1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সমন্বিত উন্নয়নে শিক্ষার অপরিহার্যতা

অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান  : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২২

বাংলাদেশ ঘাটতি-উদ্বৃত্ত সমস্যায় ভুগছে। কথাটি স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয়। সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এই উক্তিটি প্রযোজ্য। যেমন—দেশে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই।

আনাড়িরা এই কাজ নিজেদের মতো করে থাকেন। ফলে একদিকে যেমন রোগজীবাণু ছড়ায়, অন্যদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখার কৌশল জানেন না। তাই কোনো ধরনের ব্যবস্থা ছাড়াই এই কাজ করেন। ফলে অল্প বয়সেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। যদি মধ্য পর্যায়ের জনগণের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব যে আমাদের বিরাট গার্মেন্ট সেক্টরে মধ্য পর্যায়ের টেকনিশিয়ানের অভাব। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে টেকনিশিয়ানরা এসে কাজ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। উচ্চ পর্যায়ের জনবলের অভাব আরো প্রকট। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওষুধশিল্পসহ অন্যান্য বড় বড় শিল্প-কারখানায় উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রয়েছে ঘাটতি সমস্যা। এখানে উল্লেখ্য, বাধ্যতামূলক মৌলিক শিক্ষা শেষে স্বল্পমেয়াদি বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে যদি কৃষি, হাঁস-মুরগি বা মাছের খামার চালাত তাতে উৎপাদন বহু বৃদ্ধি পেত। ফলে আর্থিকভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হতো।

এখন উদ্বৃত্ত সমস্যার দিকে নজর দেওয়া যাক। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে যাঁরা ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন তাঁদের বেশির ভাগই উদ্বৃত্ত। শিক্ষার্থী এবং তাঁদের অভিভবক সবাই চান স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। ফলে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেড়শ বিশ্ববিদ্যালয়েও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। দেশে চাকরিসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সাধারণ ডিগ্রিধারী যতসংখ্যক লোকবল দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি ডিগ্রিধারী প্রতিবছর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হচ্ছেন। অনেকে আবার সার্টিফিকেটধারী, কিন্তু মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত নন। ফলে সৃষ্টি হয়েই চলছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। এটাই হচ্ছে উদ্বৃত্ত সমস্যা। এতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে না; বাড়ছে সন্ত্রাস, হানাহানি, রাহাজানি, নৈরাজ্য ও উচ্ছৃঙ্খলা। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার সহায়-সম্পদ, জায়গা-জমি বিক্রি করে সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। নিম্নমানের শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানরা না পাচ্ছেন চাকরি, লোকলজ্জায় না করছেন দৈহিক পরিশ্রমের কাজ। তাঁরা জনসম্পদ নন, বরং বোঝা। এর জন্য দায়ী ব্যক্তি, অভিভাবক ও সমাজ নয়, দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যুগোপয়োগী শিক্ষানীতি। যেহেতু শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতি পরস্পর পরিপূরক, প্রতিটি অন্যগুলোর ওপর নির্ভরশীল এবং প্রতিটি অন্যগুলোকে প্রভাবিত করে, তাই সবই যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।

এখন আমরা দেখব শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি কিভাবে একটি অন্যটির ওপর নির্ভরশীল এবং পরস্পর পরিপূরক।

চিত্রে প্রদর্শিত ছকে শিক্ষা বলতে সব ধরনের আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বোঝাবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ স্তরের সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, পেশাগত ও প্রকৌশল শিক্ষা ইত্যাদি। তা ছাড়া সব ধরনের শিক্ষার ক্ষেত্র যেমন থাকে বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগীয় এবং মনোপেশিজ শিক্ষা। বেঞ্জামিন ব্লুমের সূত্রানুসারে বুদ্ধিবৃত্তীয় ক্ষেত্রের বিভাজনগুলো হচ্ছে—জ্ঞান, উপলব্ধি, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ, মূল্যায়ন এবং সৃজনশীলতা। আবেগীয় ক্ষেত্র বলতে যাবতীয় মানবিক গুণাবলি, যেমন—ধৈর্য, দয়া, মায়া, মহানুভবতা, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, জীবনবোধ, দেশপ্রেম, সৌহার্দ্য, সহানুভূতি, শান্তি-শৃঙ্খলা, সহনশীলতা, এ ধরনের যাবতীয়, আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতাকে বোঝায়। আর মনোপেশিজ দক্ষতা হলো মনন ও শারীরিক দক্ষতার সমন্বয়ে কর্মসাধনের ক্ষমতা।

স্বাস্থ্য বলতে শুধু নীরোগ দেহ বোঝায় না। সুস্থ মন, সুস্থ শরীর, প্রাণচাঞ্চল্যতা, কর্ম করার সঙ্গে জীবনকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপভোগ করার অবস্থাকে বোঝায়।

সম্পদ হলো টাকা-পয়সা, যাবতীয় ভৌত সুবিধা, যেমন—ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি, অস্থাবর ও স্থাবর সামগ্রী ইত্যাদি। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নত যোগাযোগব্যাবস্থাও সম্পদভুক্ত। এসব ছাড়া রাষ্ট্রীয় সম্পদ হলো—খনিজ সম্পদ, জলজ সম্পদ, মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ এসব কিছু।

সমাজ বলতে জনগণের সমন্বিতভাবে বসবাসকে বোঝায়। সমাজের পরিসর ব্যাপক, পরিবার থেকে বিশ্বজগৎ। পাড়া-প্রতিবেশী, প্রতিষ্ঠান, গ্রাম, মহল্লা, উপজেলা, জেলা, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব—সবই একেকটি সমাজের স্তর। সমাজের প্রাথমিক স্তর পরিবার, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্ধন, মিল-মহব্বত, সমঝোতা, পরস্পরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, স্নেহ-মমতা, মান্যতা ইত্যাদি সুস্থ পারিবারিক পরিবেশের নিয়ামক। পক্ষান্তরে হিংসা, বিদ্বেষ, নৈরাজ্য, অভক্তি, রুক্ষতা, পরনিন্দা, লোভ-লালসা, অবিশ্বাস ইত্যাদি অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশের নির্দেশক।

এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পদ ও সমাজের যে ধারণা উপস্থাপন করা হয়েছে, এগুলোর কোনোটিই পরিপূর্ণ নয়। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ ধারণা দেওয়া নয়। উদ্দেশ্য হলো, এর প্রতিটি কিভাবে পরস্পরের পরিপূরক এবং সার্বিক উন্নয়নের জন্য এর প্রতিটির সমন্বিত উন্নয়ন কেন প্রয়োজন তা তুলে ধরা। এখন আমরা দেখব শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পদ এবং সমাজের সম্পর্ক। গাণিতিক ভাষায় এদের যেকোনো একটির বাড়লে অন্য সব কয়টি বাড়ে, আবার একটি কমলে অন্যগুলো কমে। যেমন—শিক্ষিত জনসংখ্যা বাড়লে মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন হয়। সুষম খাদ্য গ্রহণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, রুটিন মেনে জীবনযাপন করা, খেলাধুলা, বিনোদন ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা—এসব মেনে চলে। পক্ষান্তরে মানুষ সুশিক্ষিত না হলে এসব বিষয়ে উদাসীন থাকে। ফলে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। এ হলো শিক্ষার সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্কের দৃষ্টান্ত। অন্যভাবে দেখলে যদি স্বাস্থ্য ভালো না থাকে, তাহলে সাধারণত মনও ভালো থাকে না। মন ও স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে পড়ালেখায় মনোযোগ বসে না। এগুলো শিক্ষালাভে অন্তরায়। অতএব দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা অর্জনের জন্য সুস্বাস্থ্য অপরিহার্য, আবার সুস্বাস্থ্যের জন্য শিক্ষা সহায়ক।

এখন দেখব শিক্ষার সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক। শিক্ষার মাধ্যমে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করা যায়। অর্থাৎ জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার প্রধান মাধ্যম হলো শিক্ষা। সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিটি উৎস শিক্ষার অবদান অপরিমেয়। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সফলতা, চাকরিক্ষেত্রে সফলতা—সব ক্ষেত্রেই শিক্ষিতরা সম্পদ বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ অবদান রাখে। নিরক্ষর ও অদক্ষদের দ্বারা অধিক উৎপাদন করে সম্পদ বৃদ্ধি করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।

সুশীল সমাজ গড়ার ক্ষেত্রেও শিক্ষার সম্পর্ক সুদৃঢ়। নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষিত পরিবারে সুখশান্তি ও সমৃদ্ধি থাকে। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ থাকে। পক্ষান্তরে শিক্ষার আবেগীয় ক্ষেত্রের বিকাশহীন অদক্ষ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারে অভাব-অনটন, অশান্তি, হানাহানি লেগেই থাকে। এ কথাগুলো পরিবারের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি প্রতিবেশী থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও বিশ্বের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

উপসংহারে আমরা বলতে পারি, উন্নয়ন হতে হবে সার্বিক ও সমন্বিত। কয়েকটি ক্ষেত্রকে অবহেলিত রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রের অভাবনীয় উন্নয়ন হলেও পরিপূর্ণ সুফল লাভ করা যায় না। যেমন—শিক্ষার উন্নয়ন হলো, কিন্তু স্বাস্থ্যক্ষেত্র অবহেলিত রইল। এ ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, সম্পদের কাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধি হবে না এবং সুশীল সমাজ গড়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা থেকে যাবে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রের উন্নয়ন অন্যান্য ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে, তবে শিক্ষার উন্নয়নের প্রভাব সর্বাধিক।

লেখক : ড. ছিদ্দিকুর রহমান – অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ