1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বুড়িগঙ্গার ৫০ টাকায় রাত্রিযাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০২২

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছনে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চারটি ট্রলার। ট্রলারগুলো ওই জায়গায় দাঁড়িয়েই থাকে। কারণ সেগুলোকে নদীতে চালানোর পরিবর্তে মানুষের থাকার উপযোগী করে বানানো হয়েছে ভাসমান বোর্ডিং। ‘ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিং’, ‘শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিং’, ‘উমাউজালা’ এবং ‘বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং’ নামের চারটি ট্রলারে স্বাধীনতার পর থেকে কম মূল্যে সাধারণ মানুষের থাকার জন্য বোর্ডিং চারটি পরিচালিত হচ্ছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সদরঘাট ও আশপাশে ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের এই প্রাণকেন্দ্রগুলোতে লাখ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। যাদের হোটেলে থাকার সামর্থ্য নেই তারা দু-একদিনের জন্য থাকেন এসব বোর্ডিংয়ে। এছাড়া সদরঘাট ও বাদামতলী এলাকার হকার, ফড়িয়া, ভ্যানচালক, দিনমজুর ও ফুটপাতের অস্থায়ী ব্যবসায়ীরা সারাদিন কাজ করে রাতে কম টাকায় ভাসমান এই বোর্ডিংগুলোতে থাকেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা এসেছিলেন দু’বার। দু’বারই তিনি অতিথি হিসেবে রাত কাটিয়েছেন নবাবদের প্রমোদতরীতে। কালের বিবর্তনে প্রমোদতরী হারিয়েছে আবেদন। তবে সেগুলোর আদলে তৈরি হয়েছে ভাসমান নৌকা। বুড়িগঙ্গার ধারে স্বগর্বে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে সেই নৌকা। কিন্তু প্রমোদতরী হিসেবে নয়, সস্তা হোটেল হিসেবে।

রবীন্দ্রনাথের ঢাকা ভ্রমণের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ভাগ্যকুলের জমিদার ও ঢাকার নবাবদের একাধিক তরী বুড়িগঙ্গায় ভাসমান থাকত। এসব প্রমোদতরী রাষ্ট্রীয় সফরে ব্যবহার করা হতো। এর মধ্যে কবিগুরু ১৮৯৮ সালে ঢাকায় এসে কুণ্ডুদের প্রমোদতরী এবং ১৯২৬ সালে নবাবদের হাউস বোট ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া ব্রিটিশদের ব্যবহৃত প্রমোদতরীও পাগলা ঘাটে ভাসমান হোটেল হিসেবে একসময় ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬০৮ সালে, মতান্তরে ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করে সুবেদার খাঁ চিশতীকে সেখানে পাঠান। চাঁদনী নামে এক বড় নৌকায় তিনি দলবলসহ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নামেন। সেই স্থানটি পরে ‘ইসলামপুর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর যেখানে চাঁদনী রাখা হতো, সেখানকার নামকরণ হয় ‘চাঁদনী ঘাট’। এখনও চাঁদনী ঘাট রয়ে গেছে কিন্তু সেখানে কোনো প্রমোদতরী দেখা যায় না। তবে প্রমোদতরীর আদলে তৈরি করা হয়েছে নৌকা। যেগুলো এই গ্রহের সবচেয়ে সস্তা হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে- একথা বলাই যায়। কালের পরিবর্তনে যেগুলো এখন বাবুবাজার ঘাটে নিয়ে আসছে।

সদরঘাটের পাশে মিটফোর্ড ঘাটে সরেজমিনে দেখা যায়, এই চারটি ভাসমান বোর্ডিং নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এর মাঝে ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের দোতলা মিলিয়ে মোট ৩৫টি কেবিন এবং দুটি ডালা সিট রয়েছে। প্রতিটি কেবিনে রয়েছে একটি খাট, বালিশ, কাঁথা ও ফ্যান। ছোট আকারের এই কেবিনগুলোতে রয়েছে আয়েশ করে শোয়ার ব্যবস্থা। এই বোর্ডিংগুলোর সিঙ্গেল কেবিনে ১০০ টাকা এবং ডাবল কেবিনে ১৫০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়। এছাড়া ডালা সিটে ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। মানে কেবল ৫০ টাকা হলেই রাত্রিযাপনের সুযোগ মেলে এই বোর্ডিংগুলোতে।

একই অবকাঠামোতে দাঁড়িয়ে শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিং। সেখানে ৪০টির মতো কেবিন রয়েছে। প্রতিটি কেবিনে রয়েছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা, লাইট ও ফ্যান। রয়েছে রাত যাপনের মতো একটি বিছানা।

পাশের উমা উজালা বোর্ডিং অন্য দুটির তুলনায় কিছুটা ছোট। এখানে মোট ৪২ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার শামিম জানান, আমরা এখন প্রতি সিট ৪০ টাকা, কেবিন ১০০ টাকা নেই। মানুষের থাকার মতো মোটামুটি সব ব্যবস্থা এখানে আছে।

বুড়িগঙ্গা বোর্ডিংয়েও ৪০-৫০ জন মানুষ থাকার মতো ব্যবস্থা আছে। এটি আগে বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং নামে পরিচিত থাকলেও এর মালিকানা স্থানীয় সবুজ মিয়া নামে এক ব্যক্তি কিনে নিয়েছেন। এরপর থেকে অনেকেই একে সবুজ মিয়ার বোর্ডিং নামে চেনেন।

ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ে নিয়মিত থাকেন রিকশাচালক ফাহাদ। তিনি বলেন, রিকশা চালাই। মেসে থাকার ক্ষমতা নাই। আগে রিকশায়, বিভিন্ন দোকানের সামনে রাত কাটাতাম। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যকে এই হোটেলের খোঁজ পাই। এখন এখানেই থাকি। মাঝে মাঝে টাকা-পয়সা কম আয় হলে আবার রিকশায় থাকি।

বোর্ডিংয়ের নিচতলায় ডালা সিটে ছিলেন কয়েকজন হকার। তারা আশপাশের এলাকায় ফল বিক্রি করেন।

তারা বলেন, আমরা রাস্তার পাশে ফল বিক্রি করি। যে টাকা আয় করি তাতে বাসাবাড়িতে থাকা সম্ভব নয়। এখানে দৈনিক ৫০ টাকায় থাকি।

সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে তারা বলেন, এখানে নিরাপত্তা বলতে প্রতি রুমের একটি করে চাবি থাকে সবার কাছে। খাওয়া-দাওয়া বাইরে করি। তবে নদীর পানি নোংরা হওয়ায় গোসলে একটু সমস্যা হয়।

ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার মোস্তফা কামাল বলেন, এখানে আমি ২০ বছর ধরে ম্যানেজার। এই ভাসমান বোর্ডিংয়ে কখনো কোনো বিশৃঙ্খলা দেখিনি। যেই আসুক, শুধু আইডি কার্ড দেখে কম মূল্যে থাকার ব্যবস্থা করি। এখানে সদরঘাট এলাকা ছাড়াও ঢাকার দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে থাকে। ভোরে চলে যায়, আবার রাতে চলে আসে। অনেকেই আছে টানা মাসের পর মাস থাকে। মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। একজন মানুষের থাকার জন্য যে সুযোগ দরকার, তার সবটুকু ব্যবস্থা করি।

আবাসন নিয়ে শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা মালিক আব্দুস সাত্তারের ছেলে শাহ জামাল বলেন, আমার বাবা ১৯৬০ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। সাধারণ মানুষের জন্যই যুগ যুগ ধরে আমাদের এই ভাসমান বোর্ডিং। বিআইডব্লিউটিএ থেকে আমাদের ওয়াইজঘাট থেকে এখন বাবুবাজার ঘাটে নিয়ে এসেছে। এখন অনেক মানুষ চেনে না। এ কারণে কাস্টমার কমে গেছে।

ভাসমান এই হোটেলগুলো নিরাপত্তার স্বার্থে রাত ২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। এছাড়া বাকি সময়ে বোর্ডিং খোলা থাকে। দায়িত্বে থাকেন বোর্ডিংয়ের ম্যানেজাররা।

নিরাপত্তার বিষয়ে বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই রাজিব বলেন, অনেক বছর থেকেই বুড়িগঙ্গায় ভাসমান এই হোটেল দেখে আসছি। নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের কাছে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। এরা বিআইডব্লিউটিএ থেকে ইজারা নিয়ে বাবুবাজার ঘাটের পাশে অবস্থান করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই সদরঘাটে ভাসমান এই বোর্ডিংগুলো রয়েছে। শুরুর দিকে অবকাঠামোগতভাবে এগুলো কাঠের বোট ছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে এগুলোকে সংস্কার করা হয় লোহা দিয়ে। পানিতে বছরের পর বছর থেকে নষ্ট হয়ে গেলে ডকইয়ার্ডে নিয়ে আবার সংস্কার করে রঙ লাগিয়ে আনা হয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ