1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সেমিকন্ডাক্টর: সম্ভাবনাময় অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

মো. শামীম সারোয়ার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০২৩

শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা অনেক যুদ্ধের কথা শুনেছি। এই শতাব্দীতে এসেও আমরা অনেক যুদ্ধ দেখছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যেমন পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তেমনি চীন-তাইওয়ান যুদ্ধের ইঙ্গিত পৃথিবীকে আবারও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। চীন-তাইওয়ান যুদ্ধ হলে কার্যত পৃথিবী থেমে যাবে।

কারণ বর্তমান পৃথিবীর ইলেকট্রনিকস সুপারপাওয়ারের নাম হচ্ছে তাইওয়ান। তাইওয়ানের টিএসএমসি কম্পানি সিলিকন চিপ বা সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসার ৬৬ শতাংশ একাই নিয়ন্ত্রণ করে। ৯২ শতাংশ অ্যাডভান্স চিপ এই তাইওয়ানে তৈরি হয়। করোনার সময় এই কম্পানির উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় টেলিকমিউনিকেশন থেকে শুরু করে মেডিক্যাল সেক্টর পর্যন্ত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

টয়োটা, অ্যাপল, ফোর্ট, টেসলার মতো নামিদামি কম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজকের এই অবস্থানে তাইওয়ান কিভাবে গেল, তা বুঝতে হলে আমাদের সিলিকন চিপ নিয়ে একটু প্রাথমিক ধারণা নিতে হবে। বর্তমানে চিপ এখন ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

২.

সেমিকন্ডাক্টর বলতে অর্ধপরিবাহী বা অপরিবাহী পদার্থ, যার প্রধান উপাদান সিলিকন বা বালু। বালুকণায় সিলিকন ছাড়াও অন্যান্য উপাদান থাকে। বালুকণা কোয়ার্টস দিয়ে গঠিত, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে সিলিকন বা বালু। এ ধরনের অর্ধপরিবাহী পদার্থ দিয়ে ট্রানজিস্টর তৈরি করা হয়। সহজ ভাষায়, সিলিকনের মধ্যে ট্রানজিস্টরসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র উপাদান স্থাপন করে যে সার্কিট তৈরি হয়, সেটিকে বলা হয় ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসি বা চিপ। এই চিপ তৈরিতে মেশিন, সফটওয়্যার এবং ডিজাইন দেয় যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানি।

জাপান তৈরি করে প্রয়োজনীয় মেটাল ও কেমিক্যাল। নেদারল্যান্ডস ইউভি লেজার মেশিন তৈরি করে, যা দিয়ে (ওয়েফারস) চিপ বানানো হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান চিপ ডিজাইন করে তাদের বলা হয় ফেবলেস কম্পানি, আর যারা চিপ বানায় তাদের বলা হয় ফাউন্ড্রি। টিএসএমসি শুধু ফাউন্ড্রি করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেমিকন্ডাক্টর কম্পানি।

৩.

ট্রানজিস্টর পৃথিবীর সেরা আবিষ্কারের মধ্যে একটি। একটি কম্পিউটার মাইক্রোপ্রসেসরে ১৯ বিলিয়নের বেশি ট্রানজিস্টর থাকে। ১৯৫৯ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার সিস্টেমে সিগন্যাল আদান-প্রদানের জন্য টন টন পরিমাণ তারের প্রয়োজন পড়ত। এই সময় দুজন আমেরিকান বিজ্ঞানী পৃথকভাবে ট্রানজিস্টরের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন যন্ত্রের মধ্যে কিভাবে তারবিহীন বিদ্যুৎ আদান-প্রদান নিয়ন্ত্রিতভাবে করা যায়। ট্রানজিস্টরের ধারণা আবিষ্কারের পর থেকে পৃথিবীর ইলেকট্রনিকস পণ্যের বিশাল পরিবর্তন হতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে ইন্টেল যে ৪০০৪ প্রসেসর এনেছিল, এতে  দুই হাজার  ২৫০টি ট্রানজিস্টর ছিল। গর্ডেন মুরে বলেছিলেন, প্রতি দুই বছরে প্রসেসরের আকার ছোট হবে আর ট্রানজিস্টর কাউন্ট দ্বিগুণ হবে। বাস্তবে গত এক দশকে এই সেক্টর এতই উন্নতি সাধন করেছে যে মাইক্রো আকার থেকে ন্যানো আকারে রূপান্তর ঘটেছে। এখন তো কত ক্ষুদ্র ও কত বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রানজিস্টর তৈরি করতে কোন দেশ বা কোন কম্পানি সক্ষম তার একটি প্রতিযোগিতা চলছে। ১০ ন্যানোমিটারের চিপ ছিল পৃথিবীর জন্য একটি বিস্ময়, আর এখন ক্রমান্বয়ে সাত, পাঁচ, তিন—এভাবে ছোট হচ্ছে। বর্তমানে মানুষ তার নিজের সক্ষমতাকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করছে। তিন ন্যানোমিটারের চিপ তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে টিএসএসনি ও স্যামসাং তাদের সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। দুই ন্যানোমিটার চিপ নিয়েও পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ; যেমন—আমেরিকা, জাপান ও চীন। তবে বাণিজ্যিকভাবে দুই ন্যানোমিটারের চিপ আসতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

একজন মানুষের চুলের ব্যাস ৯০ হাজার ন্যানোমিটার, একটি রক্তকণিকা সাত হাজার ন্যানোমিটার, একটি ভাইরাস ১৪ ন্যানোমিটার। একটি প্রমাণ সাইজের ডিএনএ ২.৫ ন্যানোমিটার। আর একটি চিপ দুই ন্যানোমিটারের চেয়েও ছোট। অর্থাৎ একেকটি চিপ কাগজের ১০ হাজার ভাগের এক ভাগ সমান পাতলা। আর এই চিপগুলো যে রুমে প্রস্তুত করা হয়, সেটি একটি অপারেশন থিয়েটারের চেয়ে ১০০ থেকে এক হাজার গুণ বেশি পরিষ্কার রাখা হয়। কারণ একটি নখের সমান চিপ মিলিয়ন ট্রানজিস্টর দিয়ে বানানো হয়। সেখানে একটি ছোট ধূলিকণাও পুরো সার্কিট নষ্ট করে দিতে পারে। চিপ তৈরির প্রক্রিয়াগুলো এতই জটিল ও সূক্ষ্ম যে এটি মাইক্রোস্কোপিক লেভেলে ঘটে। খালি চোখে দেখা যায় না। আমরা যে পাতলা চিপ দেখতে পাই তার ভেতরে সাত-আট লেভেলের ওয়্যারিং করা থাকে।

৪.

১৯৬০-এর দশকে তাইওয়ানের মানুষের জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। ১৯৭০ সালেও নিম্ন আয়ের দেশের তালিকায় তাইওয়ানের নাম ছিল একেবারে নিচের দিকে। এর পর থেকেই তাদের সরকার তার চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন শুরু করল। তারা চীনের মতো নিজেদের ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল। গুণগত মানের দিক থেকে সমস্যা না থাকলেও কূটনৈতিক কারণে তাদের উৎপাদিত টিভি, ফ্রিজ বা অন্য ইলেকট্রনিক পণ্য বহির্বিশ্বে বিক্রি করতে পারছিল না। তাইওয়ানকে এ সমস্যা থেকে বের করে আনতে এগিয়ে এলেন মরিস চ্যাং নামের এক চীনা-আমেরিকান ব্যক্তি। তিনি এমআইটির একজন গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার। তিনি আমেরিকায় বসে দেখলেন ইন্টেল, এনভিডিয়া বা কোয়ালকামের মতো কম্পানিগুলো বিভিন্ন চিপের ডিজাইন করছে এবং এর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পেছনে প্রচুর খরচ করছে। তিনি তাইওয়ানে একটি কম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। কিন্তু এর জন্য বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন ছিল। যে কম্পানি আজ ৬০০ বিলিয়ন ডলারের কম্পানি, কিন্তু সে সময় কোনো কম্পানি এতে বিনিয়োগ করতে রাজি হচ্ছিল না। শেষ অবধি ডাচ কম্পানি ফিলিপস ২৮ শতাংশ বিনিয়োগ করল, তাইওয়ান সরকার করল ২১ শতাংশ আর বাকিটা আরো কিছু ছোট বিনিয়োগকারীর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয় টিএসএমসি কম্পানি। টিএসএমসি তাইওয়ানের প্রথম কম্পানি, যারা ১৯৯৭ সালে আমেরিকার স্টক মার্কেটে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে।

৫.

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। আর তা যদি হয় কোনো উন্নত প্রযুক্তির কারখানায়, তাহলে তো আমাদের দেশের মানুষের জন্য আশীর্বাদ। নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনে যথেষ্ট আগ্রহী। নতুন ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে নতুন ধরনের কারখানা স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের ভেতরে সরাসরি বিনিয়োগের ২১ শতাংশ আসছে নেদারল্যান্ডস থেকে। আমাদের শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে সরাসরি বিনিয়োগের অধীনে নেদারল্যান্ডসের সরকার বাংলাদেশের ভেতর একটি আন্তর্জাতিক মানের সেমিকন্ডাক্টর অ্যাডভান্স হাইটেক ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করবে। আর এই ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান Brainport Eindhoven. অঝগজ এএসএমআর পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারার এবং ফিলিপস নেদারল্যান্ডসের একটি ইলেকট্রনিক কম্পানি। তারাও এ প্রজেক্টে পার্টনারশিপ রোলে থাকার কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর বাংলাদেশে তার পথচলা শুরু করেছে। তারা ভিএলএসআই ডিজাইন সেন্টার অফিস ঢাকায় স্থাপন করেছে। এ ছাড়া তারা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও চীনে তাদের মার্কেটিং ও সেলস অফিস স্থাপন করেছে। এদিকে সিলিকনভিত্তিক কম্পানি  VLKASEMI তাদের অপারেশন অফিস ঢাকা থেকে পরিচালনা করছে। তাদের কাছে ৩৫০-এর মতো দক্ষ জনশক্তি আছে। তারা বাংলাদেশের প্রথম কম্পানি, যারা সেমিকন্ডাক্টরের ডিজাইন নিয়ে কাজ করছে। নতুন করে ওয়ালটন ও এসিআই এই সেক্টরে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ওয়ালটন এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে জায়গা নিয়েছে। এ ধরনের ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক দক্ষ জনবলের প্রয়োজন আছে। দেশভেদে ১৫০ থেকে ৫০০ ডলারের এই জনবল আমাদের দেশে ১০০ ডলারে পাওয়া যেতে পারে, যা আমাদের নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

লেখক: মো. শামীম সারোয়ার – ইআরপি স্পেশালিস্ট।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ