বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অন্যদের সঙ্গে তুলনামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে না বলে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থান কোথায় তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে এশিয়ানরা যে পশ্চিমাদের চেয়ে গণিতে ভালো করে তার বেশ কিছু প্রমাণ আছে। সবচেয়ে অকাট্য প্রমাণটি হচ্ছে পিসা পরীক্ষার ফলাফল। ‘প্রগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট’ বা সংক্ষেপে যাকে ‘পিসা’ বলে, সেই পরীক্ষাটা মূলত ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে পরিচালনা করা হয়। পিসা দিয়ে সেই সব দেশের ১৫ বছর বয়স্ক শিক্ষার্থীদের পড়া, গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক জ্ঞান ও বাস্তবজীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার দক্ষতা মাপা হয়। একই প্রশ্নে পরীক্ষা হয় বলে এর ফল দিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর একটি র্যাংকিংও হয়ে যায়।
আমরা যদি ২০১৫ সালের গণিত পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকাই তাহলে দেখব প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে সাতটি দেশই এশিয়ান : সিঙ্গাপুর (৫৬৪), হংকং (৫৪৮), ম্যাকাও (৫৪৪), তাইওয়ান (৫৪২), জাপান (৫৩২), চীন (৫৩১) ও দক্ষিণ কোরিয়া (৫২৪); এবং শেষ তিনটি হচ্ছে সুইজারল্যান্ড (৫২১), এস্তোনিয়া (৫২০) এবং কানাডা (৫১৬)। পিসা ২০১৮-এর ফলও প্রায় একই। এখানেও প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে সাতটি দেশই এশিয়ান এবং তারা আগের চেয়ে ভালো করেছে : চীন (৫৯১), সিঙ্গাপুর (৫৬৯), ম্যাকাও (৫৫৮), হংকং (৫৫১), তাইওয়ান (৫৩১), জাপান (৫২৭), দক্ষিণ কোরিয়া (৫২৬)। শেষ তিনটি দেশ হচ্ছে পশ্চিমা : এস্তোনিয়া (৫২৩), নেদারল্যান্ডস (৫১৯) এবং পোল্যান্ড (৫১৬)।
একটি সংখ্যা উচ্চারণ করতে যত কম সময় লাগে তত বেশি সংখ্যা মেমোরিতে ধরে রাখা যায়। দুই সেকেন্ডের মধ্যে আমরা যা বলতে বা পড়তে পারি, আমরা তা সহজে মনে রাখতে পারি। যেমন—পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৪, ৮, ৫, ৩, ৯, ৭, ৬ সংখ্যাগুলো মুখস্থ করার জন্য ২০ সেকেন্ড সময় দিয়ে ইংরেজি ভাষীদের যদি তার পুনরাবৃত্তি করতে বলা হয়, তাহলে তারা অন্তত শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে ভুল করে। কিন্তু চায়নিজদের ভুল হয় না। এমনকি সাতটির জায়গায় ১০টি সংখ্যা হলেও তারা দ্রুত মুখস্থ করে ফেলতে পারে।
গণিতে ভালো করতে আর যে জিনিসটি লাগে সেটি হচ্ছে ধৈর্য। এ ক্ষেত্রেও যে এশিয়ানরা এগিয়ে আছে সেটি টিমস নামের আন্তর্জাতিক একটি পরীক্ষা দিয়ে বোঝা গেছে। পিসার মতো এই পরীক্ষাটিও এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বহু দেশে নেওয়া হয়। সেই পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য পরীক্ষার্থীদের ১২০টি প্রশ্নের একটি প্রশ্নমালা দেওয়া হয়। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ চাইলে এর উত্তর দিতে পারে, না-ও দিতে পারে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ পশ্চিমা শিক্ষার্থী গরজ করে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয় না। কিন্তু এশিয়ানরা দেয়। এবং যেসব দেশের শিক্ষার্থীরা যত বেশি ধৈর্য ধরে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়, সেসব দেশ গণিতে তত ভালো করে। অর্থাৎ ধৈর্যের সঙ্গে গণিতের একটি সম্পর্ক আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এত ধৈর্য আসে কোত্থেকে? ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের হাইপোথেসিস অনুযায়ী এই ধৈর্যের উৎস হচ্ছে এশিয়ানদের উৎপাদনব্যবস্থা। আবার অন্যদিকে এই উৎপাদনব্যবস্থার কারণেই পশ্চিমাদের ধৈর্য কম। এশিয়ানরা চাষ করত ধান, আর পশ্চিমারা গম।
এদিকে এশিয়ানদের বিষয়টি ছিল একেবারেই উল্টো। ধান চাষ করার সময় তো ধান চাষ করতই, অন্য সময়ও তারা বসে থাকত না; হয়তো ঘরের কাজ করত কিংবা বাঁশ বা বেত দিয়ে কিছু বানাত। এমনিতেই ধান ক্ষেতের কাজ গম ক্ষেতের কাজের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি পরিশ্রম দাবি করে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এশিয়ানরা বছরে গড়ে তিন হাজার ঘণ্টা কাজ করত, যেখানে ইউরোপিয়ানদের বার্ষিক কর্মঘণ্টা এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ ঘণ্টার বেশি ছিল না।
শুধু পরিমাণগত নয়, গুণগতভাবেও তাদের পরিশ্রম ইউরোপিয়ানদের চেয়ে আলাদা ছিল। এশিয়ানদের ক্ষেত্রে ‘যত শ্রম তত ফসল’ যতটা কার্যকর ছিল, ইউরোপিয়ানদের ক্ষেত্রে ততটা ছিল না। আরেকটি কারণেও তাদের পরিশ্রম তুলনামূলকভাবে আনন্দদায়ক ও অর্থপূর্ণ ছিল। বেশির ভাগ এশিয়ান তাদের নিজেদের ভূমিতে, নিজেদের বুদ্ধিতে স্বাধীনভাবে চাষ করতে পারত, আর অন্যদিকে বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান ছিল ভূমি মালিকদের ‘গতর খাটা কামলা’।
হাজার বছর ধরে এ রকম উৎপাদনব্যবস্থায় জড়িত থাকার কারণে এশিয়ানদের ধৈর্য ধরে বেশি সময় নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের এই হাইপোথেসিস যদি আংশিকভাবেও সত্যি হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় আমাদের শিক্ষার্থীরাও গাণিতিক মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অর্থাৎ বাংলা সংখ্যা-শব্দগুলো ছোট বলে এবং তাদের ধৈর্য ধরে বেশি কাজ করার ক্ষমতা আছে বলে গণিতের ক্ষেত্রে জন্মগতভাবেই তারা পশ্চিমা শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে। আমরা যদি এই মেধা বিকাশের পরিবেশটিকে নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে পশ্চিমাদের পেছনে ফেলে চায়নিজ, সিঙ্গাপোরিয়ান বা কোরিয়ানদের কাতারে যেতে আমাদের খুব একটা দেরি হবে না।
লেখক : সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক – সদস্য, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন।