1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ব্যাকটেরিয়ায় নতুন জিন, উদাসীনতায় কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

অনলাইন ডেস্ক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ এমন এক ধরনের ওষুধ যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এ ওষুধ মানুষ বা প্রাণীদেহে প্রয়োগ করলে এটি শরীরের ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে বা এর বংশবিস্তার রোধের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করে। তবে অতিরিক্ত, অপর্যাপ্ত বা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়া হয়ে উঠছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। যথেচ্ছ ব্যবহারে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক।

গত ৩০ বছরেও সংক্রামক রোগের নতুন মলিকুলস অফ অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়নি। যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো আছে শুধু সেগুলোর জেনারেশনকে এক্সটেনশন করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে মানবদেহের ব্যাকটেরিয়ায় এমন জিনের অস্তিত্ব মিলছে যা সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় শতভাগ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। তার মানে সেসব রোগীর শরীরে সংক্রামক ব্যাধি নিরাময়ে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের প্রয়োগ কোনো কাজে আসবে না।

সম্প্রতি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের (এনআইএলএমসি) ইনফেকশাস ডিজিজ বা সংক্রমিত রোগে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যকরিতা শীর্ষক এক গবেষণার আংশিক ফলাফল প্রকাশ করেছে। সেখানে জানানো হয়েছে, মানুষের শরীরে শনাক্ত হওয়া ব্যাকটেরিয়ায় এমন জিন মিউটেশন (অনুজীবাংশ পরিবর্তন) হয়েছে যেগুলো বাংলাদেশে এর আগে পাওয়া যায়নি। ব্যাকটেরিয়ায় এ পরিবর্তিত জিনগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। এসব জিন বিভিন্ন উপায়ে বা কৌশলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এতে করে এসব ব্যাকটেরিয়া যেসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে সেগুলো আর তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারছে না।

এনআইএলএমসির গবেষণা সংশ্লিষ্টদের তথ্যে জানা যায়, সম্প্রতি সরকারি আটটি মেডিকেল কলেজ ও চারটি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউিট হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত নমুনার ওপর গবেষণা করে এমন ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণাটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্ল্যানিং মনিটরিং অ্যান্ড রিসার্স (পিএমআর) শাখার উদ্যোগে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মে পর্যন্ত আট মাস ধরে পরিচালিত হয়। গবেষণার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০ লাখ টাকা অর্থায়ন করে। থার্মোফিশার নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি শাখা ওএমসি এতে সহায়তা করেছে। দেশে অক্টোবরের শেষ দিকে জাতীয়ভাবে এর ফলাফল প্রকাশ করা হবে।

গবেষণাটির নেতৃত্বে ছিলেন- এনআইএলএমসির মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল ইসলাম। আরও যুক্ত ছিলেন- একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা এ্যরিনা, সহকারী অধ্যাপক ডা. নাজনীন তারানা, ডা. বায়েজিদ বিন মনির এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ ইউসুফ।

ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের বাজেট ছিল কম। ফান্ডিং আরও বেশি হলে হয়তো সারাদেশের মানুষের ওপর এ গবেষণা পরিচালনা করা যেত। বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তদের দেহে অ্যান্টিবায়েটিকের অকার্যকরিতার ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি কতটুকু সেটি দেখাই ছিল এ গবেষণার উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে আমরা দেশের ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও ৪টি ইনস্টিটিউটে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করি।

মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চারটি ইনস্টিটিউটের মধ্যে রয়েছে- শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিকস্ ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল এবং আমাদের এনআইএলএমসি।

ডা. সাইফুল আরও জানান, এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে আসা রোগীদের নমুনা নেওয়া হয়। এসব নমুনার মধ্যে রয়েছে রোগীদের প্রস্রাব, উন্ড সোয়াব (ক্ষত নিসঃরিত রস) পাজ বা পুঁজ, স্পুটাম (কফ) ও ব্রংকোএলবুলো ল্যাবেজ (শ্বাসনালী নিঃসারিত রস) ও ইনফেকটেড বডি ফ্লুইড। এসব হাসপাতাল থেকে ১৩ হাজার ৩৫০টা নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণা প্রক্রিয়া বর্ণনা করে তিনি বলেন, ১৩ হাজার ৩৫০টি নমুনার মধ্যে টাফেস্ট (অত্যাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষতিকর অনুজীব) অর্গানিজম (যেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট) থেকে এক হাজার ১৪৯টি ব্যাকটেরিয়া আইসোলেট বা পৃথক করি। সেখান থেকে ২০০ ব্যাকটেরিয়াকে ভাইটেক-২ দিয়ে রি-কনফার্ম (পুনঃনিশ্চিত) করি। ভাইটেক-২ হলো সারাবিশ্বে ব্যাকটেরিয়াল অর্গানিজম আইসোলেশনের (পৃথকীকরণ) অত্যাধুনিক পদ্ধতির মেশিন। সেখান থেকে ৮৩টি সর্বোচ্চ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে আমরা সিলেক্ট করি। যেগুলো পেন ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ছিল, অর্থাৎ যেগুলোকে কোনো ওষুধেই কাজ করছে না। সেগুলোকে আবার ডিএনএ এক্সট্র্যাকশন (পৃথক) ও রি-কনফার্ম করি। সেখান থেকে কমিয়ে ৪০টি ব্যক্টেরিয়াকে জিনোম সিকোয়েন্সিয়ের জন্য নির্ধারণ করে পুনরায় ডিএনএ এক্সট্যাকশন করা হয়।

তিনি বলেন, গবেষণায় বরাদ্দ কম থাকায় সেখান থেকে আরও কমিয়ে ৩২টি বেছে নেওয়া হয়। প্রতিটা ব্যাকটেরিয়ায় লক্ষাধিক রেজিস্ট্যান্ট জিন (অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অনুজীব) ও অন্যান্য উপাদান থাকতে পারে। কিন্তু ৪৬০টি ব্যাকটেরিয়াল জিন যেগুলো সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি রেজিস্ট্যান্ট হয়েছে সেগুলোকে টার্গেটে করে প্রাইমার (কাঠামো তৈরি করা) এবং জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য মেশিনে বসানো হয়।

গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফলাফলে দেখা যায় একেকটা ব্যাকটেরিয়ার এমন কিছু জিন মিউটেশন হয়েছে যে জিনগুলো বাংলাদেশে আগে কখনো মানবদেহে শনাক্ত হয়নি। এই বিশেষ জিনগুলো ব্যাকটেরিয়াল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্সের জন্য দায়ী। একেকেটা জিন একেকভাবে রেজিস্ট্যান্স করে থাকে। এগুলো এতই শক্তিশালী যে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরও শরীরে অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে কোনো ওষুধ কার্যকর হয় না। এক কথায় বলা যায়, শতভাগ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে। এসব হচ্ছে মূলত অতিরিক্ত ব্যবহার ও ভুল ব্যবহারের কারণে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে গবেষণা খুবই কম হচ্ছে। এ নিয়ে গবেষণার পরিধি আরও বাড়াতে হবে। ওষুধের দোকানি, হাতুড়ে চিকিৎসক, প্রেসক্রাইব চিকিৎসক এমনকি রোগী নিজেও যখন-তখন কিনে খাচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় সেবনে সেগুলোর শতভাগ কার্যকরিতা হারাচ্ছে। গবেষণা বলছে, দরিদ্র দেশগুলোতে সংক্রমণ পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। তবে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সবার স্বাস্থ্যের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এর থেকে রক্ষা পেতে হলে ওষুধ নিয়ে গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বর্তমান যেসব অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে তা প্রয়োগে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনেকবল ডিজিস কন্ট্রোলের (সিডিসি) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. অনিন্দ্য রহমান জানান, এর আগে কখনো এ ধরনের জিনবাহী ব্যাকটেরিয়া বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি। বর্তমানে যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে যা খুবই বিপজ্জনক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে অনেক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। নিয়মিত গবেষণা হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। ওষুধ প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছি। এ অ্যান্টিবায়োটিক শুধু ওষুধের ফলে প্রতিরোধী হচ্ছে তা নয়। গৃহপালিত পশু-পাখিদের মাধ্যমেও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হচ্ছে।

তিনি জানান, সম্প্রতি ফার্মেসিগুলোতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি বিষয়ে আইন পাস হয়েছে। এর ফলে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রিতে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে ওষুধ প্রশাসন।

জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের শরীরে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এছাড়া সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন না করলেও আমাদের শরীর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠছে। কারণ, আমরা যে গরুর মাংসসহ অন্যান্য যেসব খাবার খাই তার মাধ্যমে এটি হয়ে থাকে। গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক, স্টোরয়েড খাওয়ানো হয়। এসব গরুর মাংসের মধ্যে প্রবেশ করে। গরুর মাংস খেলে এসব অ্যান্টিবায়োটিক মানবদেহে প্রবেশ করে। এছাড়া মাছের মাধ্যমেও দেহে অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ধাতু শরীরে প্রবেশ করছে। শুধু এসবই নয়, অন্যান্য প্রাকৃতিক খাবারের ওপর গবেষণায়ও জোর দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ২০৪টি দেশের ওপর চালানো এক গবেষণায় উঠে আসে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে ১২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যা এইডস কিংবা ম্যালেরিয়ায় প্রতিবছর বিশ্বে যত লোক মারা যায়, এ সংখ্যা তারও দ্বিগুণ।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ