বিশেষায়িত জ্ঞান ও গবেষণার জন্য ভেটেরিনারি ও পশুপালন/এনিম্যাল সায়েন্সের বিভিন্ন ক্ষেত্র উন্মুক্ত থাকলেও সমন্বিত কোর্সের গ্র্যাজুয়েট দিয়ে প্রাণীর সেবা ও সম্পদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হচ্ছে বহির্বিশ্বে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত একটি উত্কৃষ্ট উদাহরণ। তবে ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ সমন্বিত বা একক ডিগ্রি ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেও বাংলাদেশে এটি এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। একজন উদ্যোক্তা বা খামারির পালিত গবাদি পশু ও পাখির জন্য যেমন চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা।
ভেটেরিনারি ও পশুপালন দুটি সম্পূরক বিষয়ের আলাদা গ্র্যাজুয়েট দিয়ে একটি খামারিকে সেবা দেওয়ার পরিবর্তে শুধু একক ডিগ্রির গ্র্যাজুয়েট দিয়ে উভয় চাহিদা মেটানো সম্ভব, যেখানে সময় ও শ্রম বহুগুণে সাশ্রয় হবে এবং খামারির অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে জীবনমান উন্নত হবে এবং জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের অবদান বেড়ে যাবে।
দেশে বর্তমানে প্রাণিসম্পদে তিন ধরনের স্নাতক ডিগ্রি চালু আছে—‘ডিভিএম’ (ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন), ‘এএইচ’ (বিএসসি ইন এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি) এবং এই দুই ডিগ্রির সমন্বয়ে ‘বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি’।
বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাণিসম্পদ খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ-সবল ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে এ খাতের কোনো বিকল্প নেই।
এ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখতে বর্তমান সরকার এ সম্ভাবনাময় খাতের ওপর গুরুত্বারোপ করছে। দেশে উদ্যোক্তাদের চাহিদা, সম্ভাবনাময় প্রাণিশিল্পকে সামনে এগিয়ে নিতে এবং দেশে মানুষের আমিষের জোগান বা পুষ্টির নিশ্চয়তা দিতে দুটি ডিগ্রিকে (ডিভিএম ও এএইচ) এক করে স্বয়ংসম্পূর্ণ জ্ঞানসমৃদ্ধ গ্র্যাজুয়েট তৈরির প্রয়োজনীয়তা বহুদিন থেকেই অনুভূত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এই দুই ডিগ্রি একীভূত করতে পরিপত্র জারি করে। পরবর্তী সময়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় অনুমোদিত অর্গানোগ্রামে শুধু ডিভিএম ও এএইচ ডিগ্রিধারীদের জন্য আলাদা মেকআপ কোর্স প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
ডিগ্রির নামে ভিন্নতা থাকলেও ডিভিএম ডিগ্রিপ্রাপ্ত গ্র্যাজুয়েটরা ‘ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি’ ডিগ্রিধারীদের মতোই ভেটেরিনারি সায়েন্সের কোর্সের সঙ্গে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ প্রডাকশন কোর্স সম্পন্ন করেন। তাই প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত পদগুলোতে ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি ডিগ্রিধারীদের মতো ডিভিএম ডিগ্রিধারীরাও আবেদনের সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। শুধু নামের ভিন্নতার জন্য একই যোগ্যতাসম্পন্ন (ডিভিএম) গ্র্যাজুয়েটরা এসব চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। বলা বাহুল্য, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের NATP এবং LDDP প্রকল্প দুটিতে ডিভিএম ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েটরা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা পদে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া যেখানে দেশে প্রাণিসম্পদের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে ডিভিএম ডিগ্রির পাশাপাশি বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি ডিগ্রি যৌক্তিক হিসেবে চাওয়া হয়, সেখানে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত পদগুলোতে কেন ডিভিএম ডিগ্রি চাওয়া হয়নি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু ডিগ্রির নামের পার্থক্যের কারণে এই সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও গ্র্যাজুয়েট এসব চাকরিতে আবেদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন, তা তাঁদের শিক্ষক ও অভিভাবকরা মেনে নিতে পারছেন না।
তাই ডিভিএম ডিগ্রি প্রদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে আন্দোলন শুরু করেছে। শিক্ষকরা প্রেস কনফারেন্সসহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। এএইচ ডিগ্রি প্রদানকারী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ের পশুপালন অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাঁদের মতামত তুলে ধরে প্রেস কনফারেন্স করতেও দেখা গেছে। তবে এই ভেটেরিনারি ও পশুপালন নামের দুই সম্পূরক পেশার পাল্টাপাল্টি অবস্থান নতুন নয়, দীর্ঘদিনের। এর ফলে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ডিগ্রি শিক্ষার্থীদের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। তাই কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রথমত অবিলম্বে ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি ডিগ্রির সঙ্গে ডিভিএম ডিগ্রি সংযোজনের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপনটি দ্রুত সংশোধনের দাবি ভুক্তভোগীদের। অন্যথায় এরই মধ্যে ডিভিএম ডিগ্রি গ্রহণকারী যেসব চাকরিপ্রত্যাশী গ্র্যাজুয়েট রয়েছেন এবং যেসব অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী রয়েছেন তাঁরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অধিকন্তু জনগণের করের টাকায় উচ্চমূল্যে তৈরি এসব শিক্ষার্থী ও গ্র্যাজুয়েটকে প্রাণিসম্পদে সেবা প্রদান থেকে বঞ্চিত করা হবে। পাশাপাশি বিষয়টির স্থায়ী সমাধানের জন্য দেশে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের চাহিদার ভিত্তিতে এবং পেশাগত বৈষম্য দূর করতে যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে এখনো ডিভিএম অথবা এএইচ ডিগ্রি আলাদাভাবে প্রদান করা হচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে ‘বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি’ নামের একক ডিগ্রি চালুর ব্যবস্থা করা জরুরি।
‘বিএসসি ইন ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি’ ডিগ্রি চালু হলে এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বত্র এই একক ডিগ্রির পাশাপাশি বিশেষায়িত উচ্চতর ডিগ্রিসহ (মাস্টার্স/পিএইচডি) বিভিন্ন বিশেষায়িত পদগুলোতে নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব হলে প্রাণিসম্পদের টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
প্রাণিজ শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন নিয়োগের ক্ষেত্রে সমন্বিত গ্র্যাজুয়েটদের প্রাধান্য দিচ্ছে। এই শিল্পের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি গ্র্যাজুয়েট সমন্বিত ডিগ্রিধারী। তাই সরকার ও প্রাণিসম্পদের স্টেকহোল্ডার এবং মাঠ পর্যায়ে কৃষক ও খামারিদের চাহিদা অনুযায়ী সমন্বিত ডিগ্রি বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
লেখক: ড. মো. সহিদুজ্জামান – অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।