1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ডেঙ্গু থেকে গর্ভবতী মায়েদের সতর্কতা

লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

যেকোনো দেশে দুর্যোগ, মহামারি, অতিমারির প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে নারী, শিশু ও বয়স্করা। এর মধ্যে গর্ভবতী নারী ও গর্ভের শিশুর ঝুঁকি মারাত্মক পর্যায়ের। এ বছর ভয়ংকর হয়ে ওঠা ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ডেঙ্গুতে এক বছরে এত মৃত্যু আগে কখনো দেখেনি বাংলাদেশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী চলতি বছর দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু শনাক্তদের মধ্যে ৬২.৩০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭.৭ শতাংশ নারী। তবে মৃতদের মধ্যে শতকরা হিসাবে ৫৭.৩৯ শতাংশই নারী। তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে পুরুষরা আক্রান্ত বেশি হলেও মৃত্যুতে নারীর হার বেশি। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এ হার আরো বেশি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, গর্ভবতী নারীর ডেঙ্গু হলে মৃত্যুঝুঁকি তিন গুণ বেড়ে যায়।

বিভিন্ন কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীদের শারীরিক জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি বেশি। আইসিডিডিআরবির  মতে, বাংলাদেশে এখনো ১.৭ কোটি প্রজননক্ষম নারী অপুষ্টিতে ভুগে থাকেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ২৫ ভাগের কম ওজন এবং ২০ ভাগ খর্বাকৃতির।

অপুষ্টিতে ভোগা নারীর দেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও স্বভাবতই কম থাকে। এটি ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীর শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ার অন্যতম কারণ। নারীদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় জৈবিক প্রক্রিয়া, যেমন—গর্ভাবস্থা, মাসিক ঋতুস্রাব ইত্যাদি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা আরো হ্রাস করে।গর্ভাবস্থার প্রথম ও শেষ দিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ঝুঁকির পরিমাণ বেশি। প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং গর্ভের শিশুর গঠনপ্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।

গর্ভবতী মায়ের শরীরে বিভিন্ন জটিল রোগ, যেমন—প্রি-একলাম্পশিয়া, একলাম্পশিয়া, জরায়ুতে পানি কমে যাওয়া এবং সিজার অপারেশনের মাধ্যমে প্রসবের হার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ও শেষ তিন মাসে মায়ের ডেঙ্গু সংক্রমণ হলে বাচ্চার অকাল প্রসব ও বাচ্চা ওজনে কম হতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত মায়ের রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায়। শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার যে প্রক্রিয়া, তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কারো কারো দাঁতের গোড়া, চোখ ও নাক দিয়ে রক্ত বের হয়। গর্ভবতী মায়ের এ ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে মা ও সন্তান দুজনেরই মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেকের প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুও হতে পারে।গর্ভবতী মা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত তাঁদের শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সেপটিসেমিয়া দেখা যেতে পারে। এ অবস্থায় রক্তচাপ কমে যাওয়া ও অন্যান্য জটিলতায় হঠাৎ শক সিনড্রোমে চলে যাওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। মা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে মায়ের শরীর থেকে গর্ভের সন্তানের শরীরে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। এ কারণেও গর্ভে বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে বা জন্মগত নানা ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মের ঝুঁকি তৈরি হয়।

ডেঙ্গু ভাইরাস মায়ের শরীর থেকে গর্ভের সন্তানের শরীরে যেতে পারে, বিশেষ করে গর্ভের শেষ দিকে এবং সন্তান প্রসবের সময় মা আক্রান্ত থাকলে এই সমস্যা বেশি হয়। ফলে  জন্মের পরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে নবজাতক। এ ক্ষেত্রে নবজাতকের হাসপাতালে ভর্তি, আইসিইউতে স্থানান্তর এবং অনেক ক্ষেত্রে ভেনটিলেটর ব্যবহারেরও প্রয়োজন হয়।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায় যে ডেঙ্গু আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের অকালে সন্তান প্রসব, কম ওজনের নবজাতক প্রসব, অকাল গর্ভপাত, প্রি-একলাম্পশিয়া, একলাম্পশিয়া, গর্ভে শিশুর মৃত্যু ইত্যাদির ঝুঁকি থাকে। গবেষণার তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ গর্ভবতী মায়ের সিজার অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব, ১২ ভাগ মায়ের  পি-একলাম্পশিয়া, ১৬ ভাগের অকালে সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটেছে। অন্য গবেষণায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৭ শতাংশের অকালে সন্তান প্রসব, ৩৩ শতাংশের নবজাতকের কম ওজন, ১৮ শতাংশের গর্ভে পানি  কমে যাওয়া, ১০ শতাংশের গর্ভে সন্তানের মৃত্যু, ৫ শতাংশের অকাল গর্ভপাত, জন্মের পর ৫ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু, ৩ শতাংশ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম ও ১০ শতাংশ নবজাতকের হাসপাতালে ভর্তি এবং আইসিইউ বা ভেনটিলেটর সাপোর্টের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে দ্রুত চিকিৎসাসেবা নেওয়ার প্রবণতা কমের পাশাপাশি একটি বড় অংশের মধ্যে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে উদাসীনতা থাকে। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে নারীরা তাদের যত্ন নেয় ঠিকই, কিন্তু নিজে অসুস্থ হলে গুরুত্ব কম দেয়। অসুস্থ হলে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতাও থাকে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও নারী সদস্যদের প্রতি অবহেলার কারণে দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীর শারীরিক জটিলতা কিংবা মৃত্যুর হার বেশি দেখা যায়।

পরিবারের কোনো নারী গর্ভবতী হলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার এগিয়ে আসতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, জ্বরের লক্ষণ থাকলেও ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয় না। পরীক্ষা না করলে, শুধু উপসর্গ দিয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের মতো প্রায় একই রকম। উচ্চমাত্রার জ্বর, মাথা ব্যথা, বমি, পেশি ও জয়েন্টের ব্যথা এ সময় ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ, গায়ে র‌্যাশও দেখা দিতে পারে। তবে ডেঙ্গু হলেই যে তীব্র জ্বর থাকবে এমনটা নয়। জ্বর ১০০-এর নিচে থাকা অবস্থায়ও অনেকের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। তাই গর্ভবতী নারীর জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা ও ডেঙ্গু শনাক্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ চিকিৎসকদের। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলে বাড়িতে রেখেও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। গর্ভবতী মায়ের মধ্যে যদি বিপদ চিহ্ন দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসকরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের আবাসিক  ব্যবস্থাপনা

গায়ে জ্বর থাকলে পানি দিয়ে শরীরে বারবার স্পঞ্জ করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বেশি পরিমাণে তরল খাবার, বিশেষ করে খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের শরবত, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মাকে সব সময় মশারির ভেতরে রাখতে হবে। গায়ে কয়েক ঘণ্টা অন্তর অন্তর মশা নিরোধীকরণ স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে। মশার কামড় প্রতিরোধে হাত ও পায়ে মোজা ব্যবহার করা যেতে পারে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের হাসপাতাল  ব্যবস্থাপনা

সন্দেহজনক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মাকে দ্রুত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বা জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাছে নিয়ে তাঁদের পরামর্শমতো প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। হাসপাতালে সাধারণত নিম্নোক্ত চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। ডেঙ্গুর ধরন বুঝে প্যারাসিটামল অথবা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। রক্তচাপ অস্বাভাবিক থাকলে স্যালাইন দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। রোগীর শক সিনড্রোম বা রক্তক্ষরণের উপসর্গ থাকলে স্যালাইনের মাধ্যমে শরীরে অ্যালবুমিন প্রদান করা হতে পারে। রক্ত দেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে। রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা আশঙ্কাজনক কমে গেলে বা রক্তরক্ষণ হলে প্লাটিলেট দেওয়ার প্রয়োজন হয়।

মশার বংশবৃদ্ধি ও কামড় প্রতিরোধে করণীয় 

বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে হবে। এডিস মশার ডিম পাড়ার স্থান, যথা—টায়ার, ব্যারেল, প্লাস্টিকের ড্রাম ও জেরিকেনের মধ্যে জমা পরিষ্কার পানি, বারান্দায় থাকা গাছের টব, এসির ট্রে, মাটির পাত্র, ফ্রিজের ট্রে, রান্নাঘরের র‌্যাক, রান্নাঘর বা বাথরুমের পানি জমে থাকা ড্রেন, কুলার, বাথরুম বা সিস্টার্নে থাকা লিকেজ, অব্যবহৃত খোলা বালতি বা পানির পাত্র, ঘর সাজানোর ফুলের টব বা বনসাই প্লান্টের টব বা ইনডোর প্লান্ট টব ইত্যাদি দ্রুত পরিষ্কার এবং জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করতে হবে। যে পানিতে এডিস মশা ডিম দিয়েছে, তা ফেলে দিলেই ডিম ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া সে পানিতে তেল ঢেলে, সাবান দিয়ে কিংবা ভিনেগার মিশিয়ে ডিম ধ্বংস করা যায়। মশা নিধনের জন্য ঘরে-বাইরে স্প্রে করতে হবে। শরীরের খোলা অংশে মশা প্রতিরোধী ক্রিম ব্যবহার করুন। ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার আবশ্যক। এডিস মশা যেহেতু দিনের বেলা কামড়ায়, তাই দিনের বেলা ঘুমানোর সময়ও অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে।

মশা প্রতিরোধী  অ্যারোসল, কয়েল বা ফাস্ট কার্ড গর্ভবতী মায়ের জন্য অনেক সময় ক্ষতিকর; এর পরিবর্তে মসকুইটো কিলার বাল্ব, ল্যাম্প, কয়েল, কিলার ব্যাট, রেপেলার মেশিন, কিলার ট্র্যাপ ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপদে মশা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

লেখক: লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান – চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রেষণে কুয়েতে নিযুক্ত।

সূত্র: কালের কন্ঠ 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ