1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সত্তরের সাধারণ নির্বাচনই স্বাধীনতা ও মুক্তির সোপান

কাজী শরীফ উদ্দিন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২১

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। এই দিনটিতে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সে নির্বাচনের পর বিজয়ী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে।

এর জের ধরে শুরু হওয়া তীব্র রাজনৈতিক সংকট শেষ পর্যন্ত গড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে।

নির্বাচনের প্রেক্ষাপট

পূর্ব পাকিস্তানে গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন আইয়ুব খান।এরপর সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান দায়িত্ব গ্রহণ করে সামরিকশাসন জারি করেন। তারপর ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। পাকিস্তান সরকারের তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অন্যতম উপদেষ্টা জি.ডব্লিউ চৌধুরীর মতে, একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের আগ্রহের কোনো ঘাটতি ছিল না।

মি. চৌধুরী উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট চেয়েছিলেন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া যেন মসৃণ হয়। আওয়ামী লীগ নিয়ে গবেষণা করেছেন ভারতের জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্যামলী ঘোষ। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উপর গবেষণা করে তিনি পিএইডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার বই ‘দ্য আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১’ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। মিস ঘোষ লিখেছেন, ১৯৭০ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরু করে।

নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলো

শেখ মুজিব ছাড়াও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ভাসানী প্রথমে রাজি হলেও নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এসে তিনি নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে যান। তার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক মহলে এখনও নানা বিতর্ক হয়।

অনেকে মনে করেন, ১৯৭০ সালে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে মওলানা ভাসানী ভুল করেছেন। তবে তার অনুসারীরা বলেন, ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ভাসানী যদি নির্বাচনে শেষপর্যন্ত থাকতেন তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে ভোট ভাগ হয়ে যেত এবং আওয়ামী লীগ হয়তো একচ্ছত্র আধিপত্য পেত না।

মওলানা ভাসানীর অনুসারী হায়দার আকবর খান রনো লিখেছেন, “আমার মনে হয়, ভাসানী মনে মনে চেয়েছিলেন শেখ মুজিবকে ওয়াকওভার দিতে, যাতে শেখ মুজিবুর এককভাবে বেরিয়ে আসেন। তাতে স্বাধীনতার প্রশ্নটি সহজ হতো বলে তিনি ভেবেছিলেন।” নির্বাচনে মোট ২৪টি দল অংশ নিয়েছিল।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কা পায়। অপরদিকে আওয়ামী লীগের চরম প্রতিন্দ্বন্দ্বি জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টির ছিল তলোয়ার প্রতীক। নির্বাচনে অংশ নেয়া অন্য দলগুলো তেমন একটা জোরালো ছিল না।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে কোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। ইয়াহিয়া খান সরকারের মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি ছিল না। জি. ডব্লিউ চৌধুরীর মতে, সেই নির্বাচন সত্যিকার অর্থে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ অধীনে হয়েছিল। জাতীয় পরিষদের সে নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ১৬২টি আসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ১৩৮টি।

পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সবগুলো আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। অন্য কোনো রাজনৈতিক দল সবগুলো আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রার্থী দিয়েছিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন)। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ছিল ৯৩জন। এছাড়া পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি ৭৯টি এবং জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান ৭০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল।

গবেষক শ্যামলী ঘোষ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিশ্লেষণ করেছেন। তার পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে ১৬২টি আসনে আওয়ামী লীগ যাদের মনোনয়ন দিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ ছিল আইনজীবী। এছাড়া ব্যবসায়ী ছিল ১৯ শতাংশ এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিল ৬ শতাংশ। জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে কোনো প্রার্থী দেয়নি।

জি. ডব্লিউ চৌধুরীর বর্ণনায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে কোনো প্রার্থী দেওয়ার ‘সাহস’ করেনি।

অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী দিয়েছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টি। কিন্তু তারা সবকটি আসনে প্রার্থী দেয়নি। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রার্থীসংখ্যা ছিল ১১৯ জন। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে মাত্র আটজন প্রার্থী দিয়েছিল।

নির্বাচনে মোট ২৪টি দল অংশ নেয়। ৩০০টি আসনে মোট ১ হাজার ৯শ ৫৭ প্রার্থী অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর পর কিছু প্রার্থী তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে ১ হাজার ৫ শ ৭৯ প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। আওয়ামী লীগ ১৭০ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১৬২টি আসন পূর্ব পাকিস্তানে এবং অবশিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানে।

জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী দেয়। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ১৫১। পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ১২০ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১০৩টি ছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে। পূর্ব পাকিস্তানে তারা কোনো প্রার্থী দেয়নি। পিএমএল (কনভেনশন) ১২৪ আসনে, পিএমএল (কাউন্সিল) ১১৯ এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ১৩৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং প্রায় ৬৫% ভোট পড়েছে বলে সরকার দাবি করে। সর্বমোট ৫৬৯৪১৫০০ রেজিস্টার্ড ভোটারের মধ্যে ৩১,২১১,২২০ জন পূর্ব পাকিস্তানের এবং ২৩,৭৩০,২৮০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটার।

ভোটের ফলাফল

১৯৭০ সালের নির্বাচনের এক মাস আগে ভোলাসহ উপকূলীয় জেলাগুলোতে প্রবল এক সাইক্লোন আঘাত করে। সে ঝড়ের পরে পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতা বাঙালিদের মনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সে ঝড়ের পরে নির্বাচনের ফলাফল কী হতে পারে সে সম্পর্কে আগাম ধারণা পেয়েছিল সবাই। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন অনেক প্রভাবশালী। পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে।

পূর্ব পাকিস্তানের বাকি দুটি আসনের মধ্যে যারা জয়লাভ করেছিলেন তাদের একজন হলেন নুরুল আমিন এবং অপরজন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮১টি আসনে জয়লাভ করে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার স্মৃতিচারণামূলক ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে লিখেছেন, ভোট গ্রহণের আগেই আওয়ামী লীগ কার্যত নির্বাচনে জিতে গিয়েছে। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

সে নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠেন। এই নির্বাচনের ফলাফল নির্দেশ করে পাকিস্তানের দুটি অংশের জনগণের মধ্যে চিন্তাধারার পার্থক্য ফুটে ওঠে।

জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল

ন্যশনাল অ্যাসেম্বিলিতে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বিলির ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে।

কনজারভেটিভ দলগুলো নির্বাচনে খুব সুবিধা করতে পারেনি। সম্ভবত একই ধরনের পার্টিগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে এমনটি হয়েছে। পিএমএল (কাইয়ুম), পিএমএল (কাউন্সিল), পিএমএল (কনভেনশন), জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম, জমিয়ত উলেমা-ই-পাকিস্তান এবং জামায়াতে ইসলামী একত্রে ৩৭টি আসন পায়।

আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বিলিতে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বিলির ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে। এই জয়লাভই বাঙালিকে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে সার্বভৌমত্ব সৃষ্টির সাহস ও প্রেরণা জোগায়। যেখানে জড়িয়ে আছে রক্ত-মেধা, ঘাম আর সম্ভ্রমহানির করুণগাথা।

লেখক: কাজী শরীফ উদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক (কর্নেল) কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, প্রবন্ধকার ও কলাম লেখক।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ