ডেলিভারির জন্য উপযুক্ত তথ্য-প্রযুক্তি অবকাঠামো। হাই স্পিড ইন্টারনেট। চাই সাবমেরিন কেবল। সাইবার হাইওয়ে। চাই ফাইবার অপটিক কেবল এবং ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক। চাই কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান স্যাটেলাইট। এসবেরই প্রসার ঘটিয়েছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সরকার বিগত দেড় দশক ধরে। তৃতীয় সাবমেরিন কেবল এবং দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু করার কাজে ব্যস্ত তাঁর সরকার। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জাতীয় পেমেন্ট সুইচ, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, রিয়াল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট, ইন্টার-অপারেবল ‘বিনিময়’ ব্যবস্থাসহ ক্যাশলেস লেনদেন পদ্ধতি গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ নিয়েছি। মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সিস্টেম, এজেন্ট ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ ডিজিটাল অর্থব্যবস্থা গড়ার কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। বাংলা ‘কিউআর কোড’ দ্রুতই চালু হচ্ছে। একেবারে তৃণমূলের মানুষ এখন এই আধুনিক আর্থিক সেবার সুফল পাচ্ছে। কভিড সংকটকালে আমাদের ডিজিটাল অর্থায়ন ব্যবস্থা এতটা মজবুত না থাকলে ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যের কী যে হতো তা ভেবেই অবাক হয়ে যাই। লকডাউনের সময়ও তাই এক মিনিটের জন্য থেমে থাকেনি ডিজিটাল অর্থনীতির হালচাল। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংসেবা ছিল নিরন্তর সচল।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে আরো স্মার্ট করার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের এই পরিকল্পনার পাঁচটি স্তম্ভ তিনি উল্লেখ করেছেন : এক. ডিজিটাল শাসনব্যবস্থা; দুই. জনসম্পদ উন্নয়ন; তিন. উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন; চার. সংযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পাঁচ. টেকসই উন্নয়ন। এসব লক্ষ্য পূরণের জন্য সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু নীতি ও আইন প্রণয়ন করে ফেলেছে। বেশ কিছু প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ডিজিটাল স্থাপত্য’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ফেলোশিপ প্রকল্প’, ‘উদ্ভাবন তহবিল’, ‘ডিজিটাল সংযোগ প্রকল্প’ এবং ‘ডিজিটাল ডিভাইস ইনোভেশন ফান্ড’। এসবের ওপর ভর করেই এগিয়ে যাবে স্মার্ট বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে সরকার যেমন উদ্যোক্তা হবে, একইভাবে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও অংশীজন হবেন। একে অন্যের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে গতিময় স্মার্ট বাংলাদেশ। ঠিক ক্যারাভ্যানের মতো।

আইসিটিসহ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষির উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা—দুই-ই ব্যাপক হারে বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ এরই মধ্যে এর সুফল পেতে শুরু করেছে। আমাদের তরুণরা এখন তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে খুবই পটু। তাদের ইচ্ছাশক্তিও প্রবল। তা না হলে গ্রামের নিরক্ষর কৃষক মালকোঁচা থেকে টাচ ফোন বের করে কী করে কারওয়ান বাজারে পণ্য বাজার সন্ধান করেন তা এক অপার বিস্ময়। সে কারণেই তিনি এ দেশের শিক্ষিত তরুণদের গ্রামীণ প্রযুক্তি সার্ভিস ডেলিভারি এজেন্ট হওয়ার আগ্রহকে উৎসাহ দিতে বলেন। এখন যেমন কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ভর্তুকি মূল্যে কিনে তরুণ উদ্যোক্তারা তাঁদের কৃষি সার্ভিস বিক্রি করছেন, একদিন সময় আসবে যখন তাঁরা ‘ক্রপ রোবটিকস’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের কৃষিতে আরো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবেন। সেন্সরের কল্যাণে উপযুক্ত পরিমাণে সার, পানি, বীজ ও কীটনাশক ব্যবহার করে দক্ষ কৃষি কাঠামো গড়ে তুলবে আগামী দিনের শিক্ষিত তরুণরাই। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ দ্রুতই হচ্ছে। সরকারও এ জন্য যথেষ্ট নীতি ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।

সবাইকে নিয়ে বিস্তৃত পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নে মনোযোগী হলে ২০৩১ সাল নাগাদ ৮০টি পণ্য ও সার্ভিস রপ্তানি করেই আমরা ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রা আয় করতে পারব। আর এর জন্য সবচেয়ে বেশি নীতি সমর্থন দিতে হবে আমাদের স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তোলার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ লাখ, ইউরোপে ১৫ লাখ, যুক্তরাজ্যে ১০ লাখ এবং জাপানে সাড়ে আট লাখ তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তির অভাব রয়েছে। শুধু উপযুক্ত জনশক্তি রপ্তানি করেই আমরা বিপুল বিদেশি মুদ্রা অর্জন করতে পারব। একই সঙ্গে অসংখ্য খুদে ডিজিটাল উদ্যোক্তাও আমরা তৈরি করতে পারব। সে জন্য ‘স্টার্ট-আপ’ নিয়ে আগ্রহী তরুণদের প্রশিক্ষণ, মেন্টরিং ও অর্থায়নের উপায় খুঁজে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। দেশপ্রেমই আমাদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। আর আইসিটি কোনো একক খাত হতে পারে না। সব খাতকে আধুনিক ও স্মার্ট করার বাহন এই খাত। আমি আমার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালনার স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি যে আমাদের তরুণদের রয়েছে সৃজনশীল হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা। আমার চোখের সামনে তরুণ কর্মকর্তারা কী করে মাত্র কয়েক বছরেই বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য তথা পুরো ব্যাংকিং খাতটিকে এমন করে ডিজিটাইজড একটি খাতে পরিণত করলেন, তা আসলেই বিস্ময়কর। ‘করে করে শেখা’র এই অনুপ্রেরণা আমরা দিয়েছি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব বলে। ভুলভ্রান্তি নিশ্চয় ছিল। এখনো আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই বলে ভয়ে কেউ প্রযুক্তিই ব্যবহার করবে না তা তো হয় না। নিন্দুকের কথায় হতাশ না হয়ে বিপুল আশা-ভরসা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সে জন্য উপযুক্ত ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণ করাটাও জরুরি ছিল। বেসিসসহ আমাদের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারাও নতুন নতুন ধারণা ও প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছিলেন বলেই একটি মান্ধাতার আমলের প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক ডিজিটাল জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছি। এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণেও খুবই কাজে লাগবে। সে জন্যই চাই সরকার, শিল্প এবং একাডেমিয়ার মধ্যে গড়ে উঠুক নিবিড় সংযোগ।

আশা করি আগামী দিনে এই সংযোগ আরো বাড়বে। কেননা আমাদের রয়েছে স্মার্ট নেতৃত্ব। আছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। আর আছে উন্নত দেশ হওয়ার বিরাট স্বপ্ন। আছে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া লড়াকু মন। আসুন, আমরা সবাই দল-মত-নির্বিশেষে হাতে হাত রেখে কাজ করি সেই স্বপ্নের সমান সুউচ্চ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য। আগামী দিন নিশ্চয় হবে আমাদের।

লেখক : ড. আতিউর রহমান – বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ