নাজমুল হাসান – কলামিস্ট
বিস্ফোরক অধিদফতরের সূত্রমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। গ্রামাঞ্চলে এই গ্রাহকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
বাজারে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৩০টির অধিক কোম্পানির অন্তত দুই কোটি সিলিন্ডার রয়েছে বলে জানিয়েছেন অধিদফতর।
তাদের মতে, বাজারে রান্নার জন্য যেসব গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়, সেগুলো যথেষ্ট নিরাপদ।
কারণ এলপিজি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, তার চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি চাপ ধারণ করার ক্ষমতা এসব সিলিন্ডারের থাকে। তাই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোন ঝুঁকিই নেই, আশ্বস্ত করেছে বিস্ফোরক অধিদফতর।
তারপরও যেসব বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে, তার মূলে রয়েছে এই সিলিন্ডারগুলো যথাযথভাবে পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহার না করা।
সিলিন্ডারের দুর্ঘটনাগুলো মূলত গ্যাসের লিকেজ থেকে ঘটে। হোস পাইপ, রেগুলেটর, ইত্যাদিতে দুর্বলতার কারণে যে কোন সময় গ্যাস লিক হতে পারে। সেই লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে জমতে থাকে। সামান্য আগুন এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে এই জমে থাকা গ্যাসে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। একের পর এক সিলিন্ডার দুর্ঘটনার খবরে অনেক ব্যবহারকারি আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। তাদের ভাষ্যমতে মনে হয়, বাসার মধ্যে একটা বোমা নিয়ে আছি। কিন্তু বাঁচার জন্য রান্না করে তো খেতে হবে, তাছাড়া লাইনের গাস অপর্যাপ্ত; তাই উপায় তো নেই। একটা ভয় কাজ করে কখন জানি দুর্ঘটনা ঘটে।
রান্নাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য দেশের অনেক জায়গায় এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই রেগুলেটর, হোসপাইপ কেনার সময় সার্টিফাইড কোম্পানি কিংবা অনুমোদিত পণ্য বিক্রেতাদের থেকে কেনা উচিত বলে মত দেয় বিস্ফোরক অধিদফতর। যদিও আমাদের দেশের এলপিজি সিলিন্ডারের গুণগত মানের দিক থেকে আন্তর্জাতিক মানের , তবুও সবার আগে দেখতে হবে সিলিন্ডারের গায়ে মেয়াদ দেয়া আছে কিনা।
সাধারণত একটি সিলিন্ডার ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া থাকে। যেটা সাধারণত ১০ বছর থেকে ১৫ বছর হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার কোন অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না।
সেইসঙ্গে কোম্পানির সিল, সেফটি ক্যাপ, ভাল্বের রাবারের রিং ঠিকভাবে আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
বাংলাদেশে প্রচলিত সিলিন্ডারগুলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও অনেক কমদামি আর নিম্নমানের যন্ত্রাংশ বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই শুধু সিলিন্ডার ভালো হলেও গ্যাস লিক হতে পারে যদি এর পাইপ বা রেগুলেটর যদি খারাপ মানের হয়। এখানে বাজারে ভালো খারাপ দুই মানের যন্ত্রাংশই আছে। কিন্তু গ্রামের দরিদ্র মানুষ অনেক সময় বাধ্য হয়ে কমদামের মানহীন পণ্য কেনে। আবার অনেকে না জেনেই নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার করছেন। এতেই বিপত্তি ঘটে।
এক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ তুলে ধরা হচ্ছে
১. বিশেষ করে সিলিন্ডারটি টানা হেঁচড়া করে, ধাক্কা দিয়ে, মাটিতে গড়ানো যাবে না।
২. বাংলাদেশের এলপিজি বিধিমালা, সিলিন্ডার বিধিমালা এবং বিস্ফোরক অধিদফতরের পক্ষ থেকে আরও কিছু সতর্কতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হল: আগুন, বিদ্যুৎ এবং তাপের যেকোনো রকম উৎস সেইসঙ্গে দাহ্য, প্রজ্বলিত বা বিস্ফোরক পদার্থ এবং ভিন্ন কোন গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে এই এলপিজি সিলিন্ডার দূরে রাখতে হবে।
৩. যেখানে সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে তার আশেপাশে আগুন জ্বালানো, ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. সিলিন্ডারের ওপরে ভারী বোঝা রাখা যাবে না।
৫. রান্না শুরু করার ১০ মিনিট আগে রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে দিন। রান্না শেষে চুলার নব ও এলপিজি সিলিন্ডারের রেগুলেটর সুইচ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
৬. এছাড়া তিন বা ছয় মাস পরপর গ্যাস সিলিন্ডার এর সাথে ব্যবহার হওয়া নানা রকম সামগ্রীর নিয়মিত টেকনিশিয়ান দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
৭. গ্যাসের পাইপ বা ফিটিংস দুর্বল হলে কিংবা সিলিন্ডারে ছিদ্র থাকলে সেটা সাথে সাথে বদলে ফেলতে হবে। একে মেরামত, ঝালাই করে ব্যবহার করা যাবে না। তেল বা পিচ্ছিল পদার্থ ব্যবহার করে নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৮. এরপরও যেকোনো ধরণের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাসা, বিশেষ করে রান্নাঘরের মধ্যে নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, যেমন- গ্যাস ডিটেক্টর এবং ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার কিংবা হাতের কাছে কম্বলের মতো মোটা কাপড় রাখা যেতে পারে।
৯. হোটেল বা রেস্টুরেন্টের কিচেন বা রান্নাঘরে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবাহ বা ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই সাথে অগ্নি নির্বাপণ ব্যাবস্থা, যেমন, ওয়াটার স্প্রে বা স্প্রিংকলার সিস্টেম , ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকাটা অতি জরুরী।
১০. এলপিজি শেডে কোনও অতিরিক্ত উপাদান রাখবেন না।
১১. এলপিজি শেডের ভিতরে কোন অ শিখা, বৈদ্যুতিক আইটেম ব্যবহার করবেন না।
১২. এলপিজি শেড বা এলাকার ভিতরে ধূমপান না করা।