1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক ইতিহাসের জোরালো প্রচার প্রয়োজন

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০২২

স্বাধীনতা দিবস এলে আমরা কেবল স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়েই টানাহ্যাঁচড়া করি না; বরং ২৫ মার্চ কালরাতের কথা বলি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনি, ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও দুলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। এ সবই ঠিক আছে। কারণ এগুলো সবই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। স্বাধীনতার ইতিহাস। স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতার ইতিহাস স্মৃতিচারিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গল্পের ভেতরে যেমন অনেক গল্প লুকিয়ে থাকে, তেমনি ইতিহাসের ভেতরেও অনেক ইতিহাস মানুষের অজানা থাকে। মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক ইতিহাস রয়েছে, যা সাধারণ মানুষ এখনো জানে না, বিশেষ করে গ্রামগঞ্জের প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস। এ ইতিহাস ইতিহাসবেত্তাদের কলমে সচরাচর সেভাবে উঠে আসে না। এ রকম অনেক উঠে না আসা ইতিহাসের একটি আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

আমার মা’র বয়স প্রায় আশি বছর। প্রতিদিন তার সঙ্গে কথা বলি। ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়, তবু কথা চলে। মা-ছেলের কথা, ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলেই যথেষ্ট। বড়জোর কী খেয়েছেন বা কী রান্না করা হয়েছে, ওষুধগুলো খেয়েছেন কিনা ইত্যাদি দুই মিনিটের মধ্যেই কথা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের কথা শেষ হয় না। মা’র কণ্ঠটাকে আরও কিছুক্ষণ শোনার জন্য ইচ্ছা করেই আমি কথা লম্বা করি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এ কথা, ও কথা জিজ্ঞেস করি। আবার কোনো কোনো দিন মা নিজেও অতীত স্মৃতিতে ফিরে যান। তার স্মৃতি ও শ্রবণশক্তি দুটোই ভালো মাশাআল্লাহ। স্মরণশক্তিও বেশ প্রখর। তিনি যখন ক্লাস টু’তে পড়তেন, তখন তার চাচাত বোনের বিয়ে হয়। সে সময় তার চাচা (আমার শ্রদ্ধেয় নানা) বিয়ের আসরে পাঠ করার জন্য একটি কবিতা লিখে দেন। বিশ/বাইশ লাইনের কবিতাটি এখনো তার ঠোঁটস্থ। সেদিন আমাকে এক নিশ্বাসে শোনালেন, যা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। আমার মা খুব সম্ভবত ফাইভ/ সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু বই পড়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। কথায় কথায় একদিন বললেন, ‘আজকালকার ছেলেমেয়েদের তো বই পড়ার প্রতি তেমন বেশি আগ্রহ নেই; ওরা তো ফেসবুক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু আমাদের সময়ে ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আমরা বই পুস্তক পড়তেই বেশি পছন্দ করতাম। তোমার বাবার সংগ্রহে প্রায় দেড় দুইশ বই ছিল। তার সবগুলোই আমি পড়েছি।’ অর্থাৎ সংসারের সব কাজকর্ম সেরে আমাদের খাইয়েদাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে কুপিবাতি জ্বালিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত বই পড়তেন। স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে মা আমাকে এখনো ওইসব বইয়ের গল্প শোনান।

বই পড়ার কথা বলতে গিয়েই একটু আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন তিনি। বাবার কথা মনে পড়ে গেল তার। আমার বাবা মারা গেছেন প্রায় বিশ বছর আগে। আমরা ভাইয়েরা যখন বড় হলাম, কামাইরুজি করতে শিখলাম, তখনই তিনি চিরতরে চলে গেলেন। সুখভোগ করার সৌভাগ্য তার হয়নি। সারা জীবন শত্রুদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে টিকে থাকতে হয়েছে। একজন স্কুল শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন ন্যায় ও আদর্শের প্রতীক। অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ানো ছিল তার স্বভাবের বাইরে। সততা, আদর্শ, পরহিতৈষী মনোভাব, গরিব ও সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলাই ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্যই তার জন্য কাল ছিল। এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই তিনি ধান্দাবাজ সমাজপতিদের কাছে শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। আর এ শত্রুতার জের হিসাবে তারা মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। কয়েকদিন আগে মা আমাকে ওই গল্পটি শোনালেন।

১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধনু নদীতে চলন্ত লঞ্চ থেকে সহসা গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এলো। মিলিটারি এসে গেছে ভেবে গ্রামবাসী তটস্থ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর লঞ্চ যখন গ্রামের বাজারে এসে থামে, তখন বুঝতে পারল, ওরা মিলিটারি নয়; মুক্তিবাহিনীর একটি দল। গ্রামবাসী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু ওই হাঁফ ছেড়ে বাঁচাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কমান্ডার সাহেব গ্রামের মাথা শ্রেণির লোকদের ডেকে পাঠালেন। চেয়ারম্যান মেম্বারসহ অনেকেই জড়ো হলেন। আমার বাবাও এলেন। আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেককে এ গ্রামে কালপ্রিট কে, রাজাকার কে, তা লিখে দেওয়ার জন্য বলা হলো।

আমার বাবা কে কালপ্রিট, কে রাজাকার কিছুই বললেন না; কিন্তু একজন জনপ্রতিনিধি ও তার ভাই আমার বাবাকে তাদের শত্রু ও কালপ্রিট বলে উল্লেখ করল এবং আমাদের পাড়াতেই ঐতিহ্যবাহী এক হিন্দু বাড়িতে দু-একদিন আগে যে ডাকাতি হয়েছিল, তার দায়ভার তার উপর চাপানোর চেষ্টা করল। আমার বাবার হুকুমেই ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে বলে কমান্ডারকে জানানো হলো। যারা ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল, তাদেরকে সামনে হাজির করা হলো। ওরাও আমার বাবাকে ‘হুকুমদাতা’ বলে সাক্ষী দিল। বস্তুত ওরা ছিল ওই জনপ্রতিনিধি গোষ্ঠীর পা চাটা গোলাম। তাদের শেখানো বুলিই ওরা অনবরত বলে যাচ্ছিল। সত্য কথা স্বীকার করানোর জন্য যতই ওদেরকে প্রহার করা হচ্ছিল, ততই তারা আমার বাবার নাম বলছিল। কিন্তু কমান্ডার সাহেব ছিলেন বেশ বিচক্ষণ লোক। তিনি কোনো অবস্থাতেই তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বুঝতে পারছিলেন এটা ষড়যন্ত্র। তাই তিনি বাবার কাছে গেলেন। বললেন, ‘আপনার চেহারা এত মলিন কেন! অভয় দিচ্ছি, আপনাকে গুলি করা হবে না।’

এর একটু পরই একটি গুলির শব্দ শোনা গেল। ফাঁকা গুলি। ডাকাতদের ভয় দেখানোর জন্যই মূলত এ গুলি করা হয়েছিল। কিন্তু মানুষ বলাবলি করতে লাগল এই বুঝি মাস্টার সাহেবকে গুলি করে হত্যা করা হলো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাবাকে গুলি করা হয়নি; বরং কমান্ডার সাহেব তাকে বাড়ি যেতে বললেন। কথিত ওইসব জনপ্রতিনিধিদের অপকর্ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সারা জীবন যে তিনি কলমযুদ্ধ করেছেন, তার প্রমাণপত্র হাজির করার জন্য অনুরোধ করা হলো। বাড়িতে এসে আলমারি থেকে পুরোনো ফাইল ভর্তি পিটিশন নিয়ে কমান্ডার সাহেবকে দেখালেন। কমান্ডার সাহেব যা বোঝার তা বুঝে ফেললেন। আমার বাবাকে সসম্মানে ছেড়ে দিলেন। ডাকাতগুলোকে গুলি করে মারতে চাইলেন। কিন্তু বাবার অনুরোধে তারা বেঁচে গেলেন।

আমি আমার পরিবারের, গ্রামের এ করুণ ইতিহাসটি গাল্পিক আকারে টানলাম। কিন্তু এমন করুণ ইতিহাস শুধু আমার গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলার প্রতিটি গ্রামে এমন হাজারো ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। আমার বাবা হয়তোবা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন; কিন্তু এমন অনেকে আছেন, যারা নিজেদের বাঁচাতে পারেননি।

‘মুক্তিযুদ্ধ’ একটি অহংকারের নাম। আর ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ত্যাগ ও মহিমার নাম। গর্ব ও গৌরবের নাম। একটি শ্রদ্ধার প্রতীকের নাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজাকার সেজে যেমন কিছু কিছু লোক মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিল, জীবনবাজি রেখে দেশের জন্য কাজ করেছিল; ঠিক তেমনি মুক্তিযোদ্ধার পোশাক পরেও কিছু কিছু লোক দেশবিরোধী কাজ করেছে। গ্রামগঞ্জে ডাকাতি করেছে, লুটপাট করেছে। বর্ডারমুখী শরণার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এসবই কঠিন বাস্তবতা, রূঢ় ইতিহাস। কিন্তু এসব ইতিহাস খুব বেশি একটা চোখে পড়ে না। পত্রপত্রিকায় লেখা হয় না। ইতিহাসবিদরা এসব নিয়ে খুব বেশি একটা মাথা ঘামান না, গবেষণাও করেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিখুঁতভাবে তুলে ধরা ও একে সমৃদ্ধ করে তোলার স্বার্থে গ্রামবাংলার প্রান্তিক ইতিহাসকে মোটেও হেলা করা উচিত নয়। আশা করি, ইতিহাসবেত্তারা বিষয়টি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করবেন।

প্রত্যক্ষভাবে যারা স্টেনগান, রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তারা যে মুক্তিযোদ্ধা; তা নতুন করে বলে বোঝানোর দরকার নেই। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তারা। তবে সাধারণ মানুষ, যারা পাকিদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, যারা যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তাই আমি বলতে চাই, শুধু রাজাকার, আলবদর, আলসামস তথা মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ছাড়া বাংলার প্রত্যেক মানুষই তখনকার স্ব স্ব অবস্থানে ছিলেন একেকজন মুক্তিযোদ্ধা।

লেখক : সাজেদুল চৌধুরী রুবেল – কবি ও প্রাবন্ধিক, আয়ারল্যান্ড প্রবাসী। 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ