1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

টেকসই উন্নয়ন : উদ্দেশ্য এবং উপায়

আব্দুল বায়েস : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২২

ছোটবেলায় শুনতাম অমুকের মতো হও, তমুকের মতো হতে নেই। কলেজে পা ফেলে দেখি কেউ মহানায়ক উত্তম কুমারের মতো চুল ছাঁটে, কেউ নায়িকা মধুবালা কিংবা নার্গিসের মতো করে হাসতে গিয়ে হাসির খোরাক হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখি পিকিং, মস্কো, ওয়াশিংটনপন্থীদের প্রচণ্ড পদচারণ; বাঙালিপন্থীও ছিল পাশাপাশি। পেশাজীবনে পেলাম বাংলাদেশের প্রতি পরামর্শ—দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মতো হও।

এর কথা ওর কথা শুনতে শুনতে নীতিনির্ধারকদের অবস্থা মান্না দের গাওয়া সেই বিখ্যাত গানের মতো, ‘আমি কোন পথে যে চলি, কোন কথা যে বলি/তোমায় সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই মনের চোরা গলি/সেই গলিতেই ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে দেখি, বন্ধু সেজে বিপদ আমার দাঁড়িয়ে আছে একি। ’

বিপদ আছে বৈকি। অন্তত সরকারি পরিকল্পনায় এবং ধীমানদের ধ্যান-ধারণায় এমনি ইঙ্গিত মেলে যে আগামী এক দশকের মধ্যে উঁচু-মধ্যম আয়ের দেশ এবং দুই দশকের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ সামনে এগোচ্ছে। যদিও করোনা আর চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আপাতত পথ আগলে রাখছে। সন্দেহ নেই যে আমাদের লক্ষ্যগুলো প্রেরণাদায়ক, তবে উদ্দীপ্ত উদ্দেশ্যে পৌঁছতে নির্দিষ্ট পথ পরিষ্কারভাবে জানান দেওয়া দরকার। এই ক্রান্তিকালের করণীয় হিসেবে আরো দরকার অন্ধ অনুসরণ নয়, বরং বাংলাদেশের নিজস্ব ‘মডেলে’র ওপর ভর করে সামনের সমস্যাসংকুল পথ পাড়ি দেওয়া।

অর্থনীতির প্রখ্যাত অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অন্তত এমনটিই মনে করেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করতে বাংলাদেশভিত্তিক সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি সাধারণ মনেও চিন্তার খোরাক জোগায় বলে এর উপস্থাপনা খুবই জরুরি।

তার কারণ “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়ক অধ্যয়ন স্বীকার করে নিয়েছে যে উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন একটা সাধারণ ঘটনা, তবে টেকসই হওয়া ব্যতিক্রম। তাই উপলব্ধ উল্লাস উদযাপনের আগে সতর্ক দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের বিদ্যমান ব্যাখায় ‘এশিয়ার উদীয়মান বাঘ’-এর মতো হওয়ার অবারিত উপদেশ অহর্নিশ আসতে থাকল। অবস্থা অনেকটা যেন ১৯৬৫ সালে রক ব্যান্ড ‘বিচ’ কর্তৃক গাওয়া একটা গানের মতো ‘ওরা সবাই যদি ক্যালিফোর্নিয়ার মেয়ে হতো’। ”

কিন্তু সবাই তা হয় না। অন্যদিকে সম্ভবত অধিক সময় ব্যয় করা হয়েছে এমনতর ‘উপচিত’ উপদেশ উদগিরণে এবং এর বিপরীতে অপেক্ষাকৃত অনেক কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাপানের অভিজ্ঞতা সিঞ্চনে। এই দেশটি ১৯০০ সালে আর্জেন্টিনার সমান মাথাপিছু আয় নিয়ে আকাশচুম্বী উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ চীন হয়তো অনুকরণীয় মডেল হতে পারত; কিন্তু বাজার অর্থনীতি আলিঙ্গনের পর থেকে দেশটিতে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে অসমতা—আয় বৈষম্য। এখন বিদিশায় পড়া দেশটি বড় বড় ব্যবসা দমন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ এর সম্পূর্ণ বিপরীত জাপানের অভিজ্ঞতা। “শ্রমিকদের কল্যাণ ও আনুগত্যের মিলন ঘটিয়ে—যাকে বলে ‘জাপানের মূল্যবোধ’—জাপানের ব্যাবসায়িক মডেল প্রবৃদ্ধিকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ন্যায়সংগত রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর সে জন্যই বোধ হয় জাপানে ধনী লোক বেশি কিন্তু বিলিয়নেয়ার হাতে গোনা কয়েকজন (আমেরিকার ৬৭৫ এবং ভারতের ১৭৫-এর বিপরীতে মাত্র ২৫!)। সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশে যত উঁচু প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তত বিলিয়নেয়ার বাড়ছে; বিলিয়নেয়ার নিয়ে অসম প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। ”

সফলতার সব গল্পে অবশ্য কিছু মিল পাওয়া যায়, যেমন—লিও তলস্তয় বলেছেন, ‘সুখী পরিবার সব একই রকম। ’ মিলটা হলো এই যে একটা কল্যাণকর সমাজ বিনির্মাণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটা সহায়কী পরিবেশ সৃষ্টি করা, যা অর্থনৈতিক উদ্যোগ উৎসাহিত করবে। এই ‘সহায়কী পরিবেশ’ দেশভেদে ভিন্নতর হতে পারে, তবে আমাদের কাছে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন—বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন উপাদান কী হতে পারে বলে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মনে করছেন?

প্রথমত, এলডিসি-পরবর্তী জামানার চ্যালেঞ্জ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতকালের প্রাধিকারমূলক প্রাপ্তি ছাড়া কেমন করে সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দর-কষাকষি করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করা যায়, তার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। এবং তা এখন থেকেই। কেউ হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই, বরং আমাদের বাণিজ্য-অংশীদাররা যার যার মতো করে এক বা একাধিক আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য এলাকায় এরই মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। দৌড়ঝাঁপ লেগে গেছে দোর খুলে দেওয়ার জন্য।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জন্য অন্য একটা বিশেষ দিক হচ্ছে, প্রকট ভূমিস্বল্পতা। দ্বীপ দেশ সিঙ্গাপুর ছাড়া আবাসন আর উৎপাদনের বাইরে যে জায়গা আছে তা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম। বস্তুত পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে বিদ্যমান কৃষিজমি, বন ও জলাধারের মতো অন্যান্য পরিবেশিক সম্পদের ওপর অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন গড়ে তোলা বেজায় কঠিন কাজ। উঁচু-মধ্যম আয়ের দেশে যেতে পারলে তো চ্যালেঞ্জ তীব্রতর হওয়ার কথা। এমন সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের উচিত হবে পরিবেশবান্ধব ভূমিব্যবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে শিল্পোন্নত দেশের চেয়েও বেশি জিডিপি উৎপাদন করার পথ বের করা, যার জন্য অবশ্য প্রচুর গবেষণা দরকার।

তৃতীয়ত, ‘ঢাকা শহরের মতো মেগাসিটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একে অপরকে সাহায্য করার তথা এগলোমারেসনের সুফল যেমন আছে, তেমনি রয়েছে পরিবেশদূষণের এবং ব্যয়বহুল নাগরিক সুবিধা প্রদানের কুফল। এখানে অবশ্য সুফলের চেয়ে কুফলের কর্তৃত্ব অনেক বেশি বলেই যত বিপত্তি। শহরের এই গাদাগাদি অবস্থাকে সহনীয় করে তুলতে প্রয়োজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৌশল, যেখানে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন সব দিকে ছড়িয়ে পড়বে। পুরো দেশ নগরসম আবাসভূমিতে রূপান্তরিত হলে দূরবর্তিতা দূর হবে, নিবিড় সংযোগ সাধিত সাপ্লাই চেইন গড়ে উঠবে এবং এমনি করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মেগাসিটির মতো এগলোমারেসন সুবিধা পাবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের উচিত হবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মতো ডেনসিটি ডিভিডেন্ড ঘরে তোলার প্রচেষ্টা চালানো। ’

পরিকল্পিতভাবে উন্নত ভৌত অবকাঠামোর উপস্থিতি অত্যন্ত প্রয়োজন সন্দেহ নেই। তবে তার সঙ্গে ব্যবসার পরিবেশ ভালো রাখার জন্য যথাযথ নীতিমালা থাকা দরকার। যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলে প্রত্যাশিত শিল্পায়ন ঘটাতে পারেনি নানা কারণে। যেমন—ল্যান্ড লকড অঞ্চল, তবে সাগরের সীমানা ধরে পদ্মা সেতুর সুফল ঘরে তুলতে চাই পরিকল্পিত পদক্ষেপ। স্মর্তব্য, এ ধরনের মেগাপ্রকল্প তখনই প্রবৃদ্ধিবান্ধব হয়, যখন তা অধিকতর ব্যক্তি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। বিশেষত রপ্তানিমুখী এফডিআই প্রবাহের জন্য ভবিষ্যতে এই প্রকল্পগুলোর কারণে নেওয়া ‘সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিট’ লেনদেন ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটাতে পারে না।

চতুর্থত, বাংলাদেশের শাসন বা গভর্ন্যান্স নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। বিষয়টি জটিল, তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটা বিশেষ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেই নয়। অর্থনীতিবিদরা এখন ভালো করেই বুঝে গেছেন যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লালনে বাজারের কার্যকারিতা এবং বাজারব্যবস্থার ভূমিকা নির্ভর করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আচরণগত নৈতিক নিয়মের ওপর। বস্তুত এগুলো মিলে হচ্ছে অবকাঠামো, বলা চলে সামাজিক পুঁজি, যার মধ্যে বাজার অর্থনীতি দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে। গভর্ন্যান্সের যেসব নির্দেশক নিয়ে আমরা সচরাচর নাড়াচাড়া করি সেগুলো মূলত সংগঠিত গভর্ন্যান্স কাঠামোতে অবস্থান নেওয়া পদ্ধতিগত ও কার্যকরকরণ সমস্যা, যেমন—দুর্নীতি দমনে নীতি সংস্কার, মৌলিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সম্পত্তি অধিকার সংরক্ষণ অথবা আমলাতান্ত্রিক বাধা অপসারণ ইত্যাদি। ‘সন্দেহ নেই যে এরা বিদ্যমান উঁচু ব্যাবসায়িক ব্যয় কমিয়ে আনতে অবদান রাখতে পারে কিন্তু পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। তা এই যে যদি আমরা না জানি কিভাবে বিচ্যুত ব্যবহার জন্ম নেয় এবং কিভাবে আচরণগত নিয়মগুলো সংগঠিত হয়, সে ক্ষেত্রে জবাবদিহি বৃদ্ধি ও দুর্নীতি হ্রাসে গৃহীত এসব প্রশাসনিক সংস্কার কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এমনকি বাজার নিয়ন্ত্রক এবং বিবেকহীন ব্যবসায়ীর মধ্যকার অশুভ গোপন সহযোগিতা ব্যাখ্যায়ও তার প্রয়োজন আছে। ’

আরেকটা কথা। জনকল্যাণে সামাজিক খাতের উন্নয়ন নির্দেশকের ভূমিকা ব্যাপক সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের অধিকতর দৃষ্টি দেওয়া উচিত হবে এই অর্জন ও দেশের অর্থনৈতিক কৃতিত্বের মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টিতে। মেয়েদের স্কুলে অন্তর্ভুক্তি আর পোশাকশিল্পে কর্মসংস্থানের মধ্যকার সংযোগ নিয়ে গবেষণাপ্রসূত প্রমাণ আছে। কিন্তু এ প্রমাণও আছে যে কর্মোপযোগী দক্ষতার অভাবে মাধ্যমিক পাস করা গ্র্যাজুয়েট অনেকে বেকার থাকছেন অথবা তাঁদের দক্ষতার উপযোগী তেমন কাজ নেই বলে। সুতরাং চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে বর্ধনশীল শ্রমশক্তির যথেষ্ট দরকারি দক্ষতা ও সক্ষমতা সৃষ্টি করা কিংবা তাঁদের দক্ষতা সাপেক্ষে যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি করা।

সুখবর যে বাংলাদেশে জনমিতিক রূপান্তর ঘটেছে একটু আগেভাগেই। ফলে জনমিতিক কাঠামোতে যুব স্ফীতির মাধ্যমে পাওয়া জনমিতিক সুফল সঞ্চারিত হয়ে বর্তমান প্রসারমাণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রসাদ হাতের নাগালে। তবে সুযোগের জানালাগুলোর সঠিক ব্যবহার ঘটিয়ে আরো দুই দশক পার করতে পারলে বাঁচোয়া। কারণ এর পর থেকে বার্ধক্যজনিত কারণে শ্রমশক্তির সরবরাহ ধীরে ধীরে নিম্নগামী হবে। মোটকথা ব্যক্তির বেলায় যা, দেশের বেলায়ও তা সত্য—বৃদ্ধ হওয়ার আগে ধনী হতে হবে। ঘটনাক্রমে বলতে হয়, সরকারি লক্ষ্য অনুযায়ী যে বছর বাংলাদেশের ধনী দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু, সে বছরই জনমিতিক সুফলের যুগ শেষ—রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা। ’

‘সুখী হওয়া খুব সোজা কিন্তু সোজা হওয়া খুব কঠিন’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

লেখক : আব্দুল বায়েস – সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ