1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধাপরাধী কারা?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০২২

আজকাল পশ্চিমা কাগজ খুললেই কেবল ইউক্রেনের কথা। যখন কোনো খবর পান না, তখন বানিয়ে খবর লিখতে তারা দ্বিধা করেন না। প্রতিটি কাগজে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ‘ওয়ার ক্রিমিনাল’ বলে অভিযোগ করা হয়েছে। রোজ এই প্রোপাগান্ডা চলছে, ‘পুতিন ডিকটেটর’, ‘পুতিন নতুন হিটলার’। ইউক্রেনের যুদ্ধ এখনও অমীমাংসিত। এই যুদ্ধে মার্কিন সেনারাও বেনামে জড়িত। যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউক্রেনের ছবি পাতার পর পাতা জুড়ে ছাপানো হয়। এভাবে যুদ্ধের বিবরণ আগে কখনও দেখিনি।

ইউক্রেনের যুদ্ধসংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনে যে ট্যাকটিক্স গ্রহণ করা হয়েছে, তা এককালে ইরাক যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। এটি ছিল একটি অন্যায় যুদ্ধ। সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছিল তার কাছে মারণাস্ত্র আছে। পশ্চিমা শক্তি প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের বেডরুমে তার আসবাব পর্যন্ত সার্চ করেছে। তারা কিছুই পায়নি। তারপরও অন্যায় যুদ্ধ শুরু করে টনি ব্লেয়ার ও বুশ। টনি ব্লেয়ার সাদ্দাম হোসেন সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলেছেন, তা-ও প্রমাণিত হয়েছে। ইরাক যুদ্ধের জন্য টনি ব্লেয়ার এবং বুশ দায়ী। তারা যখন এই অন্যায় যুদ্ধ চালাচ্ছিল, তখন সাদ্দামকে পুতিনের মতোই ফ্যাসিস্ট, হিটলার ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছিল। পশ্চিমা কাগজগুলো তখন এই বর্বরোচিত হামলার নিন্দা করেনি, বরং সমর্থন করেছে। এই যুদ্ধে মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্যের বর্বরতায় বাগদাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। অসংখ্য নারী ও শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এসব খবর পশ্চিমা কাগজে ছিল না। পরবর্তীকালে প্রকাশ পেয়েছিল, ইরাকের এক ডিপ্লোম্যাটকে ঘুষ দিয়ে তার কন্যাকে প্রেসিডেন্ট বুশ নিয়ে গিয়েছিলেন। তার মুখে সাদ্দাম হোসেন সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে তা সকল মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই প্রেসিডেন্ট বুশের এই মিথ্যাচার ধরা পড়ে যায় এবং পশ্চিমা মিডিয়াতেই তা প্রকাশ পায়।

ইরাকে মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্যরা যে তাণ্ডব চালিয়েছে, ইউক্রেনে পুতিন সেই তাণ্ডব চালাচ্ছে কিনা সন্দেহজনক। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যখন ফরাসি সৈন্যরা পরাজিত হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন গায়ে পড়ে সেই যুদ্ধ চালাতে গিয়েছিল। সেখানেও তাদের বর্বরতার সীমা ছিল না। নাপাম বোমা ফেলে ভিয়েতনামের উর্বর মাটিকে প্রায় মরুভূমি করে ফেলা হয়। কিন্তু আমেরিকা সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়। ভিয়েতনামের মতোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গায়ে পড়ে ইউক্রেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আমেরিকা চালাকির সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। কিন্তু গোপনে ইউক্রেনে সৈন্য এবং রসদ পাঠাচ্ছে। এটা ইউক্রেন বনাম রাশিয়ার যুদ্ধ নয়। ইউক্রেনের মাটিতে আমেরিকা ও রাশিয়ার বেনামি যুদ্ধ চলছে। সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়াকে পঙ্গু করার চেষ্টা চলছে।

আমি যুদ্ধ সমর্থন করি না। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা সমর্থন করি। ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে আগে যুক্ত ছিল এবং রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ। এই দেশে আমেরিকা তাদের এক তাঁবেদার প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় বসায় এবং দেশটি মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে অর্থাৎ ইউক্রেনে রাশিয়াবিরোধী একটা সামরিক ঘাঁটি করার জন্য আমেরিকা চেষ্টা করছিল। রাশিয়া তার সীমান্তে শত্রুপক্ষের এই সামরিক উপস্থিতি নীরবে সহ্য করতে পারে না। তাই বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করে শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন আক্রমণ করেছে।

পশ্চিমা কাগজগুলো প্রচার করছে, পুতিন বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তিনি একজন ‘ওয়ার ক্রিমিনাল’। কিন্তু ব্রিটেন এবং আমেরিকা গাল্কম্ফ যুদ্ধে কী করেছিল? আফগানিস্তানে একটি বিয়ে অনুষ্ঠানে অনেক লোক সমবেত হয়েছিল। আমেরিকা সেখানে মিসাইল হামলা চালায়। বর, কনেসহ সমস্ত অতিথি মারা যায়। যে পশ্চিমা শক্তি এই বর্বরতা চালিয়েছে, সে সম্পর্কে পশ্চিমা কাগজগুলো নীরব। সুতরাং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যদি কাউকে অভিযুক্ত করতে হয়, তাহলে ব্রিটেনের টনি ব্লেয়ার এবং আমেরিকার জর্জ বুশের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আগে বিচার হওয়া উচিত। যে ব্যক্তি একটি অন্যায় যুদ্ধে ব্রিটেনকে জড়িত করেছিল, ব্রিটিশ সৈন্যকে নিয়োগ করেছিল আফগানিস্তান ও ইরাকে ধ্বংস্তূপ তৈরি করতে, আজ তারা পুতিনকে ‘ওয়ার ক্রিমিনাল’ বলে অভিহিত করছে! প্রশ্ন হলো, টনি ব্লেয়ার ও জর্জ বুশের ‘ওয়ার ক্রিমিনাল’ হিসেবে বিচার হয়নি কেন? ইরাকযুদ্ধে যে টনি ব্লেয়ার মিথ্যাচারের জন্য অভিযুক্ত, তিনি এখন নিজেকে একজন নৈতিক ব্যক্তি বলে প্রচার করছেন এবং ব্রিটেনে লেবার পার্টির মধ্যেও তিনি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছেন।

বাংলাদেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে ভোট না দিয়ে ভালো কাজ করেছে। শেখ হাসিনা আবারও প্রমাণ করলেন, পশ্চিমা শক্তির ধমকের মুখে তিনি অটল থাকতে পারেন। বাংলাদেশের উন্নয়নকার্য ভালোভাবে চলছে। আমেরিকা নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েও বাংলাদেশকে কাবু করতে পারেনি।

বিশ্বে এখন অবাধ সংবাদ প্রবাহের যুগ। ইউক্রেনে যারা ধ্বংসকাণ্ড চালাচ্ছে, তারা কারা? রাশিয়ার টেলিভিশনে তা দেখানো হচ্ছে। ন্যাটো এবং মার্কিন সৈন্য মিলে ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে গিয়ে যে ধ্বংসকাণ্ড ঘটিয়েছে, তার ছবি পশ্চিমা কাগজগুলো রাশিয়ার বর্বরতা বলে চালাতে চাচ্ছে। এই মিথ্যাচার এ যুগে সম্ভব নয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে মানুষ আজ হোক কাল হোক, ইউক্রেন সম্পর্কে সত্য খবর জানতে পারবে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করেছে। ইরাকের বিরুদ্ধেও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল। সাদ্দাম ইরাকের অর্থনীতি এমন সুদৃঢ় করেছিলেন যে, পশ্চিমা শক্তির অর্থনৈতিক বয়কটে তার পতন হয়নি। পশ্চিমা শক্তি বারো বছর এই অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়েছিল। তাতে সতেরো লাখ ইরাকি শিশু ও নারী মৃত্যুমুখে পতিত হয়। যদি হিটলার বলে কাউকে আখ্যা দিতে হয়, তারা টনি ব্লেয়ার এবং জর্জ বুশ। আগে তাদের বিচার হোক। তারপর পুতিনের বিচার। পুতিন রাশিয়ার সামরিক শক্তির মতো অর্থনীতিও শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছেন। এখন পর্যন্ত পশ্চিমা অবরোধ কোনো কাজ করেনি। ভবিষ্যতে করবে কিনা তা দেখার বিষয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণ ছিল, তাদের ভ্রান্ত নীতি। তারা অস্ত্র তৈরি করতে শুরু করে এবং সেজন্য রুটি, বাটার, শিশুদের খেলনা ইত্যাদি নিত্য ব্যবহার্য পণ্য তৈরি করেনি। তাছাড়া আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়ে তাদের তহবিল প্রায় শূন্য হয়। এই ভুলটি পুতিন করেননি। তিনি মারণাস্ত্র তৈরি করার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অভাব ঘটতে দেননি। রাশিয়ার পক্ষে সিরিয়ার সৈন্য বাহিনীও লড়ছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার নিন্দা করেনি। এমন যে ভারত কোয়াডের সদস্য হিসেবে মার্কিন শিবিরে যোগ দিয়েছে, তারাও জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেয়নি। মনে হয়, বাইডেনের চক্রান্ত হচ্ছে ইউরোপে যুদ্ধ লাগানো এবং সেই সুযোগে ইউরোপে যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে, তা ধ্বংস করা।

জেনারেল দ্য গল যখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন আইসেনহাওয়ার। প্যারিসে যখন রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা শক্তি শান্তি আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, তখন আমেরিকা গোপনে মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণ করে এবং স্পাই প্লেন রাশিয়ার ওপর পাঠিয়ে ওই দেশের গোপন তথ্যাবলি চুরি করার চেষ্টা করে। রাশিয়া গুলি করে ওই স্পাই প্লেন ধ্বংস করে। প্যারিসে ক্রুশ্চেভ এই খবর পেয়ে রাগে উষ্ফ্মায় শান্তি আলোচনা ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে যান। আইসেনহাওয়ার তখন বলেছিলেন, ‘আমেরিকায় একটি ইনভিজিবল সরকার আছে’। এই ইনভিজিবল গভর্নমেন্ট বা অদৃশ্য সরকার যুদ্ধবাদী। এরা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের এজেন্ট। আমেরিকার অর্থনীতি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যাতে বহির্বিশ্বে অস্ত্র বিক্রি করা ছাড়া তাদের বাঁচার উপায় নেই। এজন্যই মধ্যপ্রাচ্যে এবং এখন ইউরোপে যুদ্ধ বাধানো হয়েছে। এই যুদ্ধ বাধলে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অস্ত্র বিক্রির সুবিধা হয়।

বিশ্বের শান্তিবাদী আন্দোলন থেকে বহুবার আবেদন জানানো হয়েছে, সকল দেশ যেন নিরস্ত্রীকরণের নীতি গ্রহণ করে। পশ্চিমা শক্তি সেই আবেদনে কোনো সাড়া দেয়নি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও যুদ্ধের হুমকি দিয়ে সারা বিশ্বকে আতঙ্কিত করে তুলেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, ট্রাম্পের হুমকিও অসার হুমকি। মনে করা হয়েছিল বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাহেব প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মতো শান্তিবাদী ও মানবতাবাদী হবেন। বৃদ্ধ বয়সে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। অন্যায় যুদ্ধে তিনি লিপ্ত হবেন না। দেখা গেল, তিনিও যুদ্ধবাদী অথবা ইনভিজিবল সরকারের নির্দেশে চালিত হচ্ছেন।

আমেরিকা ও ন্যাটোর অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে এশিয়ার জনশক্তির জাগ্রত হওয়া উচিত। যারা ভেবেছিল, সমাজতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে, তারা এখন স্বীকার করছেন গোটা ল্যাটিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের পতাকা উড়ছে। এই পতাকা ইউরোপ এবং এশিয়ার আকাশে উড়বে। মানুষে মানুষে দলাদলি এবং গরিব সৃষ্টির মূলে রয়েছে ধনতন্ত্র। এই ধনতন্ত্রের মরণযন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কোনো কোনো জন্তুকে হত্যা করা হলেও তারা যেমন লেজ নাড়ে, তেমনি সারা বিশ্বে নিন্দিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন লেজ ঘোরাচ্ছে। রক্তচঞ্চু ঈগল উড়ছে আমেরিকার আকাশে। কিন্তু আমেরিকার অর্থনীতি ক্রমশ পতনের মুখে। ইউক্রেনের যুদ্ধও অমীমাংসিত হতে পারে। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে মানবতার যুদ্ধ পরাজিত হবে না।

লেখক : আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী – জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ

নির্বাচিত