1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ : সব কালো ও অন্ধকার পেছনে ফেলে

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৬ সেপ্টেম্বর কালিমালিপ্ত একটি দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারীদের আইনি সুরক্ষা দিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদ ইতিহাসের কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করেন। এই অধ্যাদেশের সুরক্ষা কবচের জোরে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সদম্ভে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পান। পরবর্তীকালে ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব অন্যায় অবিচারের সাংবিধানিক বৈধতা দেন। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের মতো কালো আইন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতালোভীরা পরিকল্পিত উপায়ে যে দুঃসহ ঘটনার জন্ম দেয় অনুরূপ ঘটনাও পৃথিবীতে বিরল! মূলত নানারূপ বিরল ঘটনার জন্ম দিয়ে জনমনে ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশকে তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। একটি স্বাধীন দেশ রাতারাতি পরাজিত শত্রুপক্ষের আদর্শ কী করে ধারণ করতে পারে তা দেখেও তৎকালীন বিশ্ব বিস্ময়াভিভূত হয়েছিল!

স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটার পর কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র আর অপকৌশলে তারা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের বিপরীতে বাঙালির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের নেশায় মেতে উঠেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা তাদের ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। অতঃপর ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডকে ‘জায়েজ’ করার লক্ষ্যে একের পর এক মিথ্যা অপপ্রচার এবং ইতিহাসের বিকৃতি ঘটায়। জাতির সামনে মিথ্যা ইতিহাসের পাহাড় গড়ে তোলে! মিথ্যা ইতিহাসের উপর্যুপরি চর্চার মধ্য দিয়ে সাধারণের মন ও মগজে মিথ্যাটাকে সত্যে রূপ দেয়ার কৌশল গ্রহণ করে। মানুষকে বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। এই অপশক্তি ২১ বছর মিথ্যা ইতিহাসের বেসাতি করে। বিকৃত ইতিহাসচর্চার এই দীর্ঘ সময়ে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে তাদের অধিকাংশের মধ্যে কলঙ্কিত মিথ্যারই অদৃশ্য ছায়াপাত ঘটেছে! ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেয়ার জন্য এরূপ অধ্যাদেশ জারি এবং খুনিদের পুরস্কৃত করাও জাতির আরেক কলঙ্ক! কালো আইনের মাধ্যমে খুনিদের রক্ষার ঘটনা শুধু বিরলই নয়, কলঙ্কজনকও বটে! ইনডেমনিট অধ্যাদেশ শুধু বাঙালি সমাজই নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসকেও কলঙ্কিত করেছে।

সাম্প্রতিককালে নানা বিষয়ে রাজনৈতিক আলোচনায় ওঠে আসছে জেনারেল জিয়ার নাম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী তিনি এবং তার দল বিএনপি। খন্দকার মোশতাক খুনিদের রক্ষার জন্য যে অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন সেই অধ্যাদেশকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে খুনিদের সুরক্ষা দিয়ে তাদের কাছ থেকেও মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা ভোগ করেছিলেন জিয়া। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। খুনিদের বিচারের আওতায় না এনে বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃতও করেন। উপরন্তু খুনিরাও সদম্ভে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা গণমাধ্যমে বলে বেড়ান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বাপর সবকিছুই জানতেন জিয়া। কিন্তু চতুরভাবে তিনি নেপথ্যে থেকেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিলের বিচার আদালতে সাক্ষ্য এরূপ : ১৫ আগস্ট আনুমান ৬টায় মেজর রশিদ তাকে বলেন, We have captured state power under Khandakar Mustaque, Sheikh is killed, do not try to take an action against us. এ কথা শুনে শাফায়াত জামিল হতচকিত হন। দ্রুত ইউনিফর্ম পরে হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা দেন। পথে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যান এবং তাকে শেভরত অবস্থায় দেখতে পান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে জিয়াউর রহমান তখন শাফায়াত জামিলকে বলেন : So what president is killed.
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন : ‘এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয় এবং সে মতে এপ্রিল মাসের এক রাতে তার বাসায় আমি যাই […] আলোচনা হয় এবং সাজেশন চাইলে জিয়াউর রহমান বলেন, তোমরা করতে পারলে কিছু কর। পরে আমি রশিদের বাসায় গিয়ে জিয়ার মতামত তাকে জানাই। রশিদ তখন বলেন, এ বিষয় নিয়া তোমাকে চিন্তা করতে হবে না […] আমি deal করব। রশিদ পরে জিয়া এবং খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’ প্রখ্যাত বিদেশি সাংবাদিক Lawrence Lifschulty বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন : Ziaur Rahman was passively involved in the assassination of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman.

ইনডেমনিটির মতো কালো অধ্যাদেশ ও আইন নিয়ে যখন আমরা কথা বলি তখন বিএনপিপন্থিরা খন্দকার মোশতাকের ওপর সব দায়দায়িত্ব চাপিয়ে আলোচনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেন। কিন্তু আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের সব সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্তি স্পষ্ট করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে তার সম্পৃক্তি না থাকলে মোশতাক প্রণীত অধ্যাদেশটিও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হতো না। হত্যাকাণ্ডের নীরব সাক্ষী ও মদদদাতা হওয়ায় জিয়া তার শাসনামলে নিজেকে সুরক্ষাসহ প্রতিহিংসামূলক অনেকগুলো বিষয়ে স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যুক্তরাজ্যের অনুসন্ধান কমিটিকে বাংলাদেশে আসতে বাধা দেয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে জার্মানিতে আশ্রয় দেয়ার জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ওএসডি করা, শেখ রেহানার পাসপোর্ট নবায়ন না করার জন্য লন্ডন দূতাবাসকে নির্দেশ দেয়া, শেখ হাসিনার পাসপোর্ট নবায়ন করায় ভারতে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূতকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রভৃতি। এছাড়া দালাল আইন বাতিল ও কারাগারে অন্তরীণ যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে দেন। ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুগম করে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলি প্রত্যাহার করেন। ১২২ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেন। দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সংসদ সদস্য হওয়ার পথও সুগম করেন জিয়া। এ লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৬ এবং ১২ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ তুলে দেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী এবং আলীমকে মন্ত্রী করেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু যেসব বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন জিয়াউর রহমান পুলিশ ও সেনা সদস্যদের দিয়ে ওইসব বাড়ি থেকে শহীদ পরিবারকে উচ্ছেদ করেন। ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল গেজেটে গোলাম আযমসহ অনেকের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানিদের সহযোগী ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব প্রদান করেন জিয়া। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বেছে বেছে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে হত্যা করেন। নিহতদের অনেকের লাশও পরিবারের কাছে দেয়া হয়নি। জিয়াউর রহমান নির্বিচার হত্যা ও গুম-খুনের মাধ্যমে গোপন ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন। সূকৌশল ও ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে জিয়াউর রহমানই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ইতিহাস নিষিদ্ধ করে বিকৃত ইতিহাসচর্চার ভিত্তি রচনা করেছিলেন। তার এসব কর্মকাণ্ডই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়ার অবস্থান তরুণ প্রজন্মের কাছে আজ প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে! মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভীত থাকার কারণেই তার সময়ে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় বাংলা’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহারও নিষিদ্ধ করেন। ‘বীর-উত্তম’ খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তিনি পাকিস্তান-প্রীতিতে এতটাই ডুবে ছিলেন যে, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’ বলায়ও এদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছিলেন! এসব কারণেই সাম্প্রতিককালে তার খেতাব প্রত্যাহারের যে কথা উঠেছে তার পটভূমি একেবারেই যে অমূলক তাও মনে হয় না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক জিয়ার সব কর্মকাণ্ডের জন্য পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দানা বেঁধে ওঠে। এছাড়া দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জিয়া সেখানে জাতিকে চরমভাবে বিভক্ত করে ফেলেন।

জিয়ার উত্তরাধিকার হিসেবে বেগম জিয়াও ইতিহাস বিকৃতির ধারা অব্যাহত রাখেন। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পদোন্নতি দেন। শুধু তাই নয়, হঠাৎ করে ১৯৯৩ সাল থেকে জাতির বিষাদঘন ১৫ আগস্টকে নিজের জন্মদিন হিসেবে পালন শুরু করেন! কালান্তরে প্রকাশিত বেগম জিয়ার ৬টি জন্মদিন থাকলেও আনন্দোৎসবে মগ্ন রেখে সাধারণের মন থেকে ১৫ আগস্টের শোককে ভিন্ন খাতে প্রবাহের জঘন্যতম রাজনৈতিক অপপ্রয়াসও চালিয়ে যেতে থাকেন!
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সংসদে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স রোহিতকরণ বিল আনে। এই বিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত করে। উল্লেখ্য, সেদিন সংসদ অধিবেশনে বিএনপির সব সদস্যই অনুপস্থিত থাকেন। উপরন্তু দায়রা জজ আদালতকর্তৃক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন বিএনপি হরতালও পালন করে! মহামান্য উচ্চ আদালত ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করলে জাতির ললাট থেকে চিরতরে কলঙ্কচিহ্নের অপনোদন ঘটে।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলসহ বিএনপি-জামায়াতের নানারূপ বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। আত্মস্বীকৃত খুনিদের কেউ কেউ বিদেশে অবস্থানের কারণে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। দ্রুত আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে জাতির কলঙ্ক মোচন করা হবে বলে আমাদের আশা। সব কালো ও অন্ধকার পেছনে ফেলে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ অসীম আলোর আহ্বানে ধাবমান।

লেখক- আহমেদ আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। aislam.ju@gmail.com


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ