1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

কারা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চেয়েছিল?

ডেস্ক রিপোর্ট : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

শিরোনামে উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার আদ্যোপান্ত আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনব্যবস্থা তখনই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, যখন নির্বাচনসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো, স্বার্থের বশবর্তী হয়ে কিংবা একটি পক্ষের জন্য নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশে এসব ঘটনাদি শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর, অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের পর দখলকৃত বাংলাদেশে পুরো শাসনব্যবস্থাই ধ্বংস করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থাও পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়। অনেকেই এখন ১৯৭৩ সালের নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রধান নির্বাচনেও তারাই এ কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা-পরবর্তী সরকারে আসীন হয়। কিন্তু ৭৫-পরবর্তী নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণে যে চিত্র পাওয়া যায়, তা সত্যিই ভয়াবহ।

নির্বাচনব্যবস্থার প্রথম মৃত্যু ঘটে জেনারেল জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ/না ভোট অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সারা বাংলাদেশে সরকারি গণমাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনের প্রচারণা চালানো হয়, হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট ফেলে জানান দেওয়া হয় নির্বাচনের। রেডিও (রেডিও বাংলাদেশ), টেলিভিশন (বিটিভি) এবং সরকারি সংবাদপত্রে এ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চলে। সরকারি কর্মকর্তারা পর্যন্ত এ নির্বাচনে স্পষ্টত পক্ষাবলম্বন করে এবং পুলিশ, সেনাবাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ সব আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে এ নির্বাচনে ব্যবহার করা হয়। ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, শতভাগেরও বেশি ভোট পড়েছে এবং সবই স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার বাক্সে, অর্থাৎ হ্যাঁ-তে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচারণামূলক রচনা কিংবা লিখিত গ্রন্থাদি থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থায় প্রথম ও প্রবল আঘাতটি আসে এই হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে। সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে বাকি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, বলাইবাহুল্য, সেগুলোও ছিল চরমভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পক্ষপাতদুষ্ট।

১৯৭৮ সালের ৩ জুন যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় সেটির পোস্টারে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনা-পোশাকে দেখা যায়। একই সঙ্গে তখন তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনাপ্রধান। অথচ সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ আইনত নিষিদ্ধ। দেশীয় ক্ষমতার সকল প্রকার সম্ভাব্য উচ্চতায় থেকে জেনারেল জিয়া ততদিনে নিজের দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলসহ ছয়টি রাজনৈতিক দলকে কিনে নিয়ে একটি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন সম্পন্ন করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, একজন মেজর জেনারেলকে এ ফ্রন্ট নির্বাচনে প্রার্থী করে যিনি একজন সেনাপ্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও। এ দেশে কার ঘাড়ে কটি মাথা যে, এ ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে ভোট না দিয়ে বেঁচে থাকবেন? ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতির বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছিল জোর-জবরদস্তি করে; তার প্রমাণও আমরা তখনকার মুরুব্বিদের কাছ থেকে জানতে পারি। এত কলঙ্কের নির্বাচনেও জিয়াউর রহমানের পক্ষে ৭৬.৬ শতাংশ ভোট পড়ে আর তার বিরোধী প্রার্থী গণঐক্যজোটের প্রার্থী জেনারেল ওসমানীর পক্ষে পড়ে ২১.৭ শতাংশ ভোট। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকা এ নির্বাচন নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে বলে যে, কোনো কোনো কেন্দ্রে নাকি তখন শতকরা ১১০ ভাগ ভোটও গ্রহণ করা হয়েছে। বোঝাই যায় এরপর আর এ নির্বাচন নিয়ে বলার কিছু নেই। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, জেনারেল জিয়ার আমলে অনুষ্ঠিত হ্যাঁ/না ভোট কিংবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দুবারই জনমনে আতঙ্ক তৈরি করাটাই ছিল রাষ্ট্রপক্ষের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। জনগণকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করার এ প্রক্রিয়া নির্বাচনের প্রতি যে বিভীষিকার জন্ম দিয়েছিল, তা পরবর্তীকালে এরশাদশাহীর আমলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।

নির্বাচনব্যবস্থার এ ত্রুটি এবং কলঙ্ক পরবর্তীকালে এরশাদ জমানায় শুধু বাড়তেই থাকে। জেনারেল এরশাদও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাষ্ট্রকে সর্বৈবভাবে ব্যবহার করে নিজেকে ও নিজের দলকে বাংলাদেশের ঘাড়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনিও ক্ষমতায় বসেই একটি রাজনৈতিক দল খুলে ফেলেন রাতারাতি রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থায়নেই। দল গঠন করেই দলকে ক্ষমতায় বসানোর খায়েশ হয়েছে প্রতিটি জেনারেলের ক্ষেত্রেই। রাতারাতি দল গঠন করে নির্বাচকমণ্ডলীর কাছ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ম্যান্ডেট লাভ করাটা যে একটি অসম্ভব ব্যাপার এবং পৃথিবীর কোনো দেশেই সেটা সম্ভব হয়নি, সে কথা এ জেনারেল-শাসকদের কে বোঝাবে? আওয়ামী লীগ গঠন এবং তারপর নির্বাচনে জিতে এককভাবে ক্ষমতায় আসতে আওয়ামী লীগকে ৩০ বছরেরও অধিককাল সময় লেগেছে। অন্যদিকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি গঠিত হওয়া মাত্রই রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা হাতে পেয়েছে। তাহলে বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এ দেশে নির্বাচনী ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বলতে যে সোনার পাথরবাটিকে বোঝানো হয়ে থাকে, তা আসলে কোনোকালেই সম্ভব নয় কারণ একটি রাজনৈতিক দলকে যা অর্জন করতে যেখানে ৩০ বছরের বেশি সময় রাজপথে সংগ্রাম, সাধনা এবং জনগণের কাছে আগে জনপ্রিয় হওয়ার মতো কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, সেখানে বাকিদের ক্ষেত্রে অস্ত্র-অর্থ-ক্ষমতাই সে কাজটুকু করে দিয়েছে। তাহলে কোন সে জাদু যা দিয়ে এ দেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্য একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা যাবে?

এ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় উপরোক্ত এ ত্রুটিটিই যে জনমনে সবচেয়ে বড় আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি করেছে তা বলাইবাহুল্য। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ রাজনৈতিক দলগুলো যখনই ক্ষমতায় থেকেছে, পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজেদের হাতের মুঠোয় নিয়ে ব্যবহার করেছে এবং জয়ী হওয়া ছাড়া আর কোনো ‘অপশন’কে তারা ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেনি। প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়েছে, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মধ্যেও প্রধান উপদেষ্টার পদকে কলুষিত করে আজিজ-মার্কা নির্বাচন কমিশন বসিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাহীনতাও আরও তীব্র করে তুলেছে। এমনকি প্রার্থী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগহীন ও অপরিচিত ব্যক্তি দিয়ে শুধু টাকা ছড়িয়ে নির্বাচনকে এমনভাবে খেলো করা হয়েছে যে, মানুষ নির্বাচন এলেই ভাবতে শুরু করে এবার হয়তো কিছু অর্থযোগ ঘটবে এবং ভোট আসলে হবে না। আমরা স্মরণ করতে পারি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কথা, যখন সদ্য এরশাদশাহি সরকারের পতনের পর জনগণ ভেবেছিল যে, নতুন গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে পরিচ্ছন্ন ইমেজের প্রার্থীরা জাতীয় সংসদ কার্যকর করে তুলবেন এবার। কিন্তু কার্যত দেখা গেল যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটটি প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এড়িয়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা, সেনা কর্মকর্তা এবং কালো টাকার মালিক ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দিয়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে নির্বাচনকে একটি ব্যবসা বানিয়ে ফেলল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সেবার ত্যাগী ও এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো নেতাদের মনোনয়ন দিয়ে এ অভিজ্ঞতাই অর্জন করল যে, অর্থ না থাকলে নির্বাচনে মনোনয়ন দিলেও সেসব প্রার্থীর পক্ষে পাস করে আসা সম্ভব হয় না। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগও আমলা-সেনা কর্মকর্তা-ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেওয়া শুরু করল।

বলাইবাহুল্য, বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় এ মনোনয়ন বাণিজ্য হয়ে উঠল প্রধানতম শত্রু। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কোনো নিরপেক্ষ গবেষক যদি গবেষণা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে, বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যজোট একেকটি আসনে একাধিক প্রার্থীর কাছে মনোনয়ন বিক্রি করে বিপুল পরিমাণে অর্থ নির্বাচনের আগেই মাঠ থেকে তুলে নিয়েছিল এবং আখেরে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল—তারা অবশ্য এটাই চেয়েছিল।

বাংলাদেশের চলমান নির্বাচনব্যবস্থায় অনেকটাই পরিবর্তন আনা হয়েছে। একটি আইন করা হয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ বাকি কমিশনারদের নিয়োগে এবং তাদের কর্মপরিধিও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টিও এখন আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এটুকু দিয়েও যে কোনো দেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব যদি রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করে। কিন্তু বাংলাদেশে তো সেটি হওয়ার নয়। বরং ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন কমিশনকে অগ্রাহ্য করার এবং ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘পাগল ও শিশুর রাষ্ট্রব্যবস্থা’ বলে বাদ উড়িয়ে দেওয়ার কাজটিই করে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো। এখন তো সাংবিধানিকভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আর কোনো সুযোগ নেই, উচ্চ আদালতের নির্দেশেই সেটি করা হয়েছে।

কিন্তু এখনো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য সবপক্ষই মুখিয়ে রয়েছে। বদরুদ্দীন উমরের মতো বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলকে পরামর্শ দেন কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রতিহত করা যায় সেটা নিয়ে। এক-এগারোর কালে এই রাজনৈতিক দলভুক্ত নন এমন সব ব্যক্তিই একটি অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এনে রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং পুরো নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। এবারও তারাই কখনো প্রকাশ্যে, কখনো অপ্রকাশ্যে থেকে নির্বাচন ঠেকানোর কাজ করে চলেছেন। নেমেছেন বিদেশিরাও, তারাও মুখে নির্বাচন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ করতে চাইলেও কর্মকাণ্ডে তারা নির্বাচনের বাইরে একটি অনির্বাচিত সরকারকেই মূলত বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশের জনগণ নয়, বাংলাদেশের সব ক্ষমতার উৎস এসব নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ করার পক্ষগুলোতে থাকা একাধিক ব্যক্তি। বাংলাদেশ যতদিন এই পক্ষগুলো থেকে মুক্তি না পাবে, ততদিন বাংলাদেশের গণতন্ত্র শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

লেখক : মাসুদা ভাট্টি, এডিটর ইনচার্জ, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ