1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

পিলখানা ট্র্যাজেডি: আর যেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত না হয় দেশ

এমএম নাজমুল হাসান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

২৫ ফেব্রুয়ারি, বিষাদময় দিন। ২০০৯ সালের এই দিনে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায় শুরু হয় নৃশংস ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। আর এর সমাপ্তি ঘটে ৩৬ ঘণ্টার নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। ইতিহাস ঘৃণীত সেই হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিল স্বাধীনতাবিরোধী তথা জামায়াত-বিএনপির ইন্ধনপুষ্ট বিডিআরের কিছু সৈনিক। তাদের নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন বিডিআরে দায়িত্ব পালনরত সামরিক কর্মকর্তারা ও তাদের পরিবারবর্গ।

মর্মান্তিক সেই হত্যাকাণ্ডে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুইজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, নয়জন বিডিআর সদস্য এবং পাঁচজন বেসামরিক লোক নিহত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে একক কোনো ঘটনায় এত সামরিক কর্মকর্তা নিহতের ঘটনা পূর্বে কোথাও ঘটেনি। বিদ্রোহ করা বিডিআর জওয়ানরা অজুহাত হিসেবে জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ বঞ্চিত, রেশন বৈষম্য, ডাল-ভাত কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের যেসব বিষয় উপস্থাপন করেছিল, তা নিতান্তই ঠুনকো। সামান্য ও সাধারণ বিষয় নিয়ে এত বড় নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ চালানোর কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে কাজ করেছে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত।

এসময় বিএনপি জাতীয় ঐক্যের প্রতীকরূপে আবির্ভূত না হয়ে বরং নীরব থাকে। পরবর্তীতে বিদ্রোহের কারণ বা অনুঘটক নিয়ে পর্যালোচনা না করে বিভিন্ন তীর্যক মন্তব্য করে জাতিকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। তারা সরকার ও সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে।

জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৪৭ দিনের মাথায় ঘটে ইতিহাসনিন্দিত এ হত্যাকাণ্ড। দেশকে অস্থিতিশীল করতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তগোষ্ঠী পরিকল্পনামাফিক পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) কিছু সদস্যকে ব্যবহার করে পেশাদার এ বাহিনীটিকে শেষ করা তথা সামরিক বাহিনীকে খেপিয়ে তুলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে সদ্য ক্ষমতা গ্রহণ করা সরকারকে হটানোর পরিকল্পনা ছিল এঘটনা।

সেদিন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বিডিআর জওয়ানদের বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচার করে ঢাকার বাইরের ব্যাটালিয়নের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানো হয়। পিলখানার দরবার হলে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালকসহ ১৬৮ কর্মকর্তার বিষয়ে দেশীয় কোন গণমাধ্যম কিছু জানাতে না পারলেও বিদেশি গণমাধ্যম ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিডিআর মহাপরিচালকসহ ১৫ সেনা কর্মকর্তার হত্যার খবর প্রচার করতে সক্ষম হয়।

এছাড়া হত্যাকাণ্ডের আগের দিন অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের কিছু সদস্য বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সাথে আলোচনা করেন বলে জানা যায়। আলোচনা শেষে বিএনপির সাবেক এই নেতা বিডিআর সদস্যদের পিলখানার ৫ নম্বর গেটের দিকে এগিয়ে দিয়ে যান। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদর দপ্তরের তিন নম্বর গেটে কিছু যুবক বিডিআর-জনতা ভাই ভাই স্লোগান দিয়ে বিদ্রোহী জওয়ানদের সমর্থনে মিছিল বের করে। কয়েকজন ডিএডি, এডিএ, জেসিও, নায়েক ও হাবিলদারের নেতৃত্বে পিলখানার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা সম্ভব ছিল না। এর নেপথ্যে কথিত বৈঠকে সেটা প্রতীয়মান হয়।

বিদ্রোহের দিন সকালেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাসা ত্যাগ করতে বলেন তারেক রহমান। তিনি বাসা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মানবতাবিরোধী অপরাধী (ফাঁসি কার্যকর) সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি আইএস এর যোগসাজশে পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার অভিযোগ উঠে। মূলত এটা ছিল সামরিক বাহিনীকে সদ্য ক্ষমতা গ্রহণ করা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করার দেশি-বিদেশি চক্রান্ত।

ফিরে দেখা পিলখানা হত্যাকাণ্ড
২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিজিবির (তৎকালীন বিডিআর) সদর দপ্তর পিলখানায় তিন দিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহ উদ্বোধন করেন সদ্য ক্ষমতা গ্রহণ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি রাইফেলস সপ্তাহ শেষ হওয়ার পূর্বেই ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘটে গেলে বিডিআর জওয়ানদের দ্বারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ঐদিন সকাল নয়টায় পিলখানার দরবার হলে শুরু হয় বার্ষিক দরবার। সারাদেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ দুই হাজার পাঁচশ’ ৬০ জন সদস্য দ্বারা দরবার হল পরিপূর্ণ। মঞ্চে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা।

সেসময়কার জাতীয় দৈনিক সমূহের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসন্ধানে জানা যায়, জওয়ানদের একটি দল সকাল নয়টার পূর্বেই অস্ত্রাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত মেজরকে জিম্মি করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। এরপর সাড়ে নয়টার দিকে দরবার হলে মহাপরিচালকের বক্তব্যের সময় দুইজন সশস্ত্র সিপাহি অতর্কিতভাবে মঞ্চে প্রবেশ করে মহাপরিচালকের দিকে অস্ত্র তাক করেন।

এর পরপরই বিদ্রোহী জওয়ানদের একটি অংশ দরবার হলে ঢুকে মহাপরিচালকের সামনে তাদের দাবি নিয়ে হৈ-চৈ শুরু করেন। মহাপরিচালক সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিজ ইউনিট নিয়ন্ত্রণের জন্য বলেন।

তখনই সিপাহি সেলিম রেজার নেতৃত্বে অপর একটি দল সশস্ত্র অবস্থায় দরবার হলে ঢুকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অল্পক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হলের চর্তুদিকে গুলি করা শুরু করেন।

সকাল সাড়ে দশটার দিকে কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে বের করে আনেন বিদ্রোহী জওয়ানরা। দরবার হলের বাইরে মহাপরিচালককে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করলে মহাপরিচালকের সাথে আরও অনেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এরপর বিদ্রোহী জওয়ানরা সেনা কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যাসহ, নির্যাতন, জিম্মি, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটাতে থাকে। মুহূর্তেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় পিলখানা।

খবর পেয়ে ঢাকা ও সাভার সেনানিবাস থেকে সাঁজোয়া যান ও ভারি অস্ত্র নিয়ে বেলা ১১ টার সময় ধানমণ্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেন সেনাসদস্যরা। বিডিআরের ১ ও ৫ নম্বর গেটের বিভিন্ন পয়েন্টে আর্টিলারি গান ও সাঁজোয়া যান স্থাপন করা হয়। বিদ্রোহী জওয়ানরা সদর গেট ও ৩ নম্বর গেট থেকে সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন।

বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার থেকে বেলা সোয়া ১২টার দিকে বিদ্রোহী জওয়ানদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে তারা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। তখন বিদ্রোহী জওয়ানরা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিলখানায় আসতে হবে। পিলখানায় কর্মরত ডিএডি তৌহিদ ও কিছু জওয়ানদের নেতৃত্ব ঘটেছিল এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড।

বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিডিআর সদর দপ্তরের চার নম্বর ফটকের সামনে যান আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। তারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিডিআরের প্রতিনিধি দলের দেখা করার ব্যবস্থা করেন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধি দলকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহী জওয়ানদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দেন। কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার দিকে বিদ্রোহী জওয়ানরা প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন।

পর দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বিডিআর জওয়ানরা পোশাক বদলে পিলখানা থেকে পালানো শুরু করে। এরপর রাতে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহী জওয়ানরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট অস্ত্র সমর্পণ করেন এবং অস্ত্রাগারের চাবি বুঝিয়ে দিলে পুলিশ পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়।

পুলিশ পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরের দিন অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি সেখানে একাধিক গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখান থেকে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিছু সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার পর ম্যানহোলে ফেলে দেওয়ায় তাদের মরদেহ নদীতে পাওয়া গিয়েছিল। এ বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান।

বিএনপি-জামায়াত জোটের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটা ক্ষমতা গ্রহণের পরেই ক্ষমতাচ্যুতির জন্য তারা যে নীল নকশা প্রণয়ন করে তা বাস্তবে ধরা দিল না। দেশ রক্ষা পেল জঙ্গীবাদী, পশ্চাৎপদ মানসিকতার লোকের দ্বারা শাসিত হওয়া থেকে। জাতি হারাল চৌকস ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে, যারা সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারতো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষতার সহিত ঘটনাটিকে সামাল দিয়ে জাতিকে আর্থিক ও মানবিক বিবেচনায় নিহতদের পরিবারের পাশে থেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। যদিও আর্থিক ও মানবিকতার মূল্য দিয়ে নিহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। তারপরও সরকার প্রধান হিসেবে তিনি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টরূপে আবির্ভূত হয়ে দেশকে নিশ্চিত গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আর যেন এমন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত না হয় সেদিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

সেদিন পিলখানায় রক্তস্রোতে ভেসে যাওয়া নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করি। একই সঙ্গে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর হোক এটাই আগামীর প্রত্যাশা।

লেখক: এমএম নাজমুল হাসান – প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ

নির্বাচিত