1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

গ্লোবাল ভ্যালু চেইন এবং আমাদের শিল্পায়নের সম্ভাবনা

সৈকত ইসলাম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই, ২০২৩

শিল্পায়ন অর্জনের অভিন্ন কোনো শিল্পনীতি নেই। এটি আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্য এবং নির্দিষ্ট প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে দেশভেদে বদলাতে পারে। তবে স্বল্পোন্নত দেশে একটি ম্যানুফ্যাকচারিং খাত গড়ে তুলতে রপ্তানি বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রপ্তানির মাধ্যমেই এসব দেশ পণ্যের বাজার প্রসারিত করে শিল্পায়নকে টেকসই করতে পারে।

বিংশ শতকের শেষ ভাগে বিশ্বব্যাপী সমন্বিত উৎপাদনব্যবস্থা বা গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের (GVC) মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতের ব্যবস্থা চালু হয়। এ ব্যবস্থায় উন্নত দেশগুলো পণ্য উৎপাদনের জন্য সাবকন্ট্রাক্টিং এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে। এ দেশগুলো তাদের তুলনামূলক কম মূল্যের শ্রম ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে আর উন্নত দেশগুলো পণ্যের ডিজাইন ও তৈরি পণ্যের বিপণনের কাজ করে থাকে।

এ ব্যবস্থা স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্পায়ন বিকাশের জন্য একটি সুযোগ করে দেয়।

কারণ এতে শিল্পায়নের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর উৎপাদনব্যবস্থার সম্পূর্ণ অংশের বিকাশের প্রয়োজন নেই। তারা তাদের তুলনামূলক সুবিধাগুলো ব্যবহার করে কোনো একটি পণ্যের নির্দিষ্ট অংশের উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিতে পারে এবং একই সঙ্গে এই ব্যবস্থায় পণ্য রপ্তানির সুযোগও তৈরি করে। কেননা উন্নত দেশগুলো সাবকন্ট্রাক্টিং ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এই উৎপাদিত পণ্যগুলো সংগ্রহ করে তাদের বাজারেই বিপণন করে।

স্বল্পোন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (যেগুলো শিল্প খাতে আপডেট প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করে) শিল্প খাতের সঙ্গে তাদের সংযোগ প্রায় অনুপস্থিত।

তাই উন্নত রাষ্ট্র থেকে প্রযুক্তি ও জ্ঞান স্থানান্তর তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে উন্নত করার জন্য প্রাথমিক উপায়।

GVC স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে নির্দিষ্ট ম্যানুফ্যাকচারিং সুবিধা তৈরি করতে, নতুন প্রযুক্তি  শিখতে, সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারের পণ্যের মানের চাহিদা সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করে তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাত বিকাশে সহায়তা করেছিল। স্থানীয় ছোট ও মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানগুলোও এই  GVC সমন্বিত বড় সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে উপকৃত হয়। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে সার্বিকভাবে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ শিল্প খাত উন্নত এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের সুযোগ পায়।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে শিল্পায়ন বিকাশের একটি বড় সম্ভাবনা ছিল। দীর্ঘকাল ধরেই তৈরি পোশাক বা আরএমজি পণ্য বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টর প্রধানত অভ্যন্তরীণ বাজারে পরিচালিত হয়েছিল। প্রথম উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক সংযোগ ছিল বাংলাদেশের দেশ গার্মেন্টস দ্বারা ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ডেইউ করপোরেশনের সঙ্গে একটি যৌথ উদ্যোগ।

গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে GVC-এর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধির পর দেশীয় তৈরি পোশাকের প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে তাদের পণ্যের লাইনগুলোকে সস্তা পণ্য থেকে ব্যয়বহুল আইটেমে রূপান্তরিত করে এবং ছোট থেকে বড় চালান, এমনকি তাদের উৎপাদনব্যবস্থায়ও ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এই সময় থেকেই আরএমজি সেক্টর থেকে রপ্তানি আয় দেশের মোট রপ্তানির প্রধান অংশে পরিণত হয়। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ অংশে  GAP, JC Penny I Walmart-এর মতো বিখ্যাত আন্তর্জাতিক পোশাক ক্রেতা বা ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে তাঁদের পণ্য আউটসোর্স করতে শুরু করেন। এই শতকের শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি গার্মেন্ট পণ্যের বাজার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। মাল্টি-ফাইবার চুক্তির (উন্নয়নশীল দেশ থেকে গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি কোটা) সুবিধা শেষ হওয়ার পর বিশ্ব পোশাক বাজার প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে এই খাতের রপ্তানি বাড়তে থাকে উল্লেখযোগ্য হারে। এই শতকের প্রথম দশকের শেষের দিক থেকেই উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আরএমজি পণ্যের সরবরাহ বাড়ে। এই সময়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প গড়ে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছিল।

এই সাফল্যের পেছনে GVC নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা স্থানান্তরিত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সরকার প্রদত্ত নীতিগত সুবিধা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। পণ্য প্রক্রিয়া ও উৎপাদনব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রযুক্তিগত জ্ঞান হস্তান্তর হওয়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদনব্যবস্থাকে উন্নত করতে সক্ষম হয়। ফলে তৈরি পোশাক খাতের পণ্যগুলোকে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে এবং রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে। তা ছাড়া বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে প্রবেশের পর আরএমজি উদ্যোক্তারা ঠেঈ দ্বারা প্রদত্ত বৈশ্বিক বাজার সুযোগগুলোকে পুঁজি করে নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তনের মাধ্যমে উৎপাদনব্যবস্থাকে আরো ভালোভাবে সংগঠিত করার পাশাপাশি কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও সক্ষম হয়। বিপুলসংখ্যক দেশীয় আরএমজি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে GVC-তে সংযুক্ত  হওয়ায় আরএমজি সেক্টরে  দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাও বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশের আরএমজি পণ্যের রপ্তানি বাজারে প্রবেশাধিকার এবং উৎপাদন বৃদ্ধি এই খাতের অন্যান্য শিল্প খাতের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে অন্যান্য শিল্পের ওপর প্রভাব ফেলার সুযোগ ছিল, যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশ হতে পারত। গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের সঙ্গে একটি শিল্পের সংযোগ সাধনের মাধ্যমে সে শিল্পের দক্ষতা বৃদ্ধি ও রপ্তানি বাজার তৈরি করে সে পুঁজি ও দক্ষতা অন্য শিল্প গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা যেত। এ সম্ভাবনার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টরে পুরো মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। কিন্তু গত আড়াই দশকের এই সাফল্যের পরও বাংলাদেশে আরএমজি সেক্টরের সাফল্যের প্রভাবে অন্য কোনো উল্লেখযোগ্য রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে ওঠেনি। আজও বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ম্যানুফ্যাকচারিং অংশের মোট ৮৬.৪১ শতাংশ এবং উৎপাদন খাতে নিয়োজিত শ্রমের অর্ধেক হলো আরএমজি খাতের।

অর্থাৎ গত আড়াই দশকে আরএমজি সেক্টর GVC-এর সঙ্গে সংযোগের ফলে যে প্রযুক্তি, বিশ্ববাজারের চাহিদা সম্পর্কিত জ্ঞান ও পুঁজি গড়ে তুলতে পেরেছিল তা অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়নি। গার্মেন্ট সেক্টরের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের পরও এখনো এই খাতের কাঁচামাল বা মেশিনারি আমদানি করতে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সংখ্যার হিসেবে তা প্রায় সব সময়ই এই খাতের মোট রপ্তানি আয়ের ৩৫ শতাংশের ওপরে থাকে। তাই বলা যেতে পারে, গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের সঙ্গে সংযোগের ফলে শিল্পায়ন বিকাশের যে ধারণা তা বাংলাদেশে সেভাবে কার্যকর হয়নি। হতে পারে বাংলাদেশের আরএমজি খাত যেহেতু শ্রমনিবিড় শিল্প এবং এখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের হার অন্য অনেক শিল্পের তুলনায় কম। তাই এর মাধ্যমে দেশের অন্যান্য শিল্পে প্রযুক্তি বা পুঁজি স্থানান্তর সেভাবে হয়নি।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে শিল্পনীতির ক্ষেত্রে বাণিজ্য ও রপ্তানি বৃদ্ধি সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। এখানে করপোরেট ট্যাক্স হ্রাস, আমদানি শুল্ক ছাড়, বিনা মূল্যের ওয়্যারহাউস সুবিধা, ব্যাক-টু-ব্যাক লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) স্কিমসহ রপ্তানিবান্ধব নীতিগুলো প্রধানত আরএমজি খাতের দিকে লক্ষ করে নেওয়া হয়ে থাকে। আরএমজি খাতে আসা প্রযুক্তি, বিশ্ববাজারের চাহিদা সম্পর্কিত জ্ঞান ও পুঁজি যেহেতু অন্য উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি, তাই শিল্পনীতির আওতায় দেওয়া সুবিধাগুলোকে দেশীয় বাজারভিত্তিক শিল্প এবং অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশে অধিক সহায়ক করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিনিয়োগ ও মুদ্রানীতিকে কৌশলগতভাবে আরএমজি সেক্টরের সঙ্গে সঙ্গে অন্য শিল্পগুলোতেও সুসংহতভাবে যুক্ত করা উচিত, যাতে তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্পের অধিক বিকাশ ঘটতে পারে।

লেখক: সৈকত ইসলাম – প্রাবন্ধিক।   

সুত্র: কালের কন্ঠ 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ