1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ইন্টারনেট আসক্তি থেকে শিশুদের দূরে রাখুন

ডা. ফারহানা মোবিন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০২৩

ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিস-অর্ডার বর্তমানে সারা পৃথিবীতে মহামারির রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশেও এই সমস্যা এখন প্রকট। আমাদের দেশে আগে ইন্টারনেট আসক্তি ছিল শুধু শহরকেন্দ্রিক। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরাও ইন্টারনেটের দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ছে।

গ্রাম ও মফস্বল শহরের শিশু-কিশোররা সহপাঠী, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলার সুযোগ পায়। কিন্তু রাজধানী ঢাকার অগণিত শিশু থাকে ঘরের মধ্যে। স্কুলের ক্লাস শেষে ঘরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। সব শিশু-কিশোর সৃজনশীল কাজে সংযুক্ত হওয়ার সময় ও সুযোগ পায় না। খেলার মাঠ আর মা-বাবার সময়ের অভাবে অসংখ্য শিশু-কিশোর মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবের প্রতি ঝুঁকে যায়। স্কুল থেকে আসার পর অনেক শিশু-কিশোরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। বিশেষত যেসব শিশু-কিশোর বাসায় একা দিন পার করে, তাদের বেশির ভাগের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি থাকে খুব বেশি।

বড়দের মধ্যেও ইন্টারনেট আসক্তি দেখা যায়। তবে আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশু-কিশোর, প্রাপ্তবয়স্করা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অতিমাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য জরুরি কাজগুলো বাধাগ্রস্ত হয়। ইন্টারনেটের প্রতি নেশাগ্রস্ত হওয়ার জন্য খাওয়া, ঘুমানো, গোসল, লেখাপড়া, বাসার সদস্যদের সময় দিতে ভুলে যায়। যখন কোনো মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারলে অস্থির হয়ে ওঠে, এই ধরনের পরিস্থিতিকে বলে ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিস-অর্ডার।

আমাদের অসংখ্য শিশু-কিশোর বর্তমানে ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিস-অর্ডারে আক্রান্ত। বাবা নামের মানুষটি দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন বাসার বাইরে, মা গৃহিণী হলেও ঘরের কাজে মনোযোগ দিতে হয়। আর যেসব মা কর্মজীবী সেই সব মা-বাবার সন্তানরা হয় আরো বেশি দুর্ভাগা। রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ শিশু-কিশোর মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব বা কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

আজকাল শহরের বেশির ভাগ বাসায় থাকে ওয়াই-ফাইয়ের সংযোগ। বাসার পুরনো বাতিল হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন দিয়ে অনেক শিশু-কিশোর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইউটিউব দেখে, আবার অনেক সময় যোগাযোগের জন্য মা-বাবা সন্তানকে মোবাইল ফোন দিতে বাধ্য হন অথবা বাসার মোবাইল ফোন দিয়েও শিশু-কিশোরদের গেম খেলতে দেখা যায়।

রাস্তার জ্যাম পাড়ি দিয়ে কর্মজীবী মা-বাবাদের বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অভিভাবক সন্তানকে সময় দিতে না পারা, শিশু-কিশোরদের প্রতি মনোযোগের অভাবে ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেটের প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছে বেশি।

গ্রামাঞ্চলে বা মফস্বল শহরে এখনো অনেক যৌথ পরিবার আছে। যৌথ পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়। এ ধরনের জায়গাগুলোতে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে থাকে খুব ভালো বন্ধন। এতে শিশু-কিশোররা অগণিত মানুষ ও পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে শেখে। তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু শহরাঞ্চল, বিশেষত ঢাকার ছেলেমেয়েরা খুব বেশি নিঃসঙ্গ। তারা একাকিত্বে ভোগে খুব বেশি। মা-বাবা, বড় ভাই বা বোন—সবাই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বিনোদন হিসেবে কিছু নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য ইন্টারনেটকে বেছে নেয়।

মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের নীল আলো আর রংবেরঙের ভিডিওতে শিশুরা খুব দ্রুত আকৃষ্ট হয়। কোনো কিছুতে আমাদের খুব ভালো লাগা কাজ করলে আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা আমাদের ভালো লাগার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। কোনো কিছু নিয়ে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভালো লাগে, তখন দেহ বারবার সেই ভালো লাগা পেতে চায়। শিশু-কিশোররা এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তাদের আসক্তির পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন তাদের খুব ভালো লাগে। এভাবে দিনের পর দিন ভালো লাগা নেশায় পরিণত হয়। অতিমাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য শিশু-কিশোররা আসক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মস্তিষ্ক ভিডিও গেম দেখার জন্য তাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন ইন্টারনেট না পেলে শিশু-কিশোররা অস্থির হয়ে ওঠে।

ইন্টারনেট আসক্তি ভয়াবহ এক মহামারি। পৃথিবীব্যাপী ভয়ানক এক সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধিতে বয়স্করাও অনেকেই আক্রান্ত। শিশু-কিশোররা ভিডিও গেম খেলে বেশি। আর বয়স্করা সোশ্যাল মিডিয়া ইউটিউবে আসক্ত বেশি।

বড়রা ঘরের বাইরে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু শিশু-কিশোর, যারা ঘরে থাকে বেশি, তারা খুব দ্রুত ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিস-অর্ডারে আক্রান্ত হয়। ইন্টারনেট আসক্তির জন্য লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ভিডিও গেম খেলার জন্য হাঁটা-চলার অভাবে অসংখ্য শিশু-কিশোরের ক্ষুধামন্দা, খাবারে অরুচি, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য তৈরি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও গেম খেলা বা কার্টুন দেখার কারণে চোখে ব্যথা, নিয়মিত মাথা ব্যথা থাকতে পারে। বাড়ন্ত বয়সে শিশু-কিশোরদের হাঁটা-চলা, খেলাধুলা খুব দরকার। বাড়ন্ত বয়সে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য মানুষজনের সঙ্গে বন্ধুত্বের খুব দরকার।

ইন্টারনেট আসক্তি একজন শিশু বা কিশোরের শুরুর দিকেই থাকে না। দিনের পর দিন অতিমাত্রায় স্ক্রিন ব্যবহারের জন্য নেশায় পরিণত হয়। তখন মা-বাবার সঙ্গেও সন্তানের ভালো লাগে না, বাসায় কেউ বেড়াতে এলে দরজা বন্ধ করে রাখতে দেখা যায়, বাসার নিচে খেলার মাঠ থাকলেও সেখানে খেলতে ভালো লাগে না। মা-বাবার সঙ্গে টিভি দেখা, বেড়াতে যাওয়া, গল্প করা তখন হয়ে ওঠে খুব বেশি বিরক্তিকর। স্কুলে যেতেও ভালো লাগে না। অনেকে পরীক্ষায় খুব খারাপ নম্বর পেতে থাকে। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারলে বাসার মানুষজনের ওপরও বিরক্ত হয়। খাবারেও তৈরি হয় অনীহা, পিঠে ব্যথা, ঘাড়ের ব্যথায়ও অনেকে আক্রান্ত হয়।

অনেক শিশু-কিশোর মা-বাবা, পরিবারের সদস্যদের মনোযোগের অভাবে অপরিণত বয়সে প্রাপ্তবয়স্কদের ভিডিও দেখতে শুরু করে। অনেকে মাদকদ্রব্য কেনা-বেচায় জড়িয়ে যায়। বিভিন্ন অপরাধীচক্রের সদস্য হয়ে পড়ে। আজকাল বহুবিধ কিশোর অপরাধচক্র রয়েছে। তারা এই ধরনের শিশু-কিশোরদের টার্গেট করে ফেলে, প্রথমে বন্ধুত্ব করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তারপর বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে দেয়। এ ধরনের চক্রগুলোতে শুধু সুবিধাবঞ্চিত নয়, অসংখ্য ভালো পরিবারের ছেলেমেয়েরাও বিপদে পড়ে যায়।

অনেকে ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে কুরুচিপূর্ণ টিকটক ভিডিও ধারণ করে। এই ধরনের ভিডিও দেখার জন্য কিছু শিশু-কিশোরের বিকৃত মনমানসিকতা গড়ে ওঠে। যার পরিণতি ভয়াবহ।

ভালো কিছুর আসক্তি মানুষের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু মাদকদ্রব্য, অতিমাত্রায় ইন্টারনেট ভয়ানক এক আসক্তি তৈরি করে। হয়তো ছুটির দিনগুলোতে মা-বাবা, বড় ভাই-বোন, দাদা-দাদি বাসায়ই রয়েছেন। কিন্তু ইন্টারনেট আসক্তির জন্য এসব মানুষ বাসায় থাকা সত্ত্বেও তারা ভিডিও গেম, ইউটিউব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এক পর্যায়ে স্কুলে যেতেও ভালো লাগে না। শিশু-কিশোররা মা-বাবাকে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা বলতে শুরু করে। ভয়ানক এই পরিস্থিতিই হলো ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিস-অর্ডার।

ইন্টারনেটের ভয়াবহ আসক্তি থেকে দূরে থাকতে মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সব সদস্যকে তৎপর হতে হবে। নয়তো একই সঙ্গে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হবে। তারা জড়িয়ে পড়বে বহুবিধ সামাজিক ব্যাধিতে।

 লেখক: ডা. ফারহানা মোবিন – মেডিক্যাল অফিসার, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ