1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

থাই মিলিটারি ব্যাংকের মডেলে বড় হতে পারে ট্রাস্ট ব্যাংক

বাণিজ্য প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২

ছয় দশক আগে থাইল্যান্ডে কার্যক্রম শুরু করে থাই মিলিটারি ব্যাংক (টিএমবি)। শুরুতে ব্যাংকটির পুরো মালিকানাই ছিল রাজকীয় থাই সামরিক বাহিনীর হাতে। ব্যাংকের কার্যক্রমও ছিল সেনাপরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ছায়া কোম্পানিগুলোকে ঋণের জোগান দেয়াই ছিল টিএমবির প্রধান কাজ।

এভাবে চলতে গিয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল টিএমবি। এমন প্রেক্ষাপটে পুরোপুরি পাল্টে ফেলা হয় ব্যাংকটির পরিচালন নীতি। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয় মালিকানার বৃহৎ অংশ। আমূল এ সংস্কারের ফলাফলও পেয়েছে থাই সামরিক বাহিনী। ধুঁকতে থাকা সেই ব্যাংকটি এখন থাইল্যান্ডের বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হয়েছে। বাংলাদেশী টাকায় ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা। থাইল্যান্ডের সীমানা পেরিয়ে এটি এখন আসিয়ান অঞ্চলের প্রতিযোগী সক্ষম একটি ব্যাংক হিসেবে নিজেকে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে এগোচ্ছে।

অনেকটা টিএমবির আদলে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে জন্ম হয় ট্রাস্ট ব্যাংকের। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা এটির। টিএমবির মতোই শুরুতে ব্যাংকটির কার্যক্রম ছিল সেনাপরিবারে সীমাবদ্ধ। ব্যাংকটির বেশির ভাগ শাখাও খোলা হয়েছিল সেনানিবাসের ভেতর। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকেও পরিবর্তন ও সংস্কার হয়েছে। সেনানিবাসের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যাংকটির সেবা সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগও রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠার দুই দশকে যে সাফল্যের চূড়ায় ব্যাংকটির ওঠার কথা, সেটি সম্ভব হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপরাধ ও অভিযোগের অন্ত নেই। সে তুলনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখনো জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। জনগণের এ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের দেশের গণমানুষের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল। কিন্তু শুরু থেকে পরিচালন ব্যর্থতায় সেটি হতে পারেনি। এক্ষেত্রে টিএমবির সাফল্যের সূত্রগুলো আয়ত্ত করা হলে ট্রাস্ট ব্যাংকও বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিযোগী সক্ষম হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে পারবে।

ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীনের মতে, ট্রাস্ট ব্যাংকের পক্ষে সাফল্যের চূড়ায় ওঠার অপার সম্ভাবনা ছিল। তবে সে সম্ভাবনা এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি। বিদ্যমান অবস্থায়ও ব্যাংকটি অনেক দূর যেতে পারে। সেটি নির্ভর করবে ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা দক্ষতার ওপর। সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হলে ট্রাস্ট ব্যাংক টিএমবির মতোই সাফল্য পাবে।

ট্রাস্ট ব্যাংকের তথ্য অনুুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। একই সময়ে ২৪ হাজার ৫১৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে তারা। সব মিলিয়ে সেপ্টেম্বর শেষে ট্রাস্ট ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ট্রাস্ট ব্যাংকের ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপির খাতায় উঠেছে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ খেলাপি। এছাড়া প্রায় ১৭০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ট্রাস্ট ব্যাংক।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দীর্ঘ সময় ট্রাস্ট ব্যাংকের নেতৃত্ব দিয়েছেন ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ট্রাস্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে অবসরে যাওয়া এ ব্যাংকার বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার মানসিকতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাস্ট ব্যাংকও এ সংস্কৃতির মধ্যেই বেড়ে উঠেছে। কিছু বড় ব্যবসায়ী ব্যাংকটি থেকে ঋণ নিয়ে যথাসময়ে ফেরত দেননি। এ কারণে ট্রাস্ট ব্যাংকেরও কিছু খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে। তবে সেটি এখনো সহনীয় সীমার মধ্যেই আছে। আস্থা ও বিশ্বাসের দিক থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অনন্য। ব্যাংকটির পক্ষে বড় হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

টিএমবির প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫৭ সালে। ওই সময় থাইল্যান্ডে চলছিল ফিল্ড মার্শাল সরিত থানারাত ও পুলিশ জেনারেল ফাও সিয়াননের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। অর্থনীতিতে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব বৃদ্ধি ও সামরিক শাসনের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য গঠন করা হয় টিএমবি। গত শতাব্দীর শেষাব্দ পর্যন্ত টিএমবি ছিল থাইল্যান্ডের মাঝারি মানের একটি ব্যাংক। দুর্বল ঋণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি পরিচালন ত্রুটির কারণে ১৯৯৭ সালে এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের ঢেউ আছড়ে পড়ে ব্যাংকটির ওপরও। পরের বছর অন্তত ১০ শতাংশ সম্পদ সংকুচিত হয়ে যায় এ ব্যাংকের। এ অবস্থায় মালিকানা থেকে শুরু করে টিএমবির পুরো অবয়বই পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

টিএমবিতে সামরিক বাহিনীর মালিকানা ২৯ থেকে কমিয়ে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। টিএমবির সংস্কার ও সাফল্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য ইয়েল রিভিউ অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, এশীয় আর্থিক সংকটের পর ব্যাংকটিতে আমূল সংস্কার আনা হয়। ২০০৭ সালে ডাচ্ আইএনজি ব্যাংকের মতো বিদেশী বিনিয়োগকারীর কাছে শেয়ার বিক্রি করে বৈচিত্র্য আনা হয় মালিকানায়। রয়্যাল থাই আর্মির মালিকানায় থাকা শেয়ার স্থানান্তর করা হয় দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। পরিচালনা পর্ষদ থেকে সামরিক কর্মকর্তাদের সরিয়ে পেশাদার ব্যাংকারদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। এর পর থেকে ক্রমাগত সাফল্যের পথে হেঁটেছে টিএমবি।

২০১৯ সালে টিএমবির সঙ্গে থাইল্যান্ডের রিটেইল ব্যাংকিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থানাচার্ট ক্যাপিটালকে একীভূত করে দেয়া হয়। এতে ব্যাংকটিতে যুক্ত হয় এক কোটির বেশি নতুন গ্রাহক। টিএমবি-থানাচার্টের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২০ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৩৩ কোটি থাই বাথ। প্রতি বাথের মূল্য ২ টাকা ৬৬ পয়সা দরে বাংলাদেশী মুদ্রায় ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ ৮ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। থাইল্যান্ডের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যাংকটি এখন আসিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোয় ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।

টিএমবির সাফল্য থেকে শিক্ষণীয় বার্তা রয়েছে বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান। বর্তমানে তিনি ট্রাস্ট ব্যাংকের পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। পরিচালক হিসেবে ট্রাস্ট ব্যাংক পর্ষদে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জানতে চাইলে আনিস এ খান বলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্সের দিক থেকে ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অনন্য। এ ব্যাংকের পরিচালকদের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ বা এজেন্ডা নেই। প্রত্যেকে পদাধিকারবলে ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সদস্য হচ্ছেন। তবে পরিচালক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, ট্রাস্ট ব্যাংকের পর্ষদ অনেক বেশি রক্ষণশীল। যেকোনো সিদ্ধান্ত পাস হওয়ার আগে অনেক বেশি পর্যালোচনা করা হয়। পর্ষদে আমি বলেছি, ট্রাস্ট ব্যাংককে অনেক বড় হতে হলে আরো বেশি আধুনিক হতে হবে। রিটেইল ব্যাংকিং সম্প্রসারণের পাশাপাশি প্রডাক্ট বৈচিত্র্য আনতে হবে।

২০০৭ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ট্রাস্ট ব্যাংক। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে ট্রাস্ট ব্যাংকের ৬০ শতাংশ শেয়ার আছে আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের হাতে। আর ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং প্রায় ২৪ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ছিল ৭০৭ কোটি টাকা। মোট ৭০ কোটি ৭৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৬টি শেয়ার রয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংকের।

গত বছরের মার্চে ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব নেন হুমায়রা আজম। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে তিনিই প্রথম নারী শীর্ষ নির্বাহী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হুমায়রা আজম বলেন, ক্যান্টনমেন্টের গণ্ডি থেকে বের করে ট্রাস্ট ব্যাংককে আমরা সর্বসাধারণের ব্যাংকে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছি। অনেক শাখার অবস্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। সারা দেশে ১১৩টি শাখার পাশাপাশি উপশাখা, এসএমই সেন্টার, এটিএম বুথ, পিওএস মেশিনসহ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি। গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঋণ বিতরণ সম্পন্ন করা হচ্ছে। এতে সাফল্যও আসতে শুরু করেছে। এ মুহূর্তে ট্রাস্ট ব্যাংক প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক। প্রতিষ্ঠার দুই দশক পেরিয়ে এ অর্জন কম নয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ