1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন

তাহসিন ফারজানা : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৩

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১৬ আগস্ট পর্যন্ত চলতি বছরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৯২ হাজার ২৪ জন এবং মারা গেছে ৪৩৫ জন। এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার। এর আগে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ২৮১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে ২০০০ সালের পর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু প্রথম ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ওই বছর মোট এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল, মারা গিয়েছিল ১৬৪ জন। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পিক সিজন ধরা হয়। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ বছর ডেঙ্গু আরো ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে।

এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই, নেই কোনো কার্যকর সহজলভ্য ভ্যাকসিন।

ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হয় উপসর্গভিত্তিক। ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণের নতুন কোনো পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়নি। অদ্যাবধি বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণ। এডিস মশা নিধনের জন্য সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।

সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলো হচ্ছে—১. কেমিক্যাল পদ্ধতি : মশা যাতে না কামড়ায় তার জন্য মশার কয়েল বা স্প্রে বা মশারোধী ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা যায়। লার্ভাসাইড ব্যবহার করে মশার লার্ভা ধ্বংস করতে হবে এবং অ্যাডাল্টিসাইড ব্যবহার করে পূর্ণাঙ্গ মশা দমন করতে হবে। ২. বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক পদ্ধতি : বিভিন্ন দেশে এডিসবাহিত রোগ প্রতিরোধে কিছু বায়োলজিক্যাল পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিটিআই (ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস)। এটি এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা মশার লার্ভাকে মেরে ফেলতে পারে।

এ ছাড়া গাপ্পি মাছ ও কপেপোড নামের এক প্রকার আর্থ্রোপোডা মশার লার্ভা দমনে ব্যবহৃত হয়। জৈবিক পদ্ধতির আরেকটি হচ্ছে স্টেরাইল মেইল টেকনিক, এই পদ্ধতিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে একটি প্রাণঘাতী জিন পুরুষ মশায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। গবেষণাগারে সৃষ্ট এসব পুরুষ মশা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হলে প্রকৃতির স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হয়ে এরা যে প্রজন্ম সৃষ্টি করে সেগুলো বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের আরেকটি পদ্ধতি হলো উলবাচিয়া পদ্ধতি। উলবাচিয়া হচ্ছে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া, এডিস মশার শরীরে এই উলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হলে সেই মশাগুলো ডেঙ্গু ছড়াতে পারে না। কারণ উলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া মশার ভেতরে ডেঙ্গু ভাইরাসকে রেপ্লিকেশন বা প্রতিলিপি তৈরি করতে দেয় না। জৈবিক পদ্ধতিগুলো ব্যয়বহুল হওয়ায় বাংলাদেশে এখনো সফলভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। ৩. পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা বা এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট : এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে এ পদ্ধতির বিকল্প নেই। মশার প্রজননস্থলগুলোকে ধ্বংস করতে হলে বাড়িতে এবং আশপাশে বদ্ধ বা জমানো পানির পাত্র দু-এক দিন পর পর পরিষ্কার করতে হবে। ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোল, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। ৪. জনসাধারণের সম্পৃক্ততা বা কমিউনিটি ইনভলভমেন্ট : জনগণের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছাড়া কখনোই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর জন্য ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমন্বয় প্রয়োজন। প্রয়োজনে আইন করে বা শাস্তির বিধান রেখে এডিস মশা দমনে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ৫. ব্যক্তিগত সুরক্ষা বা পারসোনাল প্রটেকশন : ডেঙ্গু মোকাবেলায় সর্বপ্রথম প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুরক্ষা। পরিবারের লোকজনকে যাতে মশা না কামড়ায় তার জন্য মশার কয়েল বা স্প্রে বা মশারোধী ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করতে হবে। দিনে ও রাতে ঘুমালে অবশ্যই মশারি টানিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে। শরীর কাপড় দিয়ে যথাসম্ভব ঢেকে রাখতে হবে।

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের গতানুগতিক পদ্ধতিগুলো এখন আর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। বাংলাদেশে মশা নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে কীটনাশক প্রয়োগ। দুটি পদ্ধতিতে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়, লার্ভিসাইড হিসেবে মশার লার্ভা নিধনের জন্য এবং অ্যাডাল্টিসাইড হিসেবে পূর্ণাঙ্গ মশা দমনের জন্য। অ্যাডাল্টিসাইড প্রয়োগের একটি মাধ্যম হচ্ছে ফগিং। কোনো একটি এলাকায় একজনও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে ফগিং পদ্ধতি শুরু করা হয়। দুই ধরনের ফগিং পদ্ধতি রয়েছে—থার্মাল ফগিং ও কোল্ড ফগিং বা আলট্রা লো ভলিউম (ইউএলভি) ফগিং। থার্মাল ফগিংয়ে তাপের সাহায্যে তরল কীটনাশককে বাষ্পীভূত করে বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যেটি তীব্র ধোঁয়ার সৃষ্টি করে। থার্মাল ফগিংয়ে ড্রপলেট বা পার্টিকল সাইজ হচ্ছে ০.০৫-১০ মাইক্রন। অন্যদিকে কোল্ড ফগিং বা ইউএলভি ফগিংয়ে বাতাসের চাপকে ব্যবহার করে কীটনাশক থেকে ঠাণ্ডা স্প্রে তৈরি করা হয়, যার ড্রপলেট সাইজ হচ্ছে ৫-২০ মাইক্রন। কোল্ড ফগিংয়ে দৃশ্যমান ধোঁয়া তৈরি হয় না।

ফগিংয়ের সীমাবদ্ধতা আছে। শুধু রাস্তার পাশে বা ঝোপঝাড়ে ফগিং করে এডিস মশা নির্মূল করা কঠিন। ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি হচ্ছে আরবান মসকুইটো বা শহুরে মশা। এদের ডোমেস্টিক মসকুইটো বা গৃহপালিত মশাও বলা হয়। ফলে এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির মশাগুলো মানুষকেই কামড়াতে পছন্দ করে বা কামড়ায়। এটিকে বলা হয় এনথ্রোপোফিলিক বিহেভিয়র। তাই এডিস মশা সাধারণত ঘরের অন্ধকার কোনে, যেমন—খাটের নিচে, টেবিলের নিচে, শোফার নিচে বিশ্রাম নেয় এবং এদের ওড়ার ক্ষমতা খুবই সীমিত। যার ফলে রাস্তায় বা ঘরের বাইরে ফগিং করে এডিস মশাকে কাবু করা কঠিন। তা ছাড়া অনিয়মিত ফগিং, অপরিমিত কীটনাশকের ব্যবহার, আনাড়ি অপ্রশিক্ষিত জনবল ইত্যাদি কারণে মশার শরীরে ইনসেক্টিসাইড রেজিস্ট্যান্স বা কীটনাশক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ফলে ওই কীটনাশক দ্বারা তৈরি কোনো কয়েল, স্প্রে বা ফগিং দ্বারা পরবর্তী সময়ে আর মশা মারা যায় না। যার কারণে ফগিং পদ্ধতির ওপর জনগণের আস্থাও কমে যায়। এ ছাড়া জনমনে একটা আশঙ্কা রয়েছে যে ফগিং জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ফগিংয়ের মাধ্যমে যে ছোট ড্রপলেটগুলো তৈরি হয়, সেগুলো শুধু মশা বা অন্য পোকামাকড়কেই মারতে পারে, মানুষ বা অন্য কোনো বড় জীবের ক্ষতি করতে পারে না। তবে ফগিংয়ের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ায়, বিশেষ করে অ্যাজমা রোগী, শিশু ও বয়স্ক মানুষের শ্বাসকষ্ট এবং ত্বকে, চোখে বা গলায় জ্বালাপোড়া হতে পারে। এ ছাড়া ফগিংয়ের ধোঁয়ার দুর্গন্ধও অনেকে সহ্য করতে পারে না। ফগিংয়ের সফলতার আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ঘরের ভেতর ফগিং করতে না পারা। সাধারণত কয়েকটি কারণে ফগিংকর্মীকে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এগুলো হচ্ছে নিরাপত্তাজনিত কারণ। ফগিংয়ের প্রতি জনমনে আস্থার অভাব ও বিষক্রিয়ার ভয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফগিংয়ে কোনো এলাকার ৯৫ শতাংশ স্থান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা না হলে বেঁচে যাওয়া মশা আবার বংশ বৃদ্ধি করে এবং এদের শরীরে ইনসেক্টিসাইড রেজিস্ট্যান্স বা কীটনাশক প্রতিরোধ গড়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া ইনডোর ফগিং প্রত্যাখ্যানের কিছু সামাজিক ডিটারমিন্যান্ট বা নির্ধারক রয়েছে। যেমন : মশাবাহিত রোগ সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান, কীটনাশকের বিষক্রিয়ার ভীতি, স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সঠিকভাবে তথ্যবিনিময়ের অভাব, ফগিংয়ের কার্যকারিতা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ইত্যাদি।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে ফগিং হচ্ছে সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার কেমিক্যাল পদ্ধতির একটি অংশমাত্র। এর পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণের অন্য পদ্ধতিগুলোও সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সর্বোপরি জনগণের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই শুধু এডিস মশা, তথা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

লেখক: তাহসিন ফারজানা – অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

সূত্র: কালের কন্ঠ


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ