1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ছয় দফা যেভাবে এক দফায় পরিণত হয়েছিল

মোনায়েম সরকার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১০ জুন, ২০২২

স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সহজাত। ১৯৪৭ সালের মধ্য-আগস্টে ভারত ও পাকিস্তান গঠিত হলে পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধীনতার আনন্দে উল্লসিত হয়েছিল। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা বুঝতে পারে, প্রকৃত স্বাধীনতা তারা পায়নি। বাঙালির সহজাত প্রতিবাদের ধারা গড়ে উঠতেও দেরি হয়নি।

এর প্রথম প্রকাশ ১৯৪৮-এর মার্চে ভাষার দাবিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, যার চূড়ান্ত পরিণতি ৫২-র রক্তঝরা ভাষা-আন্দোলন। পূর্ব বাংলায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয় মুসলিম লীগের প্রতি চরম অনাস্থার প্রকাশ।

কিন্তু পাকিস্তানকে বিদায় জানানোর প্রশ্নে বাঙালি মুসলমানের মন তখনো দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ১৯৫৪-৫৮ পর্বে পাকিস্তানে সাংবিধানিক শাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের একাধিক প্রয়াস ও সুযোগ সামরিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্রের মুখে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। এ সময়ে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে পাকিস্তানের শাসনে অংশীদারত্ব না দিতে তারা বদ্ধপরিকর।

পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ ১৯৪৯ সালেই আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা নিয়ে ‘মুসলিম’ অভিধা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু ১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর।

ভাষা আন্দোলনের বিপুল উৎসাহে ত্রিশের দশকের ধর্মভিত্তিক চিন্তাকে পরিত্যাগ করে আবার ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক মঞ্চে সমবেত হয় পূর্ব বাংলার মানুষ। ১৯৫৬-৫৭ সালে অল্প সময়ের জন্য পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব লাভেও তারা সমর্থ হয়। কিন্তু নেতৃত্বের একাংশের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য বাঙালির রাজনীতির মূল স্রোতে আবার ভাঙন ডেকে নিয়ে আসে।

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগের বিভক্তি এরই পরিণতি। এ সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে বিদায়ি ‘সালাম’ জানান। পরবর্তীকালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসা অংশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা যেমন খান আবদুল গাফফার খান প্রমুখকে নিয়ে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাপের জন্ম হয়। কিন্তু ন্যাপের পরবর্তী কার্যক্রমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি সমাজতন্ত্রের দাবির কাছে গৌণ হয়ে যায়। ফলে ন্যাপ রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন সমগ্র পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার, নির্যাতন, নিষেধাজ্ঞা জারি এবং অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের দিয়ে কনভেনশন মুসলিম লীগ তৈরি করে তিনি এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। এর বিরুদ্ধে প্রথম বিস্ফোরণ দেখা যায়, ১৯৬২ সালে শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনে। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের আবার সংগঠিত করতে শুরু করে।

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম পর্বে আওয়ামী লীগের মূল নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান, জহির উদ্দিন, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। দ্বিতীয় পর্বে সোহরাওয়ার্দীর পরেই শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের মূল সংগঠকরূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতাদের বিরোধিতার মুখেও আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে শেখ মুজিবুর রহমানই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ সময়ের মূল প্রয়াস ছিল পাকিস্তানের সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ সম্মিলিত বিরোধী দল বা কপ-এর প্রার্থী হন এবং তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে পরাজিত হন।

ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্যোগে লাহোরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। আওয়ামী লীগ এ সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে প্রথমদিকে মনস্থির করতে পারেনি।

অবশেষে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরীসহ দশ সদস্যের আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল এতে যোগদান করেন। অন্যান্য দল থেকে ১১ জন প্রতিনিধি ঢাকা থেকে যান, তবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০-এর অধিক সদস্য সম্মেলনে যোগদান করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এ সম্মেলনে ১০ ফেব্রুয়ারি ৬-দফা উত্থাপন করে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন।

লাহোরের সম্মেলনে শেখ মুজিব প্রাথমিকভাবে যে ৬-দফা উত্থাপন করেন তা ছিল সংক্ষিপ্ত প্রস্তাব আকারে :

১. শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টির আওতায় পাকিস্তানের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিষ্ঠা যার ভিত্তি হবে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, থাকবে সর্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকার ও সার্বভৌম আইন পরিষদ;

২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়, অবশিষ্ট বিষয়গুলো ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে থাকবে;

৩. দুটি পরস্পর বিনিময়যোগ্য মুদ্রা বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ একটি মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে। আর থাকবে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন প্রবাহ রোধের শাসনতান্ত্রিক বিধান। ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর জন্য পৃথক রাজস্ব ও অর্থনীতি থাকবে;

৪. করারোপ ও লেভি বলবৎ করার বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে থাকবে, কেন্দ্রের হাতে নয়, কেন্দ্রে যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহে প্রয়োজনীয় তহবিলের জন্য প্রদেশগুলোর কাছ থেকে সব কর রাজস্বের একটা অংশ পায় তার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকবে;

৫. প্রতিটি প্রদেশের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি করে পৃথক হিসাব খোলা হবে এবং তারা প্রত্যেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে তার ওপর তাদের নিজ নিজ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। আর এর একাংশের বরাদ্দ থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা মেটানোর জন্য। দেশে উৎপাদিত পণ্যাদির আন্তঃপ্রদেশ চলাচল ও পরিবহণের বেলায় অভিশুল্কমুক্ত সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। প্রদেশগুলোর বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি পাঠানোর এবং সংশ্লিষ্ট প্রদেশের স্বার্থে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকতে হবে;

৬. প্রদেশগুলোর জন্য আধা-সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী থাকতে হবে।

৬-দফায় কেন্দ্রের হাতে শুধু প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় থাকবে, একমাত্র স্টেটগুলোর হাতে কর ধার্যের ব্যবস্থা সুপারিশ করা হয়, করের একটা নির্ধারিত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় তহবিল গঠিত হওয়ার কথা বলা হয়, আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্র অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে। শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত ৬-দফা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সব এবং পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের কোনো নেতাই সমর্থন করেনি।

সম্মেলনের আয়োজকরা শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ৬-দফা নিয়ে কোনো প্রচার বা আলোচনা সম্মেলনে করতে রাজি হননি। ফলে শেখ মুজিব এবং তার প্রতিনিধি দল এ সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন।

চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের এম এ আজিজ, আবদুল্লাহ আল্ হারুন এবং এমএ হান্নান ৬-দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম বিবৃতি প্রদান করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করলে ৬-দফা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে ৬-দফার পক্ষে ও বিপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান, এমনকি আওয়ামী লীগেও দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়। কাউন্সিল মুসলিম লীগ ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬-দফার কড়া সমালোচনা করে বিবৃতি প্রদান করে। জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলামও ৬-দফার বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করে। ওইদিন শেখ মুজিব পুরানা পল্টন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ৬-দফার বিষয়বস্তুর ওপর বিশদ ব্যাখ্যা দেন।

আওয়ামী লীগ ৬-দফা গ্রহণ করার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ জনসভায় শেখ মুজিব দেশ ও দশের বৃহত্তর কল্যাণে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার ইডেন হোটেলে। কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফাকে দলের প্রধান মেনিফেস্টো হিসাবে গ্রহণ করা হয়। পূর্ব বাংলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনকেই আওয়ামী লীগ দলের প্রধান নীতি বলে বিবেচনা করে। আওয়ামী লীগের নতুন কাউন্সিল অধিবেশন এবং নেতৃত্বের পরিবর্তন ৬-দফার সংগ্রামকে বেগবান করার উদ্দেশ্যেই হয়েছিল। ইতোমধ্যে ৬-দফাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নূরুল ইসলাম চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রথম একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। কাউন্সিল অধিবেশনের আগে তাজউদ্দীন আহমদের লিখিত একটি সারগর্ভ ভূমিকাসহ এ পুস্তিকার নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে ৬-দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ৬-দফার ব্যাখ্যাসহ ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা’ শিরোনামে তৃতীয় এবং নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ৬-দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ এটি জনগণ, সরকারসহ সব স্তরে দ্রুত পৌঁছতে থাকে। পাকিস্তান সরকার ৬-দফাকে তাদের নতুন চ্যালেঞ্জ এবং হুমকিস্বরূপ গ্রহণ করে। আইয়ুব সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ৬-দফার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে থাকেন। তেমনিভাবে আওয়ামী লীগ নেতারা সরকারের এসব অপব্যাখ্যার আচরণের দাঁত ভাঙা জবাব দেন।

১৯৬৬ সালের ১০ মে-র মধ্যে সারা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ৩ হাজার ৫০০ জন নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ মুজিব তার আগেই সবকিছু গুছিয়ে এনেছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে কর্মী বাহিনী যাতে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তার সংগঠনকে। এ সময় ছাত্রলীগের মধ্যেও ৬-দফার বিরুদ্ধে একটি স্রোত ক্রিয়াশীল ছিল। শেখ মুজিব ৬-দফার পক্ষের জেলা পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতাদেরও সংগঠিত করেছিলেন, যাতে করে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুপস্থিতিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৬-দফাপন্থি আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় স্তরের নেতারা ছাত্রলীগের সহায়তায় আবার সংগঠিত হতে শুরু করেন।

আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে পল্টন ময়দানে একটি জনসভা ডাকা হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ১৩ মে। ছাত্রলীগের উদ্যোগই ছিল বেশি। শেখ মুজিব জেলে থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কাছে নির্দেশ পাঠান জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ৬-দফার পক্ষে হরতাল-মিছিল ও জনসভার কর্মসূচি নেওয়ার জন্য। মাযহারুল হক বাকি, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান ও ছাত্রলীগ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ১৯৬৬ সালের ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করেন। গ্রেপ্তারের হুমকির মুখেও ৬-দফাসহ বন্দি নেতাদের মুক্তির দাবিতে প্রচার চালাতে থাকেন। গভর্নর মোনায়েম খান বুঝতে পারেননি, এরপরও আওয়ামী লীগ নড়েচড়ে উঠবে। তাই তার নির্দেশে আরেক দফা গ্রেপ্তার শুরু হলো। কিন্তু সবাই আগে থেকেই ছিলেন সতর্ক। এবার গ্রেপ্তার অভিযানে পুলিশ খুব সুবিধা করতে পারেনি। ৭ জুন, ১৯৬৬ হরতালের পক্ষে লিফলেট ছাপিয়ে মহল্লায় মহল্লায় শুরু হয় প্রচার অভিযান। নারায়ণগঞ্জেও একই অবস্থা। ৬ জুন নবাবপুর রেল ক্রসিং-এর কাছে আওয়ামী লীগের মশাল মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। কিন্তু দেখা গেল ৬ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড মিছিল হচ্ছে। হরতাল প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েও সরকার ব্যর্থ হলো।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন সকাল থেকেই হরতাল শুরু হলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে। সকাল ৯টার দিকে তেজগাঁ শ্রমিক এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে বেঙ্গল বেভারেজে চাকরিরত সিলেটের অধিবাসী মনু মিয়া ঘটনাস্থলেই মারা যান। মনু মিয়ার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শ্রমিকসমাজ। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ছাত্র-জনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে মিছিল-সমাবেশ সংগঠিত হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও গুলি চালায়। একপর্যায়ে পুলিশ কার্জন হলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচতে আমি দুই তলা থেকে নিচতলায় একটি এসি কামরায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করি। তখন পুলিশের সঙ্গে আমার সংঘর্ষ হয়। আমার বাম হাতের তিন প্রধান আর্টারি কেটে যায়। ঢাকা মেডিকেলে ডা. আলমের অপারেশনে আমি বেঁচে যাই। সেই দাগ এখন আমার বাম হাতের কবজিতে রয়েছে। পাসপোর্ট বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে এই স্থায়ী পরিচিতি চিহ্ন আমি আজো ব্যবহার করি।

হাসপাতালে আমার বিছানার পাশে ফরিদপুরের ২ জন গামছা ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৭ জুনে আহত সব নেতাকর্মীকে পুলিশ হাসপাতালে স্থানান্তর করার খবর পেয়ে আমাদের দলীয় ডাক্তারদের পরামর্শে আমাকে ডিসচার্জ করা হয়। ৭ দিন পর সেলাই খুলতে হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম-সবাইকে পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেই সময়কার চরম নির্যাতনের নমুনা তুলে ধরতে এ বিষয়টি উল্লেখ করলাম।

শ্রমিক-জনতা তেজগাঁয় স্টেশনে সব ট্রেন থামিয়ে দেয়। তেজগাঁ স্টেশনের কাছে নোয়াখালীর শ্রমিক আবুল হোসেন (আজাদ এনামেল অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম কারখানা) ইপিআর-এর রাইফেলের সামনে বুক পেতে দেন। ইপিআর বাহিনী তার বুকেও গুলি চালায়। অল্প সময়ের মধ্যেই সব এলাকার শ্রমিক এবং আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা ঢাকা শহর উত্তাল করে তোলে। নারায়ণগঞ্জে রেলওয়ে স্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে ৬ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। ফলে বিক্ষোভ-প্রতিবাদে সর্বস্তরের শত শত মানুষ রাজপথে নেমে আসে। পুলিশের উসকানির মুখে জনগণ থানার মধ্যে ঢুকে যায় এবং যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের ছিনিয়ে নিয়ে আসে। সন্ধ্যার পরপরই ঢাকার শ্রমিক এলাকাগুলোতে কারফিউ জারি করা হয়। গ্রেপ্তারের সংখ্যাও সন্ধ্যার মধ্যে দেড় হাজার ছাড়িয়ে যায়।

এরপরের ইতিহাস জেল, জুলুম, হত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টার ইতিহাস, যার চূড়ান্ত রূপ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। কিন্তু ’৬৯-এর অভূতপূর্ব গণআন্দোলন সব অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয়। গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে আইয়ুব শাহীর এবং শেখ মুজিবুর রহমান রূপান্তরিত হন বাঙালির প্রিয় নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’তে। আর মাত্র দু-বছরের মধ্যে ৬-দফা রূপান্তরিত হয় এক দফায়।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয় দফা ও এগারো দফার সমর্থনে বাঙালি বাংলাদেশের পক্ষে গণরায় ঘোষণা করে। ছয় দফার লড়াই পর্যায়ক্রমে ডাক (ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি), এগারো দফা, গণঅভ্যুত্থান ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে এক দফায় রূপান্তরিত হয়। ছয় দফার আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে এবং বঙ্গবন্ধুকেও নেতৃত্বের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।

লেখক : মোনায়েম সরকার – রাজনীতিক ও লেখক; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ