1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

সংবিধান কাটাছেঁড়া গণতন্ত্র-সুশাসনের অন্তরায়

অধ্যাপক ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ২ জুলাই, ২০২৩

গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা অহরহই আমরা শুনি। বিদেশিরাও আমাদের সবক দিতে কার্পণ্য করে না। দেশেও অনেকেই গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা বলছেন। কিন্তু তাঁদের উপদেশ, ফরমাশ আর সবক দেওয়ার দৃশ্য দেখে মনে হয়, আহা এই মানুষগুলোই যদি ক্ষমতায় যেতেন, তাহলে বোধ হয় আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতো।

কিন্তু একটু পেছনের দিকে তাকালেই দেখি তাঁরা কিংবা তাঁদের দল তো দীর্ঘ দিন দেশ শাসন করেছিল, ‘বহুদলীয়’ গণতন্ত্রের এক আনন্দদায়ক গান চিরকাল শুনিয়েছে, এখনো শোনাচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসন তখন কতটা ছিল সেই দৃশ্য দেখতে হাবলের টেলিস্কোপ এনে বোধ হয় চেষ্টা করা যেতে পারে। এখন তাঁদেরই উত্তরসূরিরা দেশ থেকে তাঁদের ভাষায় ‘হারিয়ে যাওয়া’ গণতন্ত্র ও সুশাসন দেওয়ার জন্যই এত ‘ত্যাগ’ ও ‘আন্দোলন’ করে যাচ্ছেন!

এসব শুনতে শুনতে তো অনেকের বয়স ৫০ পার হয়ে গেছে। কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসন তাঁদের দাবি মোতাবেক দেশে আসেনি।

যদিও তাঁদের কথা শুনলে মনে হবে, গণতন্ত্র ও সুশাসন বোধ হয় দেশে রাতারাতি এসে যাবে। আজকাল আবার এমন ধারণাও দেওয়া হচ্ছে যে দেশে কোনো সংবিধানের প্রয়োজন নেই, সাংবিধানিক ধারায়ও দেশ পরিচালনার কোনো প্রয়োজন নেই, রাজনৈতিক দলগুলোরও সংবিধান চর্চা করার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রকে আসলে আমাদের কিছু নেতা বর্গীর ভয় দেখানোর ছড়া কাটার বিষয় বলে মনে করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে রাজনীতিতে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা যাঁরা অনুভব না করে যখন-তখন ইচ্ছামতো সংবিধানের ওপর ছুরি চালিয়ে কাটাছেঁড়া কিংবা কাটছাঁট করে নিজেদের সুবিধামতো ক্ষমতা দখল কিংবা অবস্থানকে জায়েজ করার ধারাবাহিক চিন্তা পোষণ করেন, তাঁরা সেটিরই পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চান।

সংবিধান কাটাছেঁড়া করে গণতন্ত্র ও সুশাসন হয় না ১৯৭২-এর সংবিধান আমাদের রক্তস্নাত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ফসল। এই সংবিধানে প্রতিটি ধারা বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিণত করার যেসব আইন ও বিধি-বিধানের ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে, সেটি অনুসরণ করা হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে কারো হাহাকার করার প্রয়োজন এত দিন পড়ত না। দেশের সংসদকে উপেক্ষা করে যাঁরা রাষ্ট্রের চার মৌলনীতির ওপর ছুরি চালিয়েছিলেন, তাঁরা তখন কী বলেছিলেন, কী চেয়েছিলেন? সংবিধানে বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগানোর মাধ্যমে আসলে তাঁরা চেয়েছিলেন নিজেদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাংলাদেশকে বাহাত্তরের সংবিধান থেকে সরিয়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নিতে। তখন তো ছেলে ঘুমানোর ছড়াই কাটা হয়েছিল। কিন্তু ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছিল ঠিকই, দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বর্গীরা এসে সব কিছুতেই আস্তানা গেড়ে বসেছিল।

বর্গীদের তারাই আনল। দেশে একের পর এক সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে কোন গণতন্ত্র ও সুশাসন আমাদের উপহার দিয়েছিলেন, আমরা কি তা একেবারেই ঘুমিয়ে থেকে ভুলে যাব? দ্বিতীয় সামরিক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম এনে দ্বিতীয়বার সবাইকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। সংবিধানের এই কাটছাঁট ও কাটাছেঁড়া দেশকে কোথায় নিয়ে গেছে সেটি একবারও রাজনৈতিক দলগুলো ভাববে না? সুধী ও নাগরিক সমাজও কি এর রহস্য উদঘাটন করবে না?

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিন জোটের রূপরেখা প্রণীত হয়েছিল। সংবিধানকে স্থগিত নয়, বাতিলও নয়, এমন অবস্থানে রেখে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে এনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হলো। সেই নির্বাচন নিয়েই আমরা খুশিতে গদগদ। কিন্তু রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে গণতন্ত্রের লেবাস পরিয়ে দেওয়ার যে নীলনকশা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। সেটি ছিল মূলতই ১৯৭৫-উত্তরকালে সংবিধান কাটাছেঁড়া করারই হাতে পাওয়া ফল। এরপর সংবিধানে একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী এনে রাজনীতিবিদদের ইচ্ছা পূরণ করা হলো। সংবিধান আগে নয়, পরেই থেকে গেল। আবারও কয়েকবার সংবিধানকে উপেক্ষা, কাটাছেঁড়া এবং এর আইনকানুন অনুসরণ না করার প্রবণতা আরো বেশি যেন দৃশ্যমান হলো। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনির্বাচিত কয়েকজনকে দিয়ে অন্তর্বতী সরকার গঠনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত করা হলো। কিন্তু নির্বাচিত সরকারের শাসনামলের শুরু থেকে শেষাবধি উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইত্যাদিতে সেই আগেরই জোরজবরদস্তির ব্যবস্থা বহাল ছিল। রাষ্ট্র ও সরকারের কাজে সংবিধান অনুসরণ করা হলো না।

এরপর আস্থাহীনতার জায়গা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন ধারণার জন্ম দেওয়া হলো। কিন্তু রাজনৈতিক কোনো পক্ষই সংবিধানে নির্বাচনী আইনি ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতাকে বিবেচনায় নেয়নি। তাৎক্ষণিক এবং জনতুষ্টিমূলক ভাবনা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা সংবিধানে কৃত্রিমভাবে জড়িয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু এটি যে সংবিধানের মূল চেতনা ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সেটি গভীরভাবে ভাবা হলো না। ব্যথার চিকিৎসা ও ডাক্তারি পরামর্শ অনুসরণ না করে আমরা সংবিধানের ওপর মলমের প্রলেপ লাগিয়ে নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে চেয়েছিলাম। প্রথম দিকে কিছুটা সুফল দিলেও শুরুতেই রাষ্ট্র বিপর্যয়ে ঘটনা সৃষ্টি হওয়ার পরও আমাদের বোধোদয় হয়নি। এরপর তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা প্রথমে রিমোট কন্ট্রোলে চলে গেলে, পরে এটি ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারই হয়ে গেল। এর পরিণতি আমাদের ভোগ করতে হয়েছে দুই বছর।

এরপর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানকেই রাষ্ট্র ও রাজনীতির অলঙ্ঘনীয় দলিল হিসেবে অভিহিত করে রায় প্রদান করেন। কিন্তু কে কার কথা শোনে? রাজনীতি চলছে সাম্প্রদায়িকতা, অবৈধ অর্থবিত্ত, জোরজবরদস্তি এবং বৃহত্তর জনগণকে নানা অপপ্রচার আর গুজব ছড়িয়ে যে যার মতো সুবিধা আদায়ে একেকটি তথাকথিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এখনো বলা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে চলবে না। বিদেশিরা কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথাই বলেননি। তাঁরা সংবিধান কী তা ভালো করেই বোঝেন। সুতরাং সেখানে তাঁদের কোনো বক্তব্য নেই। তাতে কী হলো, আমরা তো বারবারই সংবিধান ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করেছি। কিন্তু ফল যেই লাউ, সেই কদুই রয়ে গেছে।

বাহাত্তরের সংবিধান অনুসরণের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিকে বহুদলীয় ব্যবস্থায় বিকশিত করার চেষ্টা করা হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ধীরে ধীরে যে সাফল্য বয়ে আনত তার সঙ্গে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠারও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু গণতন্ত্রের পথে তো সবাই হাঁটে না, সবাই তো গণতন্ত্রে বিশ্বাসও করে না, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতে হলে এর মৌলনীতিকে রাজনীতিতে আত্মস্থ করার কোনো বিকল্প নেই। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছাড়া কোনো রাজনীতিই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে আমরা কাটছাঁট করে যেনতেন উপায়ে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনের মধ্যে বাক্সবন্দি করে ফেলেছি। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি মাত্র অনুষঙ্গ। কিন্তু গণতন্ত্রের আরো অনেক বড় বড় বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানের মৌল চেতনার মধ্যেই রয়েছে।

সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দিয়ে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ হয় না। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাও প্রতিষ্ঠা করা সাম্প্রদায়িক এবং উগ্র হঠকারী গোষ্ঠীর দ্বারা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। পাকিস্তান এর জ্বলন্ত উদাহরণ। আমরা সেই অগ্নিদগ্ধ অবস্থা থেকে ১৯৭১ সালে বের হয়ে আসার পরও আমাদের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের মিত্ররা ডালপালা গজিয়ে এখন বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। এটি হচ্ছে পঁচাত্তরের পর সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করার কুফল। আমাদের এখনো যদি বোধোদয় না হয়, সংবিধানে মূল আইন ও চেতনায় ফিরে যাওয়া, এর যথার্থ চর্চায় রাজনীতিকে বিকশিত করা না হয়, তাহলে গণতন্ত্র ও সুশাসন কেবলই কারো কারো ঘুমপাড়ানি ছড়ার মতোই বারবার শুনতে হবে।

রাজনীতিকে সংবিধানের মূল আদর্শে পরিচালিত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, দলের ভেতরে ও বাইরে গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শকে ধারণ ও চর্চার কোনো বিকল্প নেই। উন্নত দুনিয়ার কিছু রাষ্ট্র গণতন্ত্র ও সুশাসনে নজির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তারাও এখনো বলতে পারে না যে তাদের অভিযাত্রা শেষ হয়ে গেছে। গণতন্ত্র ও সুশাসন এক দীর্ঘ পথপরিক্রমার বিষয়, সে জন্য সংবিধান এই দীর্ঘ পথপরিক্রমাকে লক্ষ্য ও গতিচ্যুত না করার জন্যই সবাই গ্রহণ করে থাকে। সংবিধানে অবশ্যই যুগের চাহিদামতো আইন ও বিধি-বিধান সংযোজিত হয়। এই সংযোজন কোনোভাবেই কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। সুতরাং আমাদের সংবিধানেই নির্বাচন, গণতন্ত্র ও সুশাসনের যেসব পথ বাতলিয়ে দেওয়া আছে, সেগুলোর যথার্থ চর্চা ও প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা গণতন্ত্রের চিরায়ত পথে চলার জন্য পা ফেলতে পারি। এত দিন আমাদের কাটাছেঁড়া করার কুফল আমরা দেখেছি। এবার মূলের চর্চায় মনোনিবেশ করাই যথার্থ হবে।

লেখক : ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী – ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ