1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

রোহিঙ্গা নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অবস্থান ও ইউক্রেন-রাশিয়া প্রেক্ষাপট

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২

প্রায় চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন এবং জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করাকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করে এই গণহত্যার জন্য মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে অভিযুক্ত করেছে। এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি স্টেট এনটনি ব্লিনকেন বলেছেন, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের নিরিখে প্রতীয়মান যে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্যই ছিল গণহত্যা ঘটানো। তিনি দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে নাৎসি জার্মানি কর্তৃক ইহুদি নিধনের স্মৃতি ‘হলোকস্ট’ জাদুঘরে এক বক্তৃতায় এ কথা বলেন। এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরিষ্কার নির্ণয় (মার্চ ২০২২)। তিনি আরও বলেন, ‘হলোকস্ট’-এর পর যুক্তরাষ্ট্র মনে করে আরও ৮টি গণহত্যা হয়েছে, যার মধ্যে মিয়ানমারের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত। ব্লিনকেন অবশ্য মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে অতীতেও ওই দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু উপজাতিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ এবং লুটপাটের অভিযোগ এনেছে। এ কথা সত্য যে, বছরের পর বছর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী যেভাবে উপজাতি বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে, যেখানে বেসামরিক ব্যক্তিদের নিধনের কারণে হাজার হাজার উদ্বাস্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ, বিশেষ করে কাচিন এবং অন্যরা শরণার্থী হিসাবে বহু বছর থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডে উদ্বাস্তু শিবিরে এখনো রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রায় চার বছর ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিয়েছে এবং বিশ্বের বৃহৎতম ‘শরণার্থী শিবির’ পরিচালিত করে আসছে। এত সংখ্যক উদ্বাস্তু ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মতো দেশের বোঝা হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে এদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে মিয়ানমারে গণহত্যার বিষয়টি অনবরত তুলে ধরছে। শুধু ‘ওআইসি’র পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) একটি মামলা ছাড়া ‘গণহত্যা’ হয়েছে এমন মতামত পশ্চিমা দেশ তথা পূর্ব-এশিয়ার কোনো দেশ ঘোষণা দেয়নি। যদিও দেরি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণা বাংলাদেশ তথা রোহিঙ্গাদের পক্ষে গিয়েছে এবং দেরিতে হলেও এ ঘোষণাকে স্বাগতম জানিয়েছে।

কথা উঠতে পারে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এ বোধোদয় হতে এত সময় লাগল কেন? যদিও এনটনি ব্লিনকেনের মতে, এতদিন অনুসন্ধানে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এজেন্সি কর্তৃক পুঙ্খানুুপুঙ্খ অনুসন্ধান এবং নিশ্চিত তথ্য-উপাত্ত প্রমাণ হিসাবে সংগ্রহ করতে এত সময় লেগেছে! ব্লিনকেনের এ ব্যাখ্যার পেছনে এটাই কি একমাত্র কারণ? না এর সঙ্গে বিশ্বের অতিদ্রুত ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট রয়েছে? এমন সময় যুক্তরাষ্ট্র এ ঘোষণা করল যখন ইউরোপসহ তাবৎ বিশ্ব ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে। একদিকে রাশিয়া তার সমর্থক সংখ্যা সংখ্যায় কম হলেও আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ায় একেবারেই কম নয়।

অপরদিকে ন্যাটোভুক্ত ইউরোপের দেশগুলো আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কথা একবাক্যে শুনছে তেমন নয়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ পশ্চিম ইউরোপে তীব্র জ্বালানি সংকট তৈরি করেছে। জার্মানি, ইউরোপের শক্তিদের ও বড় দেশ তার জ্বালানি বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৪০ ভাগ রাশিয়া থেকে আমদানি করে, যার কয়েকটি পাইপলাইন ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে বিশ্বের গম উৎপাদনের প্রায় ১০ থেকে ১৫ ভাগ ইউক্রেনে উৎপাদিত, বিশেষ করে ইউরোপে রপ্তানি হয় যা এখন দারুণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বে জ্বালানি আর খাদ্য সংকট বাড়তে পারে। ইউরোপের দেশগুলো এ সমস্যার সমাধান চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়লেও বহু বেসামরিক যোদ্ধাগোষ্ঠী ইউক্রেনে ভাড়াটিয়া সৈনিক হিসাবে উপস্থিত। যেমনটা ইরাক, সিরিয়া এবং আফগানিস্তানে ছিল।

এ যুদ্ধের কারণে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেই যুক্তরাষ্ট্রকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে চীন কর্তৃক রাশিয়াকে সক্রিয় না হলেও সমর্থন দেওয়ার কারণে। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে দৃশ্যমান। তেমনি মিয়ানমারসহ পূর্ব-এশিয়ার অনেক দেশে। এর উদাহরণ জাতিসংঘে ভোটাভুটির বিশ্লেষণ। সাধারণ পরিষদে হালের ভোটাভুটির সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান তিনটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে অনুপস্থিত থাকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অশুভ সংকেত- যদিও পরে বাংলাদেশ সপ্তাহখানেক আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়াকে ইউক্রেনে মানবতার খাতিরে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রদানে বাধা না দেওয়ার প্রস্তাবে পক্ষে ভোট দিয়েছে। একই সঙ্গে যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে ভর্ৎসনাও করা হয়। বাংলাদেশের হঠাৎ পটপরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানবতার সপক্ষে ভোট দেওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অবশ্য অনেকেই এর সঙ্গে ভোটাভুটির আগে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আন্ডার সেক্রেটারি পলিটিক্যাল এফেয়ার্স ভিক্টোরিয়া নোল্যান্ডের সফরের কাকতালীয় বা অন্য কোনো কারণে প্রভাব বিস্তারের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়নি।

দক্ষিণ এশিয়ার আর দুটি দেশ যে যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো দেশগুলোর অবরোধ উপেক্ষা করে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বহাল রেখেছে তার মধ্যে রয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের বিষয়টি একেবারেই অন্যরকম। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি এখন এক রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে রয়েছেন, হয়তো এই সপ্তাহেই তার রাজনৈতিক ও শাসনের ভবিষ্যৎ অনাস্থা প্রস্তাবের মধ্যে নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় প্রারম্ভিক সময়ে মস্কো সফর এবং পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের এ সফরকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালোভাবে নিয়েছে বলে মনে হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার একসময়কার প্রধান মিত্রদেশ এবং বহু দশক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য এশিয়া অঞ্চলের ভূরাজনীতির খুঁটি বলে পরিচিত পাকিস্তানের সঙ্গে আগের দহরম মহরম নেই। এর প্রধান দুটি কারণ হতে পারে, চীন-পাকিস্তান অতীব ঘন সম্পর্ক এবং আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বিপর্যয়ের পেছনে পাকিস্তানের অবস্থান। অপরদিকে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক এবং ইন্দোপ্যাসিফিক জোটের অন্যতম শরিক ভারতের অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলাকে অন্যতম কারণ বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক জোট ইমরানকে হটানোর প্রক্রিয়াকেও রাশিয়ার পক্ষে ইমরানের অবস্থানের কারণ মনে করছে।

এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ, আঞ্চলিক শক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীনবিরোধী ইন্দো-প্যাসিফিক প্রক্রিয়া অন্যতম শক্তিশালী দেশ ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ঐতিহাসিক হলেও হালে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী শক্তিশালী মিত্র বলে প্রতীয়মান। বর্তমানে ভারতের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ভারত এবং প্যাসিফিক মহাসাগরের ভূরাজনীতি রচিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এবং পশ্চিমা দেশ এমনকি ইন্দো-প্যাসিফিক অন্য শরিকদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে শুধু রাশিয়ার সঙ্গেই নয় চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের রাস্তায় রয়েছে। প্রথমত, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে ভারত-রুপি-রুবল-এর মাধ্যমে সস্তায় রাশিয়ার জ্বালানি ক্রয়ের চুক্তি করেছে। তা ছাড়া সামরিক অস্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রেও সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। ইতোমধ্যেই সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ভারত সফর করেছেন। এটাই ২০২০ গালওয়ান ভ্যালির চীন-ভারত সংঘর্ষের পর এটাই উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ। এদিকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ ভারত সফরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এই তিন দেশ ভূরাজনীতিকে সামনে রেখে রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চীন (আরআইসি) গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে।

ভারত ভূরাজনৈতিক কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই রাশিয়া-চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বিশ্ব ভূরাজনীতি এবং কৌশলগত কারণে ভারতকে কোনোভাবেই হারাতে চাইবে না, যে কারণেই ভারতের ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে যে নতুন মেরুকরণ হতে চলেছে তাতে ভারতের ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করেনি।

এ আলোচনার প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে চীন-রাশিয়ার অবস্থান ও নৈকট্যের বিপরীতে এতদিন পর দাঁড়িয়েছে। স্মরণযোগ্য যে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পরপর যে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল রাশিয়া। রাশিয়া এখন মিয়ানমারেরর অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারী। তথ্যে প্রকাশ, রাশিয়া মিয়ানমারে দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক নতুন করে আলোচনার তেমন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। চীনের বেল্ট-রোড ইনিশিয়েটিভের পূর্বাঞ্চলের ঘাঁটি। কাজেই চীনের প্রভাব মিয়ানমারে কমার নয়।

এ আলোচনার প্রেক্ষিতে, অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক মেরুকরণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যকে ধরে রাখার প্রচেষ্টায় এতদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয়। তা ছাড়া অবশ্যই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জটিল এ সংকটের সমাধান যে সহজেই হচ্ছে না- তৈরি হচ্ছে নতুন ভূকৌশলগত জটিলতা তারই প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষণাকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এ অঞ্চল যে ভূরাজনীতির এক জটিল সমীকরণের মধ্যে রয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া সে সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। সেদিকে বাংলাদেশের দৃষ্টি অবশ্যই নিবদ্ধ রাখতে হবে।

লেখক : ড. এম সাখাওয়াত হোসেন -নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ