1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

শোষণমুক্তির বাকশাল ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু

হাসান মোর্শেদ : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আয়ুসীমা মোটেও দীর্ঘ নয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যখন তাকে হত্যা করা হয়, বয়স কেবল মধ্য পঞ্চাশ। এ আয়ুসীমার ভেতরে তিনি একটি স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার অতুলনীয় গৌরবে ভূষিত হয়েছেন, তার নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণের নেতৃত্বও তিনিই দিয়েছেন। প্রায় তিন যুগের রাজনৈতিক জীবনে তার চূড়ান্ত ও সর্বশেষ রূপকল্প ছিল ‘‌বাকশাল’। বাকশালের আদর্শিক ও আইনি পরিকাঠামো তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন, কিন্তু বাস্তবায়নের আগেই তাকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী অবৈধ সামরিক শাসনামলের নির্মিত প্রচারণায় ‘‌বাকশাল’ একটি ট্যাবুতে পরিণত হয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীরাও স্পষ্ট আলোচনার বদলে বাকশাল বিষয়ে নানা স্ববিরোধী মতামত প্রচার করেছেন।

পূর্ববঙ্গীয় ২০ বছরের একজন তরুণ হিসেবে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় যার রাজনৈতিক জীবনের শুরু, জীবনের শেষ পর্যন্ত তার রাজনীতি একটা নির্দিষ্ট ছন্দে গাঁথা। তিন যুগের রাজনীতিতে কোনো স্ববিরোধিতা নেই, বরং সময়ের প্রয়োজনে ঋদ্ধ হয়ে ওঠার স্পষ্ট উদাহরণ রয়েছে, রয়েছে পরস্পর সম্পর্কিত পরম্পরা। তাই ‘‌বাকশাল’ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু মানস বুঝতে হলে তার সমগ্রকে বোঝা জরুরি, না হলে তা খণ্ডিত ও বিকৃত অনুধাবন হবে।

তরুণ বয়সে যে পরিপ্রেক্ষিত ও সময়ে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িত হয়েছেন সেই ক্রান্তিকালে মুসলিম লীগই হয়ে উঠেছিল অধিকারবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র। মুসলিম লীগের ভেতরেও জমিদার ও সামন্ত শ্রেণীর শক্তিশালী কর্তৃত্ব ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান যে বলয়ের কর্মী ছিলেন, সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন সে বলয়টি প্রগতিশীল বলে পরিচিত ছিল। দেশ বিভাগের পর তিনি ও তার বন্ধুরা যখন ঢাকায় ফিরে আসেন, মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম কোণঠাসা, খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে সামন্তবাদীরাই ক্ষমতায়। ফলে শেখ মুজিবসহ প্রগতিশীল তরুণরা রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন।

এ অবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক গণবিরোধী মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করেই পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের নতুন রাজনীতির সূচনা। ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের লেজুড় ছাত্র সংগঠনের মোকাবেলায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘‌পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’, ১৯৫৩ সাল থেকে যা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ হয়ে সব সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল ছাত্রদের শক্তিশালী সংগঠন হয়ে ওঠে। এ সময় তিনি প্রান্তিক কৃষকদের অধিকার আদায়ে ‘‌দাওয়াল’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দরিদ্র মানুষকে নিয়ে ভুখা মিছিল সংগঠিত করেছেন, ভাষা আন্দোলনের প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শাস্তির শিকার হন।

২৩ জুন ১৯৪৯ নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচন করা হয় তখনো তিনি কারাবন্দি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন ইশতেহারে, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে ভূমির ওপর সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘‌প্রত্যেককে থাকিবার মতো আবাস দিতে হইবে’। বৃদ্ধ, এতিম, অক্ষম ও অসুস্থদের ভাতা প্রদান রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বলে দাবি করা হয়েছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মওলানা মওদুদী এসে ফতোয়া জারি করেন, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ অনৈসলামিক। এর জবাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬, করাচিতে পাকিস্তান আইন পরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘‌একজন ৫০ হাজার একর জমির মালিকানা নিয়ে আরামসে ঘুমাবে আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধায় মারা যাবে, এটার নাম ইসলাম? এটা ইসলামের অবমাননা। এ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা হলে আগামী প্রজন্ম এটা অস্বীকার করবে, তারা ইসলাম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে।’ শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ সামন্ততান্ত্রিক মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গণমানুষের অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, ১৯৫৫ থেকে এটি ‘‌পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’-এ পরিবর্তিত হয়ে সব সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে ওঠে। ১৯৫৭ সালে সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট ভাবাপন্নরা আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন, পরে তারা নিজেরাও পিকিংপন্থী-মস্কোপন্থী দুই ভাগে বিভক্ত হন। বর্ষীয়ান সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের চলে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য বিপৎসংকুল পরিস্থিতি হলেও তরুণ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তিনি যেমন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি পুনঃস্থাপন করেন, তেমনি নিজের এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্র সুস্পষ্ট করে তোলেন। ১৯৬৪ সালের সম্মেলনেই আওয়ামী লীগ অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করে। ১৯৬৬ সালে তার ঘোষিত ঐতিহাসিক ছয় দফা বৈষম্যবিরোধী অর্থনৈতিক সাম্যবাদের এক উজ্জ্বল দলিল। পাকিস্তানের বিদ্যমান কাঠামোতে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কতটা স্পষ্ট, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানকে কীভাবে উপনিবেশ হিসেবে শোষণ করে যাচ্ছে, এ শোষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে কী কী করতে হবে, এর রূপকল্প তিনি ছয় দফা কর্মসূচিতে ঘোষণা করেন। সম্পদ লুণ্ঠন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো জটিল বিষয় তত্ত্বের বাইরে একেবারে সহজ-সরলভাবে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে এক অবিস্মরণীয় গণজাগরণ গড়ে তোলেন তিনি। যদিও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা একে ‘‌সিআইএর দলিল’ বলে প্রত্যাখ্যান করে সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে সহায়তা করেন, মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিও প্রথমদিকে নিরুৎসাহিত থাকে। কিন্তু শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক ছয় দফা এ দেশের সাধারণ মানুষকে যেভাবে আলোড়িত করে তা অভূতপূর্ব।

১৯৬৬ সালের বিশেষ পরিস্থিতিতে নতুন সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফার প্রশ্নে প্রাচীনপন্থী আওয়ামী লীগারদের অনেকেই দলত্যাগ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান সারা দেশ চষে বেড়িয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি সুদৃঢ় করেন, একই সঙ্গে ছড়িয়ে দেন ছয় দফাভিত্তিক শোষণমুক্তির স্বপ্ন। এ স্বপ্নের ভিত্তিতেই ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়, ’৭১-এর মার্চের শুরু থেকে অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তি তাই কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে সামন্তবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের গণমুখী রাজনীতিচর্চার পরম্পরা মাত্র। ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তিনদিন পর বঙ্গবন্ধু তার আহূত প্রথম সংবাদ সম্মেলনে অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় গণতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্য ঘোষণা করেন।

১৯৭২ সালের সংবিধানে সমাজতন্ত্রের ধারণাটি খুবই স্বচ্ছ। অনুচ্ছেদ ১০-এ বলা হয়েছে, মানুষের ওপর মানুষের শোষণবিহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা। অনুচ্ছেদ ১১-তে গণতন্ত্রবিষয়ক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। দুটি অনুচ্ছেদ মিলিয়ে পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, ১৯৭২ সালের সংবিধানেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে শুরু থেকে কলকারখানা, ভারী শিল্প জাতীয়করণ করা হয়েছে। খনিজ ও সমুদ্রসম্পদ, নদী ও সমুদ্রবন্দরে জনগণের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ঘোষিত হয়েছে।

‘‌সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি’ প্রয়োগ করাকেই ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লব বলে ঘোষণা করেছেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার সর্বজনীন প্লাটফর্ম হিসেবে গঠন করেছিলেন বাকশাল।

এর মাধ্যমে কি তিনি সারা জীবনের চর্চিত গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করেছিলেন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতা, অর্থনৈতিক পদ্ধতি হিসেবে সমাজতন্ত্রে প্রতীতি কিন্তু কখনই কমিউনিস্ট নন। তিনি বলপ্রয়োগে ক্ষমতা দখল করে পদ্ধতি বদলাতে চাননি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পদ্ধতিতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাও কায়েম করা হয়নি। বরং সর্বজনীন রূপ দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করতেও দ্বিধা করেননি। মস্কোপন্থী ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি স্ব-উদ্যোগে অংশ হয়েছিল বাকশালের। প্রবল রাজনৈতিক বিরোধ চলমান থাকা সত্ত্বেও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মওলানা ভাসানী বাকশালকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। জাসদ নেতৃত্বের সঙ্গেও আলোচনা চলছিল। এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত মাওবাদী নেতা কমরেড আব্দুল হকের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর বাকশালবিষয়ক আলোচনার তথ্য পাওয়া যায়।

পৃথিবীর সব সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মতোই বাকশাল পরিকল্পনার কেন্দ্রে ছিল গ্রামভিত্তিক ৬৫ হাজার সমম্বিত কৃষি সমবায়। এটি তার নিজের কোনো উদ্ভাবন নয় বা অন্য কারো কাছ থেকে তিনি ধারণা আমদানি করেননি। কৃষিভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রয়োগে তৎকালীন সময়ে সারা পৃথিবীতেই এটি একটি সাধারণ চর্চা ছিল। বাংলাদেশের বাস্তবতায় পরিকল্পনা হয়েছিল ৫০০ থেকে ১০০০ পরিবারের সমন্বয়ে এক একটি সমবায় গড়ে উঠবে। সমবায়গুলো হবে দেশের অর্থনৈতিক ইউনিট, ইউনিয়ন পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সরকারের উদ্যোগে বিনামূল্যে সার, বীজ, সেচ সরবরাহ করা হবে। জমির সব উৎপাদন বিভক্ত করা হবে তিন ভাগে। এক ভাগ জমির মালিক, এক ভাগ স্থানীয় সমবায় এবং এক ভাগ সরকার। দেশের সব কর্মক্ষম বেকার ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠী সমবায়ের সদস্য হবে এবং তা থেকে সমান হিস্যা পাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার গণতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে একটি নতুনত্ব এনেছিলেন—কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের মতো জমির মালিকানা সরকার অধিগ্রহণ করবে না, জমির মালিক কৃষকই রয়ে যাবেন।

কেন বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই বাকশাল কার্যক্রম শুরু করলেন না: এর জবাব রয়েছে ইতিহাসের আঙিনায়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সফল হয়, কিন্তু কমরেড লেনিন ১৯২১ সালে ঘোষণা করেন ‘নিউ ইকোনমি পলিসি’। প্রথম কয়েক বছর বলশেভিকদের মনোযোগ দিতে হয়েছিল অন্তর্ঘাত ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সোভিয়েতকে সংহত করতে। কিছুটা স্থির হওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতি প্রণীত হয়। বঙ্গবন্ধুকেও প্রথম তিন বছর সব মনোযোগ দিতে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন রাষ্ট্রের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলায়, অন্যান্য রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের জন্য। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা টেকসই ও স্থিতিশীল করার জন্য এ কাজগুলো ছিল সবচেয়ে জরুরি। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার পর মনোযোগ দিতে হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়।

কেউ কেউ বলতে চান, প্রথম তিন বছরের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বাংলাদেশবিরোধী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড, ’৭৪-এর বন্যা ও দুর্ভিক্ষে ব্যাপক প্রাণহানি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্য ফিরিয়ে নেয়ার মতো বিষয়গুলো তাকে চরম সিদ্ধান্ত নিতে প্রণোদিত করে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে প্রতীতি তো বঙ্গবন্ধুর হঠাৎ মরিয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়, বরং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম তিন বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ঔপনিবেশিক আমলের প্রশাসনিক পদ্ধতি দিয়ে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কাজ কোনোভাবে সম্পন্ন করা গেলেও ‘‌দ্বিতীয় বিপ্লব’ তথা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সে কারণেই তিনি প্রশাসনিক পদ্ধতির খোলনলচে পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন। প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে আমলা, রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনীসহ সবার সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করে উৎপাদন বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটানো। বাকশালের ঘোষিত প্রোগ্রামও এ চারটিই—জাতীয় ঐক্য, উৎপাদন বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে ৬৪টি মহকুমাকে ৬৪টি জেলায় উন্নীত করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য আদালতের কার্যক্রম গ্রামভিত্তিক করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

একজন অকমিউনিস্ট, জাতীয়তাবাদী নেতার পক্ষে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব ছিল কিনা: খেয়াল রাখা জরুরি, বঙ্গবন্ধু বিশ শতকের উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রবল জাতীয়তাবাদীদের একজন, যাদের নেতৃত্বে আফ্রো-এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো পরাধীনতামুক্ত হয়েছিল। নিজ নিজ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার এ মহানায়করা প্রায় সবাই অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার প্রয়োজনে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন। যেমন তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ার, আলজেরিয়ার বুমেদিন, মিসরের গামাল আবদুল নাসের। এদের অনেকের কমিউনিস্ট ব্লকের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও আত্মমর্যাদার জায়গা থেকে তারা ব্লকভুক্ত হননি। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার, কিন্তু একই সঙ্গে সতর্ক ছিলেন শীতল যুদ্ধের সেই জটিল সময়ে বাংলাদেশ যেন কোনো কূটনৈতিক যুদ্ধের শিকার না হয়। মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের বৈরী ভূমিকা মাথায় রেখেও পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে তিনি মার্কিন ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা গ্রহণ করেন। একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে নিজেদের প্রয়োজন মেটানো ও স্বার্থ সংরক্ষণ ছিল তার প্রধান ভাবনা। যেমন মিসরের নাসের সুয়েজ খাল নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে লড়েছেন, কমিউনিস্ট ব্লকেরও পক্ষভুক্ত হননি, কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতি ভেঙে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভূমির অধিকার প্রদানসহ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সফলভাবেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব ‘‌বৃষস্কন্দ মহানায়কের’ জাতীয়তাবাদ ইউরোপের আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদের শিকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ও আত্মরক্ষার হাতিয়ার। সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তির ষড়যন্ত্রে এদের অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করতে পারেননি, নানাভাবে তাদের বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার ‘‌দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর মঞ্চ বাকশালকে নিন্দায় মুড়িয়ে পরিত্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ‘‌মানুষের ওপর মানুষের শোষণবিহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ’-এর স্বপ্ন এখনো নিহত নয়, এখনো নয় পরিত্যক্ত। ভিন্ন সময়ে ভিন্ন নামে হলেও এ স্বপ্ন চিরজাগরূক। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন, সর্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক, ১৩ লাখ ভূমিহীনকে ভূমির মালিকানাসহ গৃহ প্রদান, জবাবদিহিতামূলক সমন্বিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা—এসবই মনে করিয়ে দেয় কোথাও সেই স্বপ্নের বীজ লুকিয়ে রয়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের আয়ুসীমা পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল।

লেখক : হাসান মোর্শেদ – গবেষক, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ গ্রন্থের রচয়িতা


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ