1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয় : একের পর এক ঘটেই চলেছে

বিভুরঞ্জন সরকার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২

প্রথম মনে হতে পারে, ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু এক সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এগুলো মোটেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলোর একটি ধারাবাহিকতা আছে এমনকি মিলও আছে। বড় মিল এগুলো সবই ঘটছে একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।

ঘটনাগুলো সময় অনুযায়ী একটু সাজানো যাক। চেষ্টা করা যাক একটি মালা গাঁথার। কেউ বলবেন, নানা সময়ে, নানা জায়গায় ঘটনা কুড়িয়ে মালা গাঁথলে তো ছোট বিষয়ও বড় হয়ে উঠবে চোখের সামনে। আমরা কি ছোটখাট বিষয়কে একত্র করে বড় করে তুলব? তাহলে তো বড় বিষয়ও এক সময় আমাদের কাছে ছোট হয়ে যাবে। না, ছোট বিষয়কে বড় করার দরকার নেই, শুধু ছোট ঘটনার মধ্যেও যে বড় ঘটনার বীজ লুকিয়ে থাকে, সেটাও সবার বুঝ-বিবেচনায় সময় সময় থাকে না।

প্রথমেই মনে করা যেতে পারে এখন থেকে একুশ বছর আগের একটি ঘটনা। গোপালকৃষ্ণ মহুরীর নাম নতুন প্রজন্মের কেউ হয়তো শোনেইনি। আগের যারা তার নাম শুনেছিলেন, তাদের স্মৃতি থেকেও হয়তো নামটি ইরেজ হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ। বেঁচে থেকে তিনি হয়তো দেশজুড়ে পরিচিত ছিলেন না। ২০০১ সালের ১ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রামের জামাল খাঁ রোডের নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সকালে বারান্দায় বসে তিনি পত্রিকা পড়ছিলেন। ঠিক তখনই কয়েকজন দুর্বৃত্ত সেখানে ঢুকে তার মাথায় গুলি করে। পরদিন খবরের কাগজে তিনি খবর হয়ে যান।

২ নভেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত তার রক্তাক্ত বীভৎস ছবি যারা দেখেছেন, তারা সবাই ভয়ে শিউরে উঠেছেন। গোপালকৃষ্ণ মহুরীর ঘাতক কারা ছিল? ছিল জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডার। গোপালকৃষ্ণ মহুরীর মতো রাজনীতি থেকে দূরে থাকা একজন প্রবীণ শিক্ষক কেন শিবিরের টার্গেট হলেন? পাঠক, আবার সময়টার কথা স্মরণ করুন। ২০০১ সাল। নির্বাচনে জিতে সদ্য ক্ষমতায় বসেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। দেশজুড়ে চলছে তাণ্ডব। নির্বিচারে চলছে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হিন্দুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা-ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। এমন রাজনৈতিক অরাজকতার আগে গোপালকৃষ্ণ মহুরী নিজের কলেজে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবির নিষিদ্ধ করেছিলেন। তার এ সাহস পছন্দ হয়নি শিবিরের। তাকে হত্যা করে বদলা নিয়েছিল শিবির। ১২ জন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। পরে বিচারে ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৪ জনের যাবজ্জীবন জেল হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সব আসামিকেই যাবজ্জীবন জেল দেন। সাজাপ্রাপ্ত দুজন পলাতক আসামির মধ্যে একজন একুশ বছর পর সম্প্রতি ধরা পড়েছে।

শ্যামলকান্তি ভক্তের ঘটনাও ৬ বছর আগের। নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শ্যামলকান্তি ভক্তকে ২০১৬ সালের ১৩ মে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে প্রকাশ্যে কান ধরে উঠবস করিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, জাতীয় পার্টির নেতা সেলিম ওসমান। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হলে এক বছর পর তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের মিথ্যা অভিযোগে মামলা করে জেলে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হয়। কিন্তু যারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো, যারা তাকে অপমানিত ও অসম্মানিত করলো তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হলো না? এভাবে অপরাধীদের মার্জনা করে যারা শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষার কথা বলেন, তারা হিপোক্রেট।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে মিথ্যা অভিযোগে যারা জেলে পাঠালো, যারা একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের গায়ে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ পরিকল্পিতভাবেই ওঠালো, তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হলো? ২১ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে স্কুলে শিক্ষকতা করছেন যিনি তার বিরুদ্ধে এমন হীন ষড়যন্ত্র কি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা? ছাত্রদের দিয়ে তার বক্তব্য মোবাইলে ধারণ করার পরামর্শ যারা দিয়েছেন তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় না আনায় ওই চক্র তো পরে একই অপরাধ আবারও সংঘটিত করবে!

তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. লতা সমাদ্দারকে টিপ পরা নিয়ে হেনস্তার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যের শেষ পর্যন্ত কী হলো? টিপ পরা নিয়ে কটূক্তি করে এবং তার পায়ের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে দিয়ে আহত করা নিশ্চয়ই কোনো ভালো কাজ নয়। যিনি এ খারাপ কাজটি করেছেন, তিনি তো অপরাধ করেছেন। অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হয়। এ নীতি কি কার্যকর হবে বলে আশা করা যায়? নাকি কয়দিনের মিডিয়া হইচইয়েই সব শেষ?

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মিথ্যা অভিযোগে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পালকেও হেনস্তা হতে হয়েছে। এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা কোনো শাস্তি না পান, তাহলে অন্য কোথাও অন্য কোনো পাল এভাবেই নিগৃহীত হবেন না কি?

নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের ঘটনাটি তো চমকপ্রদ। তিনি কোনো অন্যায় না করেও বড় শাস্তি পেয়েছেন। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে কঠোর শাস্তি না দিলে দেশে শিক্ষক অপমানের যে ব্যাধি দেখা দিয়েছে তা দূর করা যাবে না। কলেজের জনৈক ছাত্র ভারতের নূপুর শর্মাকে সমর্থন করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়। বিষয়টি নজরে আসামাত্র অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস ওই ছাত্রকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার জন্য নিজেই পুলিশকে খবর দেন। কিন্তু স্বপন বিশ্বাসকে অপদস্ত করার পরিকল্পনা সাজিয়ে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে এলাকায় উত্তেজনা ছড়ানো হয়।

পুলিশের পাহারায় যেভাবে ওই শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে উল্লাস করা হয়েছে, তা রীতিমতো পাশবিক। ডিসি-এসপির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কর্মকর্তার উপস্থিতিতে একজন প্রবীণ শিক্ষকের গলায় জুতার মালা যারা পরিয়েছে, তারা কোনোভাবেই প্রশ্রয় পাওয়ার মতো মানুষ হতে পারে না। একজনকে সরকারি দলের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া বাস্তবে কোনো শাস্তি নয়। আবার ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশের ওসিকে ক্লোজ করাও বাস্তবে কোনো শাস্তি নয়।

আশুলিয়ার চিত্রাশাইলে হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারের ক্ষেত্রে ঘটেছে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। ১০ বছর ধরে তিনি এই কলেজে শিক্ষকতা করছিলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি ছাত্রীদের উত্ত্যক্তসহ নানা উচ্ছৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। এ কারণে সেই কলেজের স্কুল শাখার প্রভাবশালী এক মস্তান ছাত্র ২৫ জুন ২০২২ কলেজ মাঠে শিক্ষক উৎপল কুমারকে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। গুরুতর আহত হয়ে চিকিকিৎসাধীন অবস্থয় তিনি ২৭ জুন সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

এ সাতটি ঘটনা ছাড়াও সম্প্রতি শিক্ষক নির্যাতনের আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সেগুলো গণমাধ্যমে তেমন প্রচার পায়নি। বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের রুমাল সরকার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঞ্জয় সরকার ও উমেশ রায় এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার স্কুল শিক্ষক মিল্টন রায়কে অপমান ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের কথা আমরা প্রায় ভুলেই গেছি!

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ইমেরিটাস অধ্যাপক বিরাশি বছরের বৃদ্ধ অরুণ কুমার বসাক তার বেদখল করা বাড়ি সর্বোচ্চ আদালত থেকে রায়ের পরও ফিরে পাননি! এ ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলোকে এখন আর রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যখন বৈষয়িক উন্নয়ন-অগ্রগতি নিয়ে লম্ফঝম্ফ করছি, তখন আত্মিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় আমাদের পীড়িত না করে পারে না। অত্যন্ত দৃষ্টকটূভাবে লক্ষণীয় যে, যেসব শিক্ষক হেনস্তার শিকার হয়েছেন তারা সবাই সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষক। অবিলম্বে এসব বন্ধ না-হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মর্যাদা হারাবে।

লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার – সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ