1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

জেদ করে পেঁয়াজ বীজ বপন, ৬ মাসে ৩ কোটি টাকা লাভ!

নিজস্ব প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২

যেন একজন পুরোদস্তুর কৃষক সাহিদা বেগম। অনেকে অবশ্য বলেন সফল কৃষক। ফরিদপুর কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনকারী কৃষকদের তালিকায় তাঁর নামটা জ্বলজ্বল করছে। এই যেমন চলতি বছরের কথাই ধরা যাক। এ বছর তিনি পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করেছেন ৪ কোটি টাকার। উৎপাদন খরচ বাদ দিলে সাহিদার আয় হয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা।

কোটিপতি চাষি সাহিদা বেগমকে জিজ্ঞেস করি, কৃষিকাজে আগ্রহী হলেন কী করে? হাসিমাখা মুখে তিনি বলেন, ‘কৃষিতে আসা আসলে জিদ করে, কৃষিকাজ এত পরিশ্রম আর ধৈর্যের কাজ যে শুরুতে ভালো লাগত না। এরপরেও নিজের জিদকেই সবার উপরে রাখতাম। কিন্তু একটা সময় পেঁয়াজের বীজ নিতে আসা ক্রেতাদের উৎসাহ আর আগ্রহ সে কষ্ট আর কষ্টই মনে হয় না। আয়ও বাড়তে থাকল। উৎসাহও বাড়ল।’

সাহিদা বেগমের (৪৩) দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটায়। ঘুম থেকে ওঠেন। পরিবারের সদস্যসহ কৃষি শ্রমিকদের জন্য নিজেই রান্না করেন। সকালে খাবারটুকু খেয়ে চলে যান মাঠে। জমির কাজ তদারক করেন। মাঠেই বিকেল গড়ায়। কোনো এক ফাঁকে হয়তো বাসায় ফেরেন, কাজের চাপ থাকলে শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠেই বসে যান থালা হাতে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য।

কৃষির প্রতি অনুরাগ

সাহিদা বেগমের বাড়ি ফরিদপুর পৌরসভার গোবিন্দপুর গ্রামে। স্বামী মো. বক্তার হোসেন খান একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের কর্মকর্তা। এই দম্পতির দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মেরিনা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর পর। ছোট মেয়ে মার্জিয়া আক্তার পড়ছে নবম শ্রেণিতে।

স্ত্রী সাহিদার উদ্যোগে সব সময় পাশে থাকেন স্বামী বক্তার। তাই তো বক্তার হোসেন খান বলছিলেন, ‘আমি তো ৯টা-৫টা অফিসেই কাটাই। পরিবারসহ মাঠের সব কাজ সাহিদাই সামলায়। তবে সুযোগ পেলেই তার কাজে সহযোগিতা করি।’

বক্তার হোসেন কৃষক পরিবারের সন্তান। ১৯৮৭ সালে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসেই গৃহস্থালির কাজে হাতেখড়ি সাহিদার। ধানমাড়াই থেকে ঢেঁকিতে চাল ছাঁটা—সবই করতে হতো। সাহিদা জানালেন, প্রথমে কষ্ট ও বিরক্তি লাগত। তবে শাশুড়ি জোহরা বেগমকে নিরন্তর গৃহস্থালির কাজ দেখে সাহিদাও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। একসময় কৃষিকাজের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ জন্মায়। কৃষক পরিবারটি একসময় ধান, পাট, গম, ছোলা, প্রভৃতি শস্যই চাষাবাদ করত। ২০০৪ সাল থেকে শুরু করে পেঁয়াজের বীজ চাষ।

সাহিদা বেগম বলেন, ‘বাড়ির পাশের একজনকে পেঁয়াজ বীজ চাষ করতে দেখে আমিও আগ্রহী হই।’ প্রথম বছর ২০ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের বীজ চাষ করে দুই মণ বীজ পান সাহিদা। তা বিক্রি করেন ৮০ হাজার টাকায়। তারপর থেকে উৎপাদন বাড়তেই থাকে। গত বছর ২৪ একর জমিতে চাষ করেন। ১৫০ মণ বীজ পেয়েছিলেন।

এ বছর ৩০ একর জমিতে চাষ করে ২০০ মণ পেঁয়াজের বীজ পেয়েছেন। প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে দুই লাখ টাকায়। এ বছর বীজের দাম বেশি হওয়ায় তাঁর আয়ও হয়েছে বেশি।

সাহিদার স্বামী বক্তার পৈতৃকসূত্রে চার একর জমির মালিক। বাকি জমি এলাকাবাসীর কাছ থেকে ইজারা কিংবা বর্গা নিয়ে তিনি চাষ করেছেন। আগামী বছর তার লক্ষ্য ৩৫ একর জমিতে চাষ করার।

সাহিদা বেগম জানালেন, পেঁয়াজের বীজ পেতে ছয় মাস জমিতে কাজ করতে হয়। নভেম্বর থেকে রোপণ শুরু এবং ক্ষেত থেকে বীজ শুকিয়ে প্রস্তুত করতে এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত সময় লাগে। আর বিক্রি করতে করতে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস চলে যায়। ‘পেঁয়াজের দানা চাষ খুব কষ্টসাধ্য কাজ। শিশু লালনপালন করার মতো যত্ন আর নজরদারির প্রয়োজন হয়।’ বলেন সাহিদা বেগম।

সারা দেশে সাহিদার পেঁয়াজ বীজ

সাহিদা বেগম বাড়ি থেকেই পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করেন। ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা সাহিদার বীজ কিনতে আসেন। এর মধ্যে পাবনা, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জে চাহিদা বেশি। ‘খান বীজ’ নামে মোড়কজাত করে বিক্রি করেন তিনি। একসময় অবশ্য মোড়কীকরণ ছাড়াই বিক্রি করতেন। সাহিদা বলেন, ‘প্যাকেট না করায় সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ব্যাপারীরা অন্য পেঁয়াজের বীজ মিশিয়ে বিক্রি করতেন। এতে কৃষক কাঙ্ক্ষিত ফলন পেতেন না। ফলে আমার বদনাম হতো।’

ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিচালক আশুতোষ বিশ্বাস বলেন, সাহিদা বেগম পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে ফরিদপুরে এককভাবে শীর্ষে আছেন। তাঁর উৎপাদিত বীজের কদর দেশব্যাপী।

সহযোগী এবার নারী শ্রমিক

সাহিদা বেগমের জমিতে সাধারণত নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এলাকার কৃষি শ্রমিকেরা কাজ করেন। চলতি বছর করোনার কারণে উত্তরবঙ্গের নিয়মিত শ্রমিকদের পাননি। এ জন্য সমস্যার অন্ত ছিল না। তবে সমস্যা ঘোচে এলাকার একটি তুলা মিলের অর্ধশত নারী শ্রমিককে পেয়ে। দেশজুড়ে লকডাউনের সময় এই নারীরা কর্মহীন হয়ে পড়েন। এখনো তারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন।

তাঁদেরই দুজন গোবিন্দপুর গ্রামের হাসিনা বেগম (৪৮) ও তাঁর মেয়ে লাবণী বেগম (২১)।

লাবণী বেগম বলেন, ‘করোনার কারণে তুলার মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছিলাম। ওই সময় সাহিদা আপার জমিতে কাজ পাই। কী যে উপকার হয়েছে বলে বোঝাতে পারব না।’ সাহিদার জমিতে ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক কাজ করেন ছয় মাস। এ ছাড়া সারা বছরই প্রায় ২০ জন শ্রমিক থাকেন।

অনেকের অনুপ্রেরণা

পেঁয়াজের বীজ চাষে সাহিদার সাফল্য দেখে এ কাজে এগিয়ে এসেছেন এলাকার অনেকেই। সালাউদ্দিন শেখ (৩৯) তাঁদেরই একজন। সালাউদ্দিন পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর শেষে চাকরি খুঁজছিলেন। চাকরি না পেয়ে হতাশায় যেন ডুবে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘সাহিদা চাচি ও বক্তার চাচা বেশ কিছুদিন ধরেই পেঁয়াজের বীজ চাষ করছেন। তাদের দেখে আমিও গত বছর থেকে শুরু করি। এ বছর আমি এক একর জমিতে চাষ করে ১৭ মণ পেঁয়াজের দানা পেয়েছি।’

শুধু সালাউদ্দিন একা নন। সাহিদার সাফল্য দেখে বীজ চাষে এগিয়ে এসেছেন এলাকার অনেক শিক্ষিত তরুণ। এতে অবশ্য সাহিদা বেগম আনন্দিত। তিনি যেমনটি বলেন, ‘আমি নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। আমাদের সাফল্য দেখে এলাকার শিক্ষিত বেকার ছেলেরা এগিয়ে আসছে। তাদের পথ দেখাতে পারছি বলে আমার খুব ভালো লাগছে।’


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ