কেমন ছিল আমাদের শৈশব কৈশোরের দিনগুলো? কেমন ছিল আমাদের ঈদ উৎসব, পূজা পার্বণ কিংবা ক্রিসমাসের দিনগুলো? আহ্—কী যে দারুণ! রোমাঞ্চকর ঘটনায় ঠাসা থাকত ঈদ ছুটির গোটা সময়। অনেকেই ভাবতে পারেন ঈদ তো ঈদই এর মধ্যে রোমাঞ্চের কী আছে? আছে, সত্যিই আছে।
চাচাতো, মামাতো, কাকাতো, খালাতো, ফুপাতো অসংখ্য ভাইবোন সমবয়সী ভাগিনা-ভাগ্নেসহ আরও কত রকম তুতো-পরতুতোদের মাঝে বেড়ে ওঠা। তারপর আবার ঈদ-পূজাতেও বিশাল মিলনমেলা।
গাছে ওঠা, সঙ্গে গাছে থাকা জিন-ভূতেদের উপস্থিতি। তারা আবার কারও কারও ঘাড়ে উঠে বসছে। সঙ্গে সঙ্গে মৌলভী ডেকে এনে আনা হচ্ছে, চাচার বন্ধু বাবলা কাকাকে। সঙ্গে আছে বলাইদা। তিনিও ঘাড় থেকে ভূত নামাতে ওস্তাদ।
গাছে ওঠা, সঙ্গে গাছে থাকা জিন-ভূতেদের উপস্থিতি। তারা আবার কারও কারও ঘাড়ে উঠে বসছে। সঙ্গে সঙ্গে মৌলভী ডেকে এনে আনা হচ্ছে, চাচার বন্ধু বাবলা কাকাকে। সঙ্গে আছে বলাইদা। তিনিও ঘাড় থেকে ভূত নামাতে ওস্তাদ।
পুরানো সেই দিনের কথা সেই কি ভোলা যায়! এখন আমি ঝাঁ চকচকে রাজধানীর আদ্যোপান্ত শহরের নাগরিক। কিন্তু জন্মসূত্রে কাটিয়েছি বিশাল তরু বৃক্ষময় নির্জন অথচ অসম্ভব কোলাহলপূর্ণ এক বাড়িতে। যেখানে শহর শান্ত শব্দহীন। ঈদ এলে তাই ছোট বড় পুরোনো নতুনের মিশেলে সমারোহে শহরটা যেন ঝলমল করে উঠতো।
ঈদের পরের দিন কিংবা ঈদ ছুটির পুরো সময়টায় এই বাড়ি, ওই বাড়িতে বিচিত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। আমরা নাচ পারি, গান পারি, নাটক পারি, আমরাই সব পারি।
ঈদের দিন দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতাম। দলের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সবাই আছে। কারণ কারও মায়ের জর্দা সেমাই সবার পছন্দ, কারও মায়ের মাদ্রাজি পোলাও, কারও মায়ের ডিমের হালুয়া তো কারও মায়ের পায়েস। শুধু কী তাই?
আমরা অনামিকার বাসায়ও যেতাম মুক্তির বাসায়ও যেতাম। মাসিরাও ঈদের দিন একটা কিছু স্পেশাল রান্না করে রাখতেন আমাদের জন্য। পাঠক হয়তো ভাবছেন আমার লেখায় এত ধর্মের মানুষের গল্প আসছে কেন। আসছে, কারণ প্রেক্ষাপট। আমি জানি না ঢাকা শহরে তো প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু এই আদান-প্রদানের নিয়মগুলো এখন আর মফস্বল শহরের ছেলেমেয়েরাও পালন করে কি না।
আমাদের দেশের ঈদ-পূজা-ক্রিসমাস এবং অন্যান্য উৎসবগুলো আসলে কতটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান তারচেয়ে অনেক বেশি ছিল সামাজিকতার। তাই এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে যেত ভিন্ন ধর্মের মধ্যেও। যাক সেসব কথা। সময় বদলাবেই। অস্বীকার করার উপায় নেই।
সময়ের হাত গলে একদিন ঢুকে গেল কোনো এক কালো শক্তি। সেই কালো শক্তি জোর করে যেন আমাদের এই প্রীতিবন্ধন নষ্ট করে দিয়েছে একদিন। কালিমা লেপে দিয়েছে একে অপরের অনুভূতির ওপর।
আমি জিন-ভূত তাড়ানোর ঘটনাগুলো উপস্থাপন করলাম একটি কারণে। বলাইদা যখন জিন নামাতে ব্যর্থ হচ্ছেন তখন বলছেন হুজুর এটা বড় শক্ত জিন, বড় পাজি চলেন দুজনে চেষ্টা করি। এই যে একজন আরেকজনের প্রতি সম্মান দেখাচ্ছেন এটি বড় বেশি প্রয়োজন ছিল আমাদের।
আমাদের ছেলেবেলাগুলো এখন রূপকথার মতো। এই প্রজন্মের কাছে হয়তো কথাগুলো অবান্তর মনে হতে পারে। এরপর সূচনা হলো সম্পূর্ণ অন্য যুগের। এলো মোবাইল যুগ। রাতারাতি বদলে গেল চিরন্তন সমাজ পাঠের ধারণা। ধাপে ধাপে এলো ফেসবুক, গেমস, অ্যাপস, ইউটিউব ইত্যাদি শব্দগুলো।
শৈশব কৈশোর বন্দি হতে থাকলো চার দেয়ালের কারাগারে। ফুটবল-ক্রিকেটও এবার বন্দি হতে শুরু করেছে ছোট্ট যন্ত্রটির মধ্যে। ঈদ-পূজা-পার্বণে স্কুল কলেজ ছুটির বিষয়টি এখন এই সময়ের শিশুদের কাছে শুধুই মোবাইলে বুদ হয়ে উপভোগ করার সুযোগ। এরা ক্রমাগত ঘরের ভেতরে অবস্থান করছে। বাহির এদের টানে না। এর ফলে ঘটছে সাংস্কৃতিক বিপর্যয়।
এই বিষয়টি ব্যক্তি ভাবনা, সমাজ ভাবনা এবং রাষ্ট্রীয় ভাবনায় উপেক্ষিত থেকে গেছে। এই প্রজন্ম ঈদের ছুটিতে ভাইবোন বন্ধুবান্ধব মিলে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে না (সবাই এক দোষে দোষী নয়)। স্কুলগুলোয় সাপ্তাহিক নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, কবিতা নাটকের ক্লাসগুলো আর নেই। সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধী একটি রাষ্ট্র তৈরি করার যে নীলনকশা তাকে নীরবে আমরা মেনে নিলাম।
আমরা নিজেরা একসময় সব ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, রাজপথ কাঁপিয়ে আন্দোলন করেছি। অথচ হঠাৎ করে নিজেদের ভোল পাল্টে ফেললাম। নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে কোন এক অদ্ভুত গোঁড়ামি অন্ধত্ব প্রশ্রয় দিতে দিতে কখন যেন নিজেদের মূল নিজেরাই উপড়ে ফেললাম।
কয়েকদিন আগে এক কলিগের সাত বছর বয়সী বাচ্চার গল্প শুনছিলাম। সে নাকি আজকাল বাইরে কোথাও যেতে চায় না। কোথাও যাওয়ার কথা বললেই বলে ওঠে, মা আমি একাই বাসায় থাকি। মা আমি না যাই। একটু ক্রিকেট খেলব। বাসার সবাই অবাক হয়। মানে? সে মোবাইলে ক্রিকেট খেলবে।
কলিগ বললেন, তার ঘরে মোবাইল নিয়ে চূড়ান্ত বাধ্যবাধকতার পরও এই অবস্থা। যারা নির্দ্বিধায় সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মোবাইল তাদের কী হাল হতে পারে! আগামী প্রজন্মের মানুষগুলো কি তবে কিছুটা হিম্যান গোছের হবে? অথবা মোবাইল কম্পিউটার চালাতে চালাতে কাঁধ আর সব নুয়ে পড়বে মাটিতে। দোষ ওদের না, দোষ সিস্টেমের।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দিয়ে তো লাভ নেই। ফিরে তাকানো দরকার নিজেদের কৃতকর্মের দিকে। আমরা মোবাইল সেনসেশন তৈরি করব, আমরা নিত্যনতুন ভোগ্য পণ্যের সেনসেশন তৈরি করব, আর ভাববো আহা, আমাদের সোনালি অতীত? এরা সব উচ্ছন্নে গেল। তাহলে চলবে কেন?
আসলে আমরা জানলামই না খুব সতর্কভাবে এই প্রজন্মের মস্তিষ্ককে আমরাই অলস বিকল বানিয়ে রেখেছি। ওরা শুধু দৌড়াবে কিন্তু সেটাও আমার কথা মতো। ওরা দৌড়বে শুধু সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবার জন্য। এটা ওদের প্যাশন নয়।
উৎসবের দিন এই আমাদের প্রজন্মের অভিভাবকরাই তো সন্তানদের পারিবারিক আয়োজনে না গিয়ে বার্গার শপে নিয়ে যাচ্ছি। আমরাই ওদের আত্মীয় পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করছি। আমরাই ওদের সম্পদ গরিমায় গর্বিত হতে শিখিয়েছি।
পরিচিত একজন গল্প শোনাচ্ছিলেন তার ছেলের। কোনো এক ঈদে তার বাসায় একজন বয়স্ক আত্মীয় এসেছিলেন। সবাই মিলে ছবি তোলার সময় তার ছেলেটি ছবি তুলবে না। কেন? কারণ সেই আত্মীয় খানিকটা অসচ্ছল হয়তো, বেশভূষায় কিছুটা মলিন। পরিচিতজন কতটা গর্বিত এবং দেখেন লজ্জায় লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, দেখেন তো আপা ছেলের কাণ্ড। উনার কথা শুনে আমিই লজ্জায় মরি মরি অবস্থা।
নির্জন সময়ে বসে ভাবি সেদিন বুঝি আর বেশি দূরে নেই। আমাদের ঈদ-পূজা-পার্বণগুলো বাঁচানোর লড়াইয়ে বুঝি নামতে হবে একদিন। বুড়ো বয়সে গহীন অন্ধকারে পথতো খুঁজে পাবোই না, লণ্ঠন বাতির ক্ষীণ হয়ে আসা আলোটুকু নিভে যাবে হয়তোবা। তবুও আমি আশার আলো বুকে বেঁধে বিশ্বাস করি কল্যাণকর হবে আগামী।
একদিন হয়তোবা কেউ একজন এসে বদলে দেবে সবকিছু। অথবা কয়েকজন আলোকিত মানুষ আমাদের হাতে নিভে যাওয়া লণ্ঠনে নতুন সলতে জেলে দেবে নিশ্চয়ই।
লেখক: কাকলী প্রধান – আলোকচিত্রী।