1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব

এরশাদুল আলম প্রিন্স : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২১

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের সিসিইউতে রয়েছেন। বিএনপির দাবি তাকে সুস্থ করে তুলতে হলে এ মুহূর্তে বিদেশে নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চপর্যায় থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তাকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়।

খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগছেন। তার হাঁটুতে অপারেশন হয়েছে দুবার। চোখেও অপারেশন হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন কোভিডে। কোভিড-পরবর্তী জটিলতায় তার ফুসফুস, লিভার, হার্ট ও কিডনির অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে বলে জানা যায়। এমতাবস্থায় তিনি ২০১৮ সাল থেকে কারাভোগ করছেন।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে বিএনপির দাবি, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। তার বিরুদ্ধে সব মামলাই মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। তবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ বিএনপি করতেই পারে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলার সুযোগ নেই। আদালতে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং তিনি সাজাপ্রাপ্ত।

খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঁচবার আবেদন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা তিনি ইতোমধ্যেই ব্যবহার করেছেন। আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার, সেটুকু আমি দেখিয়েছি। এখানে আমার কিছু করার নাই। আমার যেটা করার, আমি করেছি। এটা এখন আইনের ব্যাপার। খালেদা জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি, এটাই কি বেশি নয়?’

প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে বিএনপিপন্থিরা নাখোশ হয়েছেন। তা হতেই পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সবগুলো কথাই সঠিক বলেছেন। তিনি তার হাতে যে ক্ষমতা আছে সেটা প্রয়োগ করেছেন। মানবিকতা দেখিয়ে তিনি খালেদা জিয়াকে বুয়াসহ জেল ও বর্তমানে সাজা স্থগিত রেখে বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। এগুলো তিনি মানবিকতা দেখিয়েই করেছেন।

কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তিনি যে অভিযোগগুলো করেছেন তা কি ভিত্তিহীন? ১৫ আগস্টের দায়ভার থেকে কি জিয়া পুরোপুরি মুক্ত? জিয়াউর রহমান কি ১৫ আগস্টের খুনিদের পুরস্কৃত করেননি? ১৫ আগস্টে নিজের ভুয়া জন্মদিন পালন করে তিনি কি সমঝোতার পথ ‍রুদ্ধ করে দেননি?

২১ আগস্টের খুনিদের তিনি বিচার না করে মদদ দেননি? প্রধানমন্ত্রীর এ অভিযোগগুলোর কোনোটাই ভিত্তিহীন নয়। তবে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রশ্নে বিএনপি এখন যথেষ্ট নমনীয়। তারা পাল্টা যুক্তির পথে না গিয়ে বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টিকে মানবিকতার সঙ্গে দেখার দাবিই করে আসছেন। সেই সঙ্গে হয়তো কিছু আইনি ও রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন।

খালেদা জিয়ার জীবনমৃত্যুর প্রশ্নটিকেই তারা বড় করে দেখছেন। খালেদা জিয়া একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী ও যথেষ্ট অসুস্থ। এছাড়া তিনি তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও একজন বীরোত্তমের স্ত্রী। বিএনপি এ কথাগুলোই বার বার বলছে। কিন্তু একজন ভিকটিম বা সংক্ষু্ব্ধ ব্যক্তির কাছে তিনি শুধুই একজন হুকুমের আসামি ও বর্তমানে দণ্ডিত কয়েদি।

বিএনপি খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিকে রাজনৈতিকভাবেই আদায় করতে চায় বলেই মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি গত ১২ বছরে কোনো দাবিই আদায় করতে পারেনি। খালেদা জিয়ার বিচারের বিষয়টিকেও তারা প্রথমে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি।

পরে আইনগতভাবে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল, সেখানেও ব্যর্থ হয়েছে। শেষমেশ তাকে কারাগারেই যেতে হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে দাবি আদায়ের শক্তি ও কৌশল কোনোটিই বিএনপি দেখাতে পারেনি। এখনও তারা একটি আইনগত বিষয়কে আইনি প্রক্রিয়ায় সুরাহা করার চেষ্টা না করে রাজনৈতিক ইস্যু বানাতে চায়।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিই এ মুহূর্তে তাদের একমাত্র রাজনৈতিক পুঁজি। নেত্রীর অসুস্থতাকে মানুষের সহানুভূতি আদায়ের হাতিয়ার বানানো বা তার বিদেশে চিকিৎসার দাবির আড়ালে দলকে রাজপথমুখী করা মূলত এক ধরনের রাজনৈতিক দেউলিয়ার বহিঃপ্রকাশ।

দাবি আদায়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকতেই পারে। কিন্তু এ বিষয়টি সুরাহা করতে হলে আইনগতভাবেই করতে হবে। কারণ, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বা মুক্তির বিষয়টি অনেক আগেই আইনের আওতাধীন একটি বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কাজেই, এ বিষয়টি আইনগতভাবেই সমাধান করতে হবে। আওয়ামী লীগও যদি খালেদা জিয়াকে মু্ক্তি দিতে চায় বা বিদেশে চিকিৎসা দিতে চায় তাকেও আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তা করতে হবে।

বিএনপি নেত্রী গত এক দশক ধরেই শোচনীয় অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় ও নিয়মের কারণে বাসা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বিচার শেষে তিনি কারাভোগ করেছেন। বর্তমানে সাজা স্থগিত আছে। সাজাভোগের এ মধ্যবর্তী অবস্থায় আওয়ামী লীগ তার প্রতি আরও মানবিকতা দেখাবে কি না সেটি একান্তই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপার। তবে সেই মানবিকতা দেখালেও তা আইনানুযায়ীই হতে হবে। আইনে এখনও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখানোর সুযোগ আছে।

মানবিক কারণ বিবেচনা করেই অনেক সময় আসামিকে জামিন প্রদান করা হয় ও তার সাজা স্থগিত করা হয়। বিচারকালীন জামিন প্রদান করা আদালতের কাজ। আদালত মানবিক বিবেচনায় জামিন দিতে পারেন। সাজা হয়ে গেলে সরকার মানবিক বিবেচনায় সাজা স্থগিত করতে পারে।

এটাই ফৌজদারি আইনের বিধান। এছাড়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টিও রয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার এ বিষয়টিও পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচারের অংশ। রাষ্ট্রপতি ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে যেকোনো আসামিকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। বিএনপি দাবি করতেই পারে যে, এ দেশে খুনের আসামিকেও রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেছেন। সেখানে তিনবারের নির্বাচিত একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমা করতে বাধা কোথায়?

এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি পরিষ্কার। তিনি ইতোমধ্যে মানবিকতা দেখিয়েছেন। মানবিক কারণেই তিনি এখন বাসায় আছেন। তার সাজা স্থগিত আছে। মানবিক কারণেই তার দেখভাল করার জন্য একজন কাজের বুয়াকেও সঙ্গে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এসবই সত্য। বিএনপির দাবি, সেই মানবিকতাকে আরও প্রসারিত করে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো!

আইনমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদিও ফৌজদারি কার্যবিধি ভিন্ন কথা বলে। বর্তমানে তার সাজা স্থগিত রয়েছে। তবে কিছু শর্ত রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে, তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। (ফৌজদারি কার্যবিধির সিআরপিসি) ৪০১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত যাহা মানিয়া নেয় সেইরূপ শর্তে যে দণ্ডে সে দণ্ডিত হইয়াছে, সেই দণ্ডের কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখিতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করিতে পারিবেন।’

কাজেই সরকার চাইলে শর্ত তুলে নিয়ে সাজা স্থগিত করতে পারে। এমনকি সাজা মওকুফও করতে পারে। সিআরপিসি’র ৪০১ (৬)-এর অধীনে তাকে কয়েকটি শর্ত দিয়ে সাজা স্থগিত করা হয়েছে। ৪০১(৬) ধারা বলছে, ‘সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখা এবং আবেদনপত্র স্থগিত রাখা এবং আবেদনপত্র দাখিল ও বিবেচনার শর্ত সম্বন্ধে নির্দেশ দিতে পারিবেন।’

কাজেই ৪০১(৬) ধারা প্রয়োগ করে যে নির্বাহী আদেশে শর্ত দিয়ে সাজা স্থগিত করা হয়েছে, সেই একই ধারা প্রয়োগ করে আরেকটি নির্বাহী আদেশে জারি করে উক্ত শর্তটি তুলে দিলেই তার বিদেশে যাওয়ায় আর কোনো বাধা থাকে না। বিএনপি সেই দাবিটিই করছে। অর্থাৎ নির্বাহী আদেশটি আরেকবার পরিবর্তন করে জারি করাই যথেষ্ট। তবে, এক্ষেত্রে ৪০১(২) ধারা অনুযায়ী আসামির তরফ থেকে আবেদন করতে হবে।

এছাড়াও সরকার চাইরে The Probation of offenders Ordinance ১৯৬০ ও The Probation of offenders Rules ১৯৭৫ অনুযায়ীও যেকোনো সময় যেকোনো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে পারে।

সরকার থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার কথা আগেও বলেছে। কিন্তু বিএনপি সে পথে যায়নি। তারা কৌশলগত কারণেই সে পথে যায়নি। কারণ, ক্ষমা চাইতে হলে দোষ স্বীকার করতে হবে, মানে সব অভিযোগ স্বীকার করে নিতে হবে। তবে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার অধিকারটি সার্বভৌম নয়।

কারণ, সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। কাজেই ক্ষমা করার অধিকারটিও প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি চাইলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমাও মিলতে পারে। কিন্তু বিএনপি সে পথে যাবে কি না সেটাই প্রশ্ন।

দুই নেত্রীর মধ্যে আজকে বিভেদের দেয়াল থাকলেও তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সদ্ভাব ও সহমর্মিতার কথাও আমরা ভুলে যাইনি। এক/এগারোকালে শেখ হাসিনা বন্দি হলে খালেদা জিয়া তার মুক্তির দাবি করেছিলেন। পরে খালেদা জিয়াও অন্তরীণ হলে দুই নেত্রী পাশাপাশি থেকেছেন। তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে।

শেখ হাসিনা তাকে রান্না করা খাবারও পাঠিয়েছেন। শেখ হাসিনার মুখেই আমরা একথা শুনেছি। এরশাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দুই নেত্রীর সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখ এদেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এক মুহূর্ত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দুই নেত্রীর নিজস্ব একটি জায়গা আছে। সেখানে তারা অনন্য।

অতীতে তাদের দুইজনকেই রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। তাদের বিকল্প তারা নিজেরাই। এই দুই দল ও নেত্রীর মধ্যে শত বিভেদ থাকলেও তাদের একটু পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ও এদেশের মানুষকে যার পর নাই আশান্বিত করে।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মানবিকতা দাবি করছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ও ক্ষোভ তার ঊর্ধ্বে উঠে আরও মানবিকতা দেখাবেন কি না সেটি একান্ত তার ব্যক্তিগত বিষয়। তবে এ ব্যাপারে তাকে দায়ী করা কোনোভাবেই সংগত হবে না। বিশেষ করে ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ গুরুতর।

বঙ্গবন্ধুকন্যা, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দুবারের বিরোধীদলীয় নেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মাদার অব হিউম্যানিটি ও একজন নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, দুবারের বিরোধী দলের নেত্রী, বিরোত্তমের স্ত্রী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ও একজন মরণাপন্ন বয়োবৃদ্ধ নারী খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেন অথবা না দেন-দুটোই আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে।

লেখক: এরশাদুল আলম প্রিন্স, আইনজীবী ও কলাম লেখক।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ