1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ব্যাংক নিয়ে গুজব ও কিছু দরকারি কথা

নিরঞ্জন রায় : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২২

সম্প্রতি দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে গুজব রটানো শুরু হয়েছে। আর্থিক খাতে, বিশেষ করে দেশের পুঁজিবাজারে গুজব রটিয়ে ফায়দা লোটার ঘটনা খুবই সাধারণ এবং এ কারণেই দেশের পুঁজিবাজারে গুজব রটানোর বিরুদ্ধে আছে শক্তিশালী আইন। তবে ব্যাংকিং খাত নিয়ে গুজব রটানোর ঘটনা সেভাবে দেখা যায় না, যদিও মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন দু-একটি গুজবের ঘটনা যে একেবারে ঘটে না তেমন নয়। সাম্প্রতিককালে দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে যেভাবে গুজব রটানো হচ্ছে তেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।

এবার গুজবের ক্ষেত্রগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে ভিন্ন ভিন্নভাবে। যেমন—দেশের ব্যাংকে ডলার নেই, তাই ব্যাংক এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না এবং ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা ব্যাপকহারে অর্থ উত্তোলন করে নিতে শুরু করেছে।

গুজবের মাত্রা এবং বাস্তব অবস্থা নিশ্চয়ই কিছুটা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করার উদ্যোগ নিতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো নেহাতই ভিত্তিহীন গুজব, নাকি এসব গুজবের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। প্রথমত, দেশের ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না বলে যে গুজব রটানো হয়েছে তা মূলতই একটি গুজব এবং ডাহা মিথ্যা অপপ্রচার। এই গুজব দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেভাবে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে যে দেশে পর্যাপ্ত তারল্য আছে, তাই ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে না পারার কোনো কারণই নেই। একটি স্বনামধন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী গুজবের বিরুদ্ধে একটি নিবন্ধও স্থানীয় একটি পত্রিকায় লিখেছেন এবং সেখানেও তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আসল কথাটি উল্লেখ করেননি। ব্যাংকের এমডি এবং প্রধান নির্বাহীদের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে সেখানেও তারল্যের আধিক্যের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু যে কারণে একটি ব্যাংক তার গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয় তা সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। ফলে এসব গতানুগতিক বক্তব্য এবং বিবৃতি জনগণকে সেভাবে আশ্বস্ত করতে পারছে না।

একটি ব্যাংক তখনই তার গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবে যদি সেই ব্যাংক কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়। তারল্য থাকা সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেই ব্যাংক অর্থ পরিশোধ করতে পারে না। যেমন—গত শতকের আশির দশকে বিসিআইসি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যদিও সেটি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নির্দেশে বন্ধ হয়েছিল এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছুই করার ছিল না। তখন তারল্যের আধিক্য থাকা সত্ত্বেও সেই ব্যাংকের ঢাকা অফিস গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি। আমাদের দেশে আগে কোনো ব্যাংক বন্ধ বা অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে মিলিত (মার্জার) হয়নি এবং আগামী দিনেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ কোনো ব্যাংক তখনই বন্ধ হয়, যখন সেই ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যায় অথবা দুর্বল অবস্থার কারণে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়। আমাদের দেশে দেউলিয়া আইন এবং মার্জার ও অ্যাকুইজিশন আইন সেভাবে কার্যকর নয়। ফলে কোনো ব্যাংকের দেউলিয়া বা অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে ব্যাংকের অবস্থা যতই দুর্বল হোক, ব্যাংক আমাদের দেশে টিকে থাকবে এবং ব্যাংক টিকে থাকলে সে তার গ্রাহকদের অর্থ যথানিয়মেই ফেরত দিতে পারবে। এ কারণেই একসময়ের আল বারাকা ব্যাংক অনেক খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েও একাধিকবার নাম পরিবর্তন করে যথানিয়মে টিকে আছে এবং গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিয়ে আসছে। সুতরাং ব্যাংক টাকা ফেরত দিতে পারবে না বলে যে প্রচারণা আছে তা ডাহা মিথ্যা কথা এবং বড় ধরনের গুজব।

সম্প্রতি দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে যে গুজব রটানো হয়েছে তার একটি ভিন্নতা আছে। কারণ এটি নিছক গুজব নয়। এই গুজবের পেছনে একটি যুক্তিসংগত কারণ নিহিত আছে। সম্প্রতি সরকার ব্যাংকে হিসাব খুলে অর্থ জমা রাখা, ব্যাংকে স্থায়ী আমানত রাখা, স্থায়ী আমানতের ওপর সুদ গ্রহণ এবং ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে শর্ত হিসেবে আয়কর রিটার্ন জমাদান বাধ্যতামূলক করেছে। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকের এসব সেবা নবায়নের ক্ষেত্রেও এই আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই শর্তের কারণে ব্যাংক যেমন একদিকে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না, অন্যদিকে গ্রাহকরা আতঙ্কে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে অন্যত্র রেখে দেওয়ার কথা ভাবছে।

সম্প্রতি আমি বাংলাদেশের একটি ব্যাংকে গিয়েছিলাম আমার এক নিকটাত্মীয়ের স্থায়ী আমানত নবায়নের সমস্যা নিয়ে। যেহেতু আমার সেই আত্মীয়ের আয় করযোগ্য আয়ের নিচে ছিল, সেই কারণে তাঁর আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া নেই। কিন্তু আয়কর রিটার্নের কপি না থাকায় সেই ব্যাংক এখন তাঁর স্থায়ী আমানত নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায়। আমি যখন সেই অর্থ তুলে নেওয়ার কথা জানালাম তখন সেই ব্যাংক কর্মকর্তা আমাকে জানালেন যে ‘সব ব্যাংকই এই রিটার্নের কপি চাইবে, কাজেই আপনি টাকা তুলে নিয়ে কী করবেন। ’ সেই ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ হ্রাস পাবে বিধায় সেই ব্যাংক কর্মকর্তা পরোক্ষভাবে আমার টাকা তুলে নেওয়ার দাবিকে নিরুৎসাহ করছিলেন, যা একটি ব্যাংকের জন্য স্বাভাবিক। আমার যুক্তিতর্কের কারণে সেই ব্যাংক কর্মকর্তা আমার আত্মীয়ের স্থায়ী আমানত নবায়ন করে দিলেন এক শর্তে যে আমি আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে তার কপি তাঁকে দিলেই তিনি সেই আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদ দিতে পারবেন।

যেহেতু আমি ব্যাংকার, তাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। দেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ এত কিছু বুঝবে না এবং তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে ব্যাংকের অর্থ ফেরত না দেওয়ার চেষ্টা এবং গ্রাহকদের ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়া; এই দুটিই এখন এমন এক বাস্তবতা, যা ব্যাপকভাবে গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি এনবিআরের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়কে অনুরোধ করব, আপনারা একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন যে দেশের সাধারণ মানুষ কী মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে এই আয়কার রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যতামূলক শর্তের কারণে।

দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে যে গুজব রটছে তা দূর করতে হলে বা প্রকারান্তরে ব্যাংককে টাকা ফেরত না দেওয়ার চেষ্টা এবং গ্রাহকদেরও ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন থেকে বিরত রাখতে হলে এর নেপথ্যের কারণ আগে দূর করতে হবে। ব্যাংকের লেনদেনের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের শর্ত যদি অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করা না হয়, তাহলে এই গুজব তো থামবেই না, উল্টো বাস্তব অবস্থা হতে পারে ভয়াবহ। দেশের অধিকসংখ্যক মানুষের রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে এভাবে ব্যাংক আমানতসহ কিছু অত্যাবশ্যক সেবার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়ার বিষয়টি মোটেই বোধগম্য নয়। এক তথ্য মতে, দেশে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ আয়কর রিটার্ন জমা দেয়, আর এসব অত্যাবশ্যক সেবা গ্রহণ করে প্রায় ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষ। এনবিআর চাইলেও তো এত বিপুলসংখ্যক মানুষের আয়কর রিটার্ন জমা নেওয়া এক বছরে কেন, দুই-তিন বছরেও সম্ভব হবে না। তাহলে এত দিন কি মানুষ ব্যাংক আমানতসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে? তা ছাড়া যাদের আয় করযোগ্য আয়ের নিচে, তাদের তো আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতাই নেই। তাহলে তারা কেন এই রিটার্ন জমা দেওয়ার শর্তের কারণে ভুক্তভোগী হবে। এসব বিষয় অর্থ মন্ত্রণালয় এবং এনবিআরকে জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে হবে।

সরকার যদি মনে করে যে দেশের সব নাগরিককে বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্নের আওতায় নিয়ে আসবে, তাহলেও তো সেটি করতে হবে পর্যায়ক্রমে একটা সময় নিয়ে। দেশের আয়কর রিটার্ন দাখিল পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সহজে আয়কর রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। এটা কিভাবে সম্ভব তা বিস্তারিত তুলে ধরে আমি স্থানীয় পত্রিকায় একাধিকবার লিখেছি। এরপর আগামী তিন বা চার বছর সময় বেঁধে দিয়ে এই সময়ের মধ্যে দেশের সব নাগরিককে রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করতে হবে। তারপরই সব কিছুতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের শর্ত জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। তার আগে নয়।

এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে আকস্মিক এই রিটার্ন দাখিলের শর্ত জুড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে এক মারাত্মক বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ যত না কষ্টে আছে তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যা এবং দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে এই আয়কর রিটার্ন জটিলতায় তাদের ব্যাংক আমানত এবং আমানতের ওপর প্রাপ্ত সুদের বিষয় নিয়ে। এই শর্তের কারণে যারা ব্যাংক আমানত বা সঞ্চয়পত্রের ওপর অর্জিত সুদ দিয়ে সংসার চালায় তারা পড়েছে মহাবিপদে। এমনকি অনেকে আতঙ্কে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে ভুঁইফোড় সব এনজিও বা সংস্থায় জমা রেখে সর্বস্বান্ত হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে এবং এই একটি সিদ্ধান্ত সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামাতে পারে। আমি নিশ্চিত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এই বিষয়টি নেই, থাকলে তিনি কোনো অবস্থায়ই জনভোগান্তি বাড়ায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে দিতেন না। কেননা প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই জনগণের কল্যাণের কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

আমরা আশা করব, অনতিবিলম্বে ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্রের ওপর থেকে বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার শর্ত প্রত্যাহার করে, জনগণের ভোগান্তি লাঘব করে ব্যাংকে টাকা রাখার ব্যাপারে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, সরকার সবার আগে তা দূর করার উদ্যোগ নেবে। তাহলে ব্যাংকিং খাত নিয়ে গুজব রটানো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।

লেখক : নিরঞ্জন রায় – সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ