1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ে কিছু মৌলিক তথ্য এবং বাস্তবতা

অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. আরাফাত, : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০২২

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে অনেকেই না জেনে অসত্য অথবা অবাস্তব কথা বলছে, আবার অনেকেই রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যে সত্যের সাথে মিথ্যা মিশ্রিত করছে। এ বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে রাখুন-

(১) বিএনপি আমলের শেষের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট এবং উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট। তারা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারেনি।

(২) জ্বালানি নিয়ে বৈশ্বিক কোনও সংকট ছিল না। দেশের উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় চাহিদা দ্বিগুণ থাকায় দিনের অর্ধেক সময়ই লোডশেডিং হতো।

(৩) অন্যদিকে, বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট এবং এখন আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা ২১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। Captive Power হিসাব করলে আরও যোগ হবে ৩৫০০ মেগাওয়াট।

(৪) অর্থাৎ, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট বেশি। যে কারণে লোডশেডিং কী, সেটা আমরা ভুলতেই বসেছিলাম।

(৫) কিন্তু, করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং তার ওপর দিয়ে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তীব্র জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে এবং জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। যে কারণে এখন আমাদের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি থাকার পরও, জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং আমরা আবারও কিছুটা লোডশেডিংয়ের মধ্যে পড়েছি।

করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ২০২০ সালের জুনে, এলএনজি স্পট মূল্য ২.০২ মার্কিন ডলারে নেমে গিয়েছিল এবং ২০ এপ্রিল, ২০২০-এ তেলের দাম নেতিবাচক মূল্যে পৌঁছেছিল। ফলে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সরবরাহ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বড় বড় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ২০২১ সালের প্রথম দিকে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হতে শুরু করে এবং জ্বালানির দাম আবার আগের জায়গায় ফিরে আসতে থাকে। এই অর্থনৈতিক প্রত্যাবর্তনটা ছিল আচমকা। যে কারণে, জ্বালানি খাতে সরবরাহ কার্যক্রমের বেশিরভাগই পুনরায় আগের মতো চালু করতে পারেনি, ফলে চাহিদা (Pent-up demand) মেটাতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয় চাহিদা এবং জোগানের মধ্যে বিশাল ফারাক। গ্যাস সেক্টর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ২০২১ সালের অক্টোবরে সরবরাহ ঘাটতির তীব্রতার কারণে এশিয়ান স্পট এলএনজির মূল্য ৩৫ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল। গ্যাসের উচ্চমূল্য অন্যান্য জ্বালানির ওপরও প্রভাব ফেলেছিলো।

একই সময় থার্মাল কয়লার মূল্য পাঁচগুণ বৃদ্ধি হয়ে ২৬৬ মার্কিন ডলার হয়েছিল। শোধনাগারের সীমাবদ্ধতার কারণে পেট্রোল, ডিজেলের দাম বাড়তেই থাকে। এই সংকটের মধ্যেই ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এ রাশিয়া থেকে ইউক্রেন আক্রমণ শুরু হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি এশিয়ান এলএনজি স্পট মূল্য ছিল ২২ মার্কিন ডলার, আগের পাঁচ বছরের তুলনায় অনেক বাড়তি মূল্য। রাশিয়ান সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় ২০২২ সালের মার্চ মাসে এলএনজি (গ্যাস) স্পট মূল্য দাড়ায় ৭০ মার্কিন ডলার। বর্তমানে, গ্যাস স্পট মূল্য ৪০ মার্কিন ডলার, কয়লা প্রায় ১৬০ মার্কিন ডলার/টন।

দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানির নজিরবিহীন উচ্চমূল্য এবং সরবরাহ ঘাটতি সমগ্র অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে উন্নত, উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশগুলো। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রেকর্ড পরিমাণ মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হচ্ছে। খাদ্য সরবরাহ, শিপিং স্পেস/কন্টেইনারের ঘাটতি এবং জ্বালানির দামসহ অন্যান্য সরবরাহ চেইন সমস্যার কারণে অনেক দেশই মন্দার সম্মুখীন হচ্ছে। রাশিয়া ইউরোপে ৪০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে। বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের ১২ শতাংশও সরবরাহ করে এবং এর অর্ধেক যায় ইউরোপে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞাগুলোর কারণে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশে সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে ইউরোপে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ডস এবং অন্যান্য দেশ দরিদ্র পরিবারগুলোকে সরাসরি ভর্তুকি দিচ্ছে।

ইউরোপের গ্যাসের উচ্চমূল্য সারা বিশ্বে গ্যাসের দাম নির্ধারণে প্রভাব ফেলছে। এমনকি আমেরিকার আভ্যন্তরীণ গ্যাসের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে যা বাইরের সাপ্লাই চেইনের সাথে যুক্ত নয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে আমদানিনির্ভর উন্নয়নশীল দেশগুলো। ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০২২ সালের প্রথমার্ধে চীন ও ভারত তাদের এলএনজি আমদানি যথাক্রমে ২০ শতাংশ এবং ১৪ শতাংশ কমিয়েছে। চীনের বেশ কয়েকটি প্রদেশ ও শহর বিদ্যুৎ ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। ভারতে ব্যাপকভাবে বিদ্যুৎ এবং কয়লা সংকট দেখা দিয়েছে, যার কারণে ২০১৫ সালের পর এই প্রথম তারা কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাকিস্তান তাদের কর্মদিবস কমিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন করেছে এবং বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমিত করছে। বর্তমানে তারা চাহিদার তুলনায় ৫ হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি জ্বালানি আমদানির বোঝা তাদের ক্রম হ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

শ্রীলঙ্কা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৬০ শতাংশ আমদানি করা জ্বালানির (তেল/কয়লা) ওপর নির্ভর করে। বিশৃঙ্খল অর্থনীতি এবং প্রায় শূন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশটিকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলেছে। এমনকি উন্নত এশিয়া ও ওশেনিয়া দেশগুলোও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মূল্য সমন্বয় ছাড়াও, সরবরাহ নিশ্চিত করতে সিঙ্গাপুর এলএনজি স্টোরেজের জন্য ভাসমান জাহাজ স্থাপন করছে। চাহিদা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে জাপান তাদের নাগরিকদের এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার না করতে অনুরোধ জানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার জ্বালানিমন্ত্রী নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের বাসিন্দাদের সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। কিছু তেল/কয়লা/গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ ছাড়াও, প্রায় প্রতিটি দেশই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

(৬) অনেকে না জেনেই বলেন, আমরা গ্যাস উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করিনি বলেই এই সমস্যা হচ্ছে। একদম অসত্য কথা। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে এসে আমাদের মোট গ্যাস উৎপাদন দাঁড়ায় ১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাস উৎপাদন বাড়িয়েছে আরও ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট। মোট গ্যাস উৎপাদন দাঁড়ায় ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এখানেও আওয়ামী লীগ সরকার সফল। তবে, আগের ১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস থেকে সময়ের কারণে গ্যাস উৎপাদন কমতে থাকে এবং মোট গ্যাস উৎপাদন দাঁড়ায় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটে।

(৭) অনেকে প্রশ্ন করে, আমরা আরও নিবিড়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধান করলাম না কেন? উত্তর হচ্ছে, গ্যাস অনুসন্ধান ব্যয় সাপেক্ষ এবং ঝুঁকি অনেক বেশি। এমনও হতে পারে, প্রচুর সময় এবং অর্থ ব্যয় করে হয়তো কিছুই পাওয়া গেলো না। এদিকে এলএনজি অবকাঠামো তৈরি করে প্রস্তুতি না নিলেও আমরা বিপদে পড়তাম, তখনও আবার অনেকেই বলতো জ্বালানি নীতি ঠিক হয়নি। বাংলাদেশ যেকোনও পরিস্থিতিতে পুরোপুরি উল্টো বা বিপরীতমুখী কথা বলার লোক অনেক আছে। এরা অবস্থা বুঝে কথা বলে। যারা আজকে আমদানি নির্ভরশীলতার ওপর দোষ চাপাচ্ছেন, তারাই একসময় গ্যাস রফতানি করার পরামর্শ দিয়েছিল। বাংলাদেশে অনেক গ্যাস আছে এবং অনুসন্ধান করলেই গ্যাস পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। কাজেই আমাদের আমদানি নির্ভরশীলতা থাকবেই। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই আমদানি নির্ভর।

(৮) বিএনপির দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে নাইকো পরিচালিত বাংলাদেশে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে আগুন ধরে যায়। যার কারণে বিশাল রিজার্ভ থাকার পরেও সেই গ্যাস ক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। সেখানে আমাদের কয়েক বিলিয়ন ডলারের গ্যাস হারাই। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নাইকো দুর্নীতি মামলার রায় বাংলাদেশের পক্ষে আসে এবং সেখানে দুর্নীতি হয়েছে সেটাও কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। (লিঙ্ক: https://cutt.ly/dLikL1e) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিএনপির সময়ে এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল যে, স্বয়ং বিএনপির সরকারের সময়ই খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার জ্বালানিমন্ত্রী মোশাররফ হাতেনাতে দুর্নীতি করে ধরা পড়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

(৯) বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিষয়গুলো মাথায় রেখে মাটির নিচের কয়লা উত্তোলন করেনি। কিন্তু, আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন কি তারা তাদের ভুল স্বীকার করবে যারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিত করেছিল? কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো না থাকলে আমরা আজকে আরও বিপদে পড়তাম।

(১০) একই কারণে আমাদের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট করা দরকার, তা যতই ব্যয়বহুল হোক না কেন। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় নেই। জ্বালানি বহুমুখীকরণের কোনও বিকল্প নেই। অথচ, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের বিরুদ্ধেও কতো অপপ্রচার করে একটা গোষ্ঠী।

(১১) বাংলাদেশের বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকিতে। আন্তর্জাতিক বাজার হতে জ্বালানি কিনলেও সেই দামে দেশের গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে না সরকার। কারণ, তাতে সাধারণ মানুষের ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে এবং অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার প্রবণতাও বাড়বে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৫৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দেয় সরকার। ভর্তুকি না দিলে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কত হতে পারে ভাবুন!

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বৈশ্বিক সংকট, মহামারি, মন্দা সত্ত্বেও এই সরকার কখনও তার মূল আদর্শ থেকে একচুলও নড়েনি। শেখ হাসিনা শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর পাশে থাকা, তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : মোহাম্মদ এ. আরাফাত – অধ্যাপক; চেয়ারম্যান, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ