ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার বিস্তীর্ণ চরে গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। এরই মধ্যে একটি অংশের কাজ শেষে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় কর্মকর্তারা।
প্রথম ধাপে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে জাতীয় গ্রিডে ৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে বলে আশা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।
সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন জানান, সরকারিভাবে চট্টগ্রামের কাপ্তাই ও সরিষাবাড়ির পর ফেনীর সোনাগাজীর সমুদ্র উপকূলে অঞ্চলে ২০২১ সালে শুরু হয় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণের কাজ। উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের এক হাজার একর জমিতে গড়ে উঠা দেশের বৃহত্তম এই প্রকল্পটিতে প্রথম ধাপে অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক।
‘ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের’ (বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠান) মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে পাওয়ার সেলের তত্ত্বাবধানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, প্রথম ধাপে ২৮৫ একর জমিতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৮৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ থেকে ৬২১ কোটি টাকা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৮ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘টিনা সোলার’ কাজ করছে বলে জানান উপ-প্রকল্প পরিচালক ফরিদ উদ্দিন।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে এক লাখ ৭৮ হাজার প্যানেলে সোলার বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। কর্মকর্তাদের অফিস ও আবাসিক ভবনের নির্মাণ কাজও শেষ হয়েছে। সমুদ্র উপকূলের জলোচ্ছ্বাস ও বাতাসের গতিবেগের ১০০ বছরের সমীক্ষা বিবেচনায় গোটা প্রকল্প এলাকায় লবণাক্ত পানি রোধে পাঁচ মিটার উচ্চতার আট কিলোমিটার বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রায় ৯৮ শতাংশ কাজ শেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা হয়। গড়ে দৈনিক ৭৩ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। মিরসরাই বেজা গ্রিড সাব স্টেশনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ।
প্রধানমন্ত্রী কিছুদিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে বৃহৎ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করবেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, কাজ শুরুর পর প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। ভবিষ্যতে প্রকল্পের জমিতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি প্যানেলগুলোর নিচের অংশে ও কৃত্রিম খালে শাকসবজি উৎপাদন করা হতে পারে; যা কৃষিতেও অবদান রাখবে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোশারফ হোসেন জানান, দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ বাঁকা নদী সোজা করায় ফলে এ অঞ্চলে বিশাল চর জেগে ওঠে। এক সময় এ চরে কিছুই ছিল না। নোনা পানি আসায় ফসলও তেমনটা হত না। এখন এখানে কর্মযজ্ঞ হচ্ছে। এখানকার বিদ্যুৎ যাবে জাতীয় গ্রিডে। সোনাগাজী আর অবহেলিত এলাকা নয়।
ফেনী লেখক ফোরামের আহ্বায়ক নুরুল আমিন হৃদয় জানান, বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এক সময় গবাদি পশু চড়ে বেড়াত। অনাবাদি পতিত জমিগুলোকে কাজে লাগিয়ে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার; যা দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অপার সম্ভাবনা তৈরি করছে।
আরেক বাসিন্দা মো. আমজাদ হোসেন নাহিদ বলেন, “এ অঞ্চলে যে বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে তা এ প্রকল্প থেকে সোনাগাজীতে দিতে হবে। গ্রাহকদের চাহিদা মিটিয়ে যেন অন্য জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, যা সোনাগাজীবাসীর প্রাণের দাবি।”
সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ হোসেন মিলন বলেন, “সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য সৌভাগ্যের। এখানকার উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যাবে। বিদ্যুৎ খাতে সোনাগাজীর মানুষেরও ভূমিকা আছে; যা কোনো অংশেই কম নয়।”
সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ৭৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার পর আরও ১০০ মেগাওয়াট করে তিনটি প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে; যার অর্থায়ন করবে সিঙ্গাপুর ও জাপান।
এর মধ্যে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (ইজিসিবি) ও জাপানের মারুবেনি করপোরেশন যৌথভাবে নির্মাণ করবে বলে জানান তিনি।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে এ বিষয়ে ইজিসিবি ও মারুবেনি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তি অনুসারে দুই কোম্পানির অংশীদারত্বে গঠিত হবে ফেনী সোলার পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড; যেখানে সমানভাবে বিনিয়োগ করবেন তারা।
২০২৬ সালের জুনে এ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে বলে জানান তিনি।