1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা?

ড. প্রণব কুমার পান্ডে : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৩

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার বঙ্গবাজারে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল সেই স্মৃতি দেশের মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি। ঈদের আগে বঙ্গবাজারের মতো একটি বৃহৎ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্ব হারিয়েছে হাজার হাজার ব্যবসায়ী। বিভিন্ন মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা লক্ষ করেছি, সেখানে শুধু দোকানের মালামালই পুড়ে ছাই হয়নি, লাখ লাখ টাকা পুড়ে গেছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বহ্নিশিখায়। দমকল বাহিনীর প্রাণান্তকর চেষ্টায় আগুন নেভানো সম্ভব হলেও সেখানে প্রায় সব দোকান ও মালপত্র পুড়ে গেছে। এতে এসব দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা ঈদের আগে পথে বসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন দোকান মালিকের আহাজারি সবার বিবেককে বাকরুদ্ধ করেছে।

আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় অনেক দোকানের মালিককে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেতে শুনেছি  “গতকাল রাত্রে আমি কোটিপতি থাকলেও আজকে সকালে আমি পথের ভিখারি হয়ে গেছি”।

অগ্নিকাণ্ড পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বিশেষ করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য সংগঠন দোকান মালিকদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এই দোকানদারদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় পোড়া কাপড় কিনে অনেক শিল্পী নিজ নিজ অবস্থান থেকে ব্যবসায়ীদের সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলসহ অনেক প্রতিষ্ঠান (ব্যবসায়ীদের সংগঠন, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান) অর্থ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ঈদের আগে ব্যবসায়ীদের পাশে এসে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সহায়তা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে অস্থায়ী ভিত্তিতে বঙ্গবাজারে দোকানদারদের নতুনভাবে দোকান নিয়ে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

বঙ্গবাজারের স্মৃতি বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে মুছে যাবার আগেই ঢাকার নিউমার্কেটে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড মানুষকে ব্যথিত করেছে। অনেকেই বলবার চেষ্টা করছেন যে ঢাকা আগুনের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এমনিতে  বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যে গরম প্রবাহ বয়ে চলেছে, সেই সময় ঢাকায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি বড় অগ্নিকাণ্ড মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করেছে। দমকল বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ভিডিপি ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের প্রাণান্তকর চেষ্টায় নিউমার্কেটের আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে নিউমার্কেটের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় বঙ্গবাজারের মতো সব দোকান পুড়ে যায়নি, যা কিছুটা হলেও স্বস্তির খবর। গরমের মধ্যে আগুন নিভানোর কাজ করার সময় দমকল বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

ধ্বংসস্তূপ থেকে মালামাল উদ্ধারের সময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে সহায়তা করেছে তার মাধ্যমে  বাংলাদেশের জনগণ মানবিক পুলিশের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছে। নিউমার্কেটে অগ্নিনির্বাপণের সময় পুলিশের ভূমিকা প্রশংসিত হলেও একশ্রেণির উৎসুক জনতার অগ্নিকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার বাসনা অগ্নিনির্বাপণের কাজে ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। অতি উৎসাহী জনতার ভিড় ঠেলে অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে দমকল বাহিনীকে যথেষ্ট  বেগ পেতে হয়েছে। দুর্ঘটনার সময় যারা অগ্নিকাণ্ড প্রত্যক্ষ করবার জন্য এই ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে মানবতাবোধের অভাব রয়েছে বলা যায়।

ঢাকার মতো ব্যস্ত নগরীতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে এরকম দুটি অগ্নিকাণ্ড বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে বক্তব্যে যারা অগ্নিনির্বাপণ কাজকে বাধাগ্রস্ত করেছে তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকায় এরকম দুটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সত্যই কি দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে সেই বিষয়টি খুঁজে বের করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। আমরা গত এক বছর ধরে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে বিভিন্ন ধরনের নোংরা রাজনীতির খেলা প্রত্যক্ষ করেছি। অতএব, এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড সেই নোংরা রাজনীতির খেলার অংশ কিনা সেটি খুঁজে বের করা জরুরি।

বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঠিক আগে গাজীপুরের একটি বাজারের একটি ঘটনা আমার নজরে এসেছে। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে একজন ব্যক্তির ফেসবুক প্রোফাইলে সেই ঘটনার কয়েকটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে সংগৃহীত কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে, মাস্ক পরা একজন ব্যক্তি হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে বাজারে ঢুকছেন। সেই ব্যাগের মধ্যে ছিল দাহ্য পদার্থ, টিস্যু পেপার এবং একটি ভাঙা মোবাইলের ব্যাটারি। সেই ব্যক্তি একসময় বাজারের এক স্থানে আগুন জ্বালিয়ে সেখান থেকে সরে পড়েন। একজন ব্যবসায়ী সেই ঘটনা দেখে ফেলেছিল বিধায় অতি দ্রুত সেই আগুন নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীতে বাজার কমিটির পক্ষ থেকে পুলিশকে বিষয়টি জানানো হলে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশ সেই ব্যক্তিকে শনাক্ত করবার চেষ্টা করছে। অতএব, এই ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে বঙ্গবাজার কিংবা নিউমার্কেটের যোগাযোগ সূত্র আছে কিনা তা খুঁজে বের করা জরুরি এবং ভবিষ্যতেও এ ধরনের কর্মকাণ্ড যেন সংঘটিত হতে না পারে, সে বিষয়টি খেয়াল রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ থাকা উচিত।

অন্যদিকে, আমরা যদি বঙ্গবাজার এবং নিউমার্কেটের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে যে উভয় স্থানেই খুব ঘিঞ্জি পরিবেশে দোকানদাররা বেচাকেনা করে। বেশিরভাগ দোকানে অগ্নিনির্বাপণের কোনও ব্যবস্থা নেই। এছাড়া, অগ্নিনির্বাপণের সময় প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির উৎস আশপাশে নেই, যা অনেক ক্ষেত্রেই ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। যেভাবে বৈদ্যুতিক লাইনগুলো বাজারের মধ্যে ব্যবহার করা হয় সেটিও খুব নিরাপদ নয়। যেকোনও সময় শর্টসার্কিট থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা থাকে। ফলে, বাজার সংশ্লিষ্ট সবার উচিত সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নিয়ম মেনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা।

বড় বড় মার্কেটের চারদিকে ওয়াসার পক্ষ থেকে অগ্নিনির্বাপণের জন্য পানির পয়েন্ট প্রতিস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। নিউমার্কেটের আগুন নিভানোর সময় দমকল বাহিনীকে ঢাকা কলেজের পুকুর থেকে পানি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। আমরা সবাই জানি ঢাকায় এমনিতেই জলাশয়ের সংখ্যা অনেক কম। যেগুলো ছিল সেগুলো ভরাট করে বড় বড় স্থাপনা তৈরি হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে পানির উৎস যদি না থাকে দমকল বাহিনীর পক্ষে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ করা সম্ভব নয়।

তবে এ ধরনের হৃদয় বিদারক ঘটনার মধ্যে অন্য যে বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করেছে তা হলো বঙ্গবাজার এবং নিউমার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের সময় এক ধরনের নব্য লুটেরা শ্রেণির মালামাল লুট করার ঘটনা। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা যখন তাদের মালামাল উদ্ধারের কাজ করছিল তখন এই শ্রেণির লুটেরারা ব্যাপক লুটতরাজ করে। ঠিক তেমনিভাবে নিউমার্কেটের পাশে ফুটপাতে কোন অগ্নিকাণ্ড না হলেও সেখান থেকে প্রচুর মালামাল লুট হয়ে যায়, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এটা অত্যন্ত অমানবিক কাজ। পুলিশের উচিত এদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। তাছাড়া প্রত্যেকটি দোকানে যদি নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকে তাহলে দুর্ঘটনা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ ধরনের বাধ্যবাধকতা আইনে থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। বঙ্গবাজারের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি ফুটে উঠেছে বারবার।

তবে, যে কারণেই আগুন লাগুক না কেন এই ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনা শুধু ব্যবসায়ীদের জন্যই নয়, সবার জন্যই খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। ব্যবসায়ীদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে যার যার অবস্থান থেকে তাদের সহায়তা করা উচিত। আমরা যদি তা করতে পারি তাহলে সেটাই হবে মানবতার কাজ। তবে সবকিছুর ওপরে যে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে বের করা প্রয়োজন তা হলো এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড কি শুধুই দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনও রাজনীতি রয়েছে? দেশে একশ্রেণির রাজনীতিবিদ রয়েছে যাদের কাছে মানবতার চেয়ে যেকোনও মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া জরুরি। আমরা তাদের অগ্নিসন্ত্রাসের কার্যক্রম আগেও প্রত্যক্ষ করেছি। যদি এই অগ্নিকাণ্ডগুলো সেই পরিকল্পনার ধারাবাহিকতার অংশ হয়ে থাকে তবে তা সঠিকভাবে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে উঠে আসা উচিত এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। তবে, এক্ষেত্রে তদন্তে পক্ষপাতিত্ব যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতার মসনদে বসবার জন্য কোনও গোষ্ঠী বা দল যদি এভাবে ব্যবসায়ীদের নিঃস্ব করে দেবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়, তাদের সেই পরিকল্পনাও রুখে দিতে হবে।

লেখক: ড. প্রণব কুমার পান্ডে – অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ