1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

পদ্মা সেতু : অসাধ্যকে সাধন

সুভাষ সিংহ রায় : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০২২

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সরকারের মেয়াদকালেই যমুনা সেতুর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর কাজ সমাপ্ত এবং ১৯৯৮ সালে পদ্মায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। সম্ভাব্যতা যাচাই ও সমীক্ষার পর ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তারপর বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বাভাবিক কারণেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের অগ্রগতি হয়নি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে পদ্মা সেতু প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত হয়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেতু নির্মাণে অর্থায়নকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের একটি অভিযোগ। প্রকল্পের নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়া চলাকালীন কানাডার একটি কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগ তোলা হয়। এর আলোকে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা এবং ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের এসব অভিযোগ প্রথম থেকেই প্রত্যাখ্যান করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে বিশ্বব্যাংক। বিশেষজ্ঞ প্যানেল বাংলাদেশের যুক্তি মানলেও শেষ পরিণতিতে তাদের একটিই দাবি ছিল- ‘দুর্নীতি না হলেও ষড়যন্ত্র হয়েছে’। পরবর্তীকালে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে, কানাডার সুপিরিয়র কোর্টের এক রায়ে বলা হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই এসএনসি-লাভালিনের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে খালাস দেওয়া হয়। কানাডার টরন্টো স্টার সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী রায়ের আদেশে বিচারক বলেন- অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা জল্পনা, গুজব আর জনশ্রুতি ছাড়া কিছুই না।

বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পরপরই অদম্য সাহস ও দৃঢ়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে সেতু সম্পন্ন করার ঘোষণা দেন। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের সরকারপ্রধান হয়েও বিদেশি কোনো সাহায্য ছাড়া এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের যে দুঃসাহসিক পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, তা আসলেই সম্ভব কিনা, এ নিয়েও কম জল্পনা হয়নি। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা উড়িয়ে দিয়ে সেই স্বপ্ন এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ফলে পদ্মা সেতু আমাদের কাছে নিছক কোনো স্থাপনা নয়; এটা বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রমাণ, বাঙালির গর্ব ও অহংকারের নিদর্শন। সর্বোপরি এই সেতু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়প্রত্যয়ের ফসল।
শুধু আর্থিক চ্যালেঞ্জ নয়; পদ্মা সেতু প্রকল্পকে মোকাবিলা করতে হয়েছে কারিগরি ও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা। কারিগরি দিক থেকে পদ্মা সেতুতে বিশ্বরেকর্ডের সংখ্যা তিনটি। প্রথমত, পদ্মা সেতুর খুঁটির নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের তিন মিটার ব্যাসার্ধের পাইল বসানো হয়েছে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং প্রয়োজন হয়নি এবং মোটা পাইল বসানো হয়নি। দ্বিতীয়ত, এই সেতুতে ‘ফ্রিকশনলাম বিয়ারিং’ সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে। তৃতীয়, নদীশাসনে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশনের সঙ্গে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এর আগে নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র আর হয়নি।

পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথাও বলতে হবে। বস্তুত ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতে কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। চিহ্নিত একটি মহলের উদ্দেশ্যই হলো ক্রমাগতভাবে দেশের স্বার্থ ও জনকল্যাণবিরোধী ইস্যু তৈরি করা। যেমন অর্থায়ন, কারিগরি, প্রাকৃতিক- সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পদ্মা সেতু যখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়, তখন বলা হচ্ছে, ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতুতে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার কোটি। কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে বলছেন ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবে পদ্মা সেতুতে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বাকি অর্থ খরচ হয়েছে সংযোগ সড়কসহ ১২ কিলোমিটার টোল প্লাজা এবং এসএ-২, নদীশাসন, পুনর্বাসন, ভূমি অধিগ্রহণ (২৬৯৩.২১ হেক্টর), পরিবেশ, পরামর্শ এবং অন্যান্য (বেতন, পরিবহন, সিডি ভ্যাট এবং ট্যাক্স, পিওই, শারীরিক এবং মূল্যসাপেক্ষতা, সুদ ইত্যাদি) খাতে। সব মিলিয়ে ৩০ হাজর ১৯৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আসলে সংশয় সৃষ্টি করার জন্যে এভাবে ভুল, বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে অন্য সবকিছুর সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণেও আসবে মাইলফলক গতি। গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা হবে রপ্তানিমুখী। দারিদ্র্য নিরসন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। গতি ও মাত্রা বাড়বে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় যান চলাচলের। সব মিলিয়ে সেতুর উভয় পাশে বিকাশ ঘটবে সুষম অর্থনীতির। গবেষণা বলছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব জেলাকে সারাদেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে এ সেতু। দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড রাজধানী থেকে পরিচালিত হয়; কিন্তু এই উন্নয়নের সুবিধাগুলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পদ্মা বড় একটা বাধা। পদ্মা সেতু চালুর পর যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সুযোগ সৃষ্টি হবে প্রায় তিন কোটি মানুষের জীবনে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সীমা ছাড়ানো অবদান রাখবে।
এই নিবন্ধ লিখতে গিয়ে ২০১২ সালের ৮ জুলাইয়ের সেই দৃশ্যটার কথা মনে পড়ছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করে দেশ জয় করেছি। বাংলার মানুষ কারও কাছে মাথা নত করতে জানে না। আমি আশাবাদী। আমি আত্মবিশ্বাসী।’ এ সময় সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য সমর্থন জানান। তিনি বলেছিলেন- ‘বাঙালি জাতি এক হলে অসাধ্য সাধন করতে পারে।’ ষড়যন্ত্র হয়েছে, বাধা এসেছে; তাতে কী! পদ্মা সেতু নিয়ে অসাধ্যকে আরেকবার সাধন করে দেখিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

লেখক : সুভাষ সিংহ রায় – রাজনৈতিক বিশ্নেষক, সাবেক ছাত্রনেতা। 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ