মুক্তিযুদ্ধ শেষে নিজের জন্মভূমিকে পর করে পাকিস্তানকে আপন করে লাখ লাখ বাঙালি এখন ভুগছে।
কয়েক লাখ বাঙালি বাংলাদেশে না এসে থেকে যায় পাকিস্তানে। আরও কয়েক লাখ মানুষ বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়েছে পাকিস্তানি পরিচয়কে ধারণ করতে।
৫০ বছর পর এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখে। কিন্তু জন্মভূমির বদলে অন্য দেশকে আপন করে এখন তারা নাগরিক অধিকারহীন মানুষে পরিণত হয়েছে।
তারা নিজেদের পাকিস্তানি ভাবে, কিন্তু পাকিস্তান তাদের ‘বাঙাল’ বলে দূরে ঠেলে দিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক মানবাধিকার বঞ্চিত তারা। বর্তমান তাদের কাছে দুঃসহ, ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত।
যখন একই দেশ ছিল, তখন পাকিস্তানের পূর্ব অংশ থেকে কয়েক লাখ মানুষ পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে যায় চাকরি-ব্যবসাসহ নানা কাজে। যুদ্ধ শেষে কারা কোথায় থাকবে, সেই সুযোগ যখন দেয়া হয়, তখন তারা পাকিস্তানি পরিচয় নিয়ে থাকতে পছন্দ করে।
আবার যুদ্ধ শেষে কয়েক বছরে নানাভাবে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েক লাখ বাঙালি পাকিস্তানে গিয়েছে আশ্রয়ের জন্য। এই স্রোত এমনকি ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ছিল।
যদিও এসব বাংলাভাষীরা পাকিস্তানপ্রেমী, কিন্তু পাকিস্তানিরা তাদের পছন্দ করে না।
বাংলাদেশ সরকার আটকেপড়া পাকিস্তানিদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ দিলেও পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই।
তবে শুরুতে সমাদর ছিল। ১৯৭৩ সাল থেকে তাদের পরিচয়পত্র দেয়া শুরু করে পাকিস্তান সরকার। তবে ২০০০ সালে যখন ডিজিটাল আইডি কার্ড ও নাগরিক তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়, তখন তাদের বাদ দেয়া হয়।
নাগরিকত্ব না থাকায় পড়াশোনা, চিকিৎসার মতো নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা।
কাগজপত্র না থাকায় তাদের হাসপাতাল থেকে বিনা চিকিৎসায় ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে।
পাকিস্তানপ্রেমী এই বাঙালিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে করাচির ১০৫টি বসতিতে। ওরাঙ্গি টাউন, ইব্রাহিম হায়দারি কলোনি, বিলাল কলোনি, জিয়াউল হক কলোনি, মূসা কলোনি, মাচার কলোনি এবং ল্যারির বাঙালি পাড়ায় বাঙালি বসতি সবচেয়ে বেশি।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময়ে বর্তমান পাকিস্তানের ভূখণ্ডের বাইরে থেকে যারা এসেছিল, তাদের বলা হয় মুহাজির। এই মুহাজিররা পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। এদের রাজস্থানি, কনকানি, মারাঠি, হায়দরাবাদী বংশোদ্ভূত মুহাজিরদের বেশির ভাগেরই অবস্থান সিন্ধু প্রদেশে। তবে অন্য জাতিদের মুহাজির হিসেবে একটু সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখলেও বাঙালিদের দেখা হয় চরম অপমানের চোখে।
এক হিসাবে করাচিতে পাকিস্তানপ্রেমী বাঙালি জনসংখ্যা শহরে মোট জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় তা ১৫ থেকে ২০ লাখের মতো।
বৈধ কাগজপত্র না থাকার ফলে সমাজের মূল স্রোতে তারা যুক্ত হতে পারেন না। ফলে সম্মানজনক পেশায় খুব একটা আসতে পারে না তারা। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অনেকেই পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের গৃহকর্মের কাজে লাগিয়ে দেয়। সমাজের মূল স্রোতে যুক্ত হতে না পারার ফলে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে যায়।
এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ইমরান খান তার নির্বাচনি ইশতেহারে বাংলাভাষীদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি রেখেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে করাচিতে অনেক বাঙালি অভিবাসী বসবাস করছেন। তাদের কোনো পরিচয় নেই। কোনো কাজও করতে পারছেন না পরিচয়সংকটের কারণে। তাই হাজার হাজার বাংলাভাষী অভিবাসী নানা অপরাধের দিকে চলে যাচ্ছেন।
কিন্তু স্থানীয়দের চাপে বাংলাভাষীদের নাগরিকত্ব দিতে পারেনি ইমরান খানের সরকার।
এদের পূর্বপুরুষরা ১৯৭১ সালে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আর এখনও বাংলাদেশবিরোধী সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় তারা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে পাকিস্তানে আন্দোলন করে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনিমকস টাইমসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, করাচি সমাজে বাংলা ভাষাভাষীরাই সবচেয়ে দরিদ্র এবং তারা শরণার্থীর মতো জীবনযাপন করে। খুব কমসংখ্যক বাংলাভাষীরই পাকিস্তানের নাগরিকত্বের কাগজপত্র আছে।
উসমান টাউন বাঙালি পাড়ায় প্রায় ছয় দশক ধরে বাংলাভাষীদের বসবাস। তারা অনেকে দেশভাগের আগ থেকে সেখানে বসবাস করছে। তবুও তাদের হয়রানির ভয়ে ভীত থাকতে হয়।
পাকিস্তানের শরণার্থীবিষয়ক সরকারি সংস্থা (ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স রেগুলেটরি অথরিটি) এবং পুলিশ প্রায়ই তাদের পাকিস্তানি নাগরিকত্বের কাগজপত্র না থাকায় হয়রানি করে থাকে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে পাকিস্তান বেঙ্গলি অ্যাকশন কমিটির সভাপতি শেখ মুহাম্মদ সিরাজ বলেন, ‘স্থানীয়রা আমাদের বহিরাগত, শরণার্থী ও ভীনদেশি হিসেবে দেখে, মানবিক অধিকার থেকে তারা আমাদের বঞ্চিত করে।‘
যখন তারা কোনো কাজের জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখন তাদের এমন সমস্যার মধ্যে ফেলা হয় যে অধিকাংশ দরিদ্র বাংলাভাষীর পক্ষে তা সমাধান করা সম্ভব হয় না। মাঝেমধ্যে শরণার্থী সংস্থা থেকে পাকিস্তানে অবৈধভাবে অবস্থানের জন্য তাদের কারাগারেও পাঠানো হয়।
বাংলাভাষী অধ্যুষিত মাচার কলোনির সাবেক সভাপতি ড. আলাউদ্দিন জানান, ‘বাংলাভাষীরা সব সময় ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে থাকে, কারণ পাকিস্তানের প্রত্যেকটি শহরে পুলিশ তাদের সব সময় খুঁজতে থাকে।‘
পাকিস্তানমুখী এই স্রোত থামাতে ১৯৯৫ সালে বেনজির ভুট্টো সরকার ধরে ধরে বাংলাভাষীদের বাংলাদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। তবে বাংলাদেশ সরকার তাদের গ্রহণ করেনি।
দুটি বিমানভর্তি বাংলাভাষীদের উল্টো পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ। বেনজিরের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে প্রভাব ফেলার উপক্রম হয়। পরে অবশ্য বেনজির এই পদক্ষেপ বাতিল করেন।