1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

নওয়াপাড়া নৌবন্দর নিয়ে কার্যকর পরিকল্পনার প্রত্যাশা  

নিজস্ব প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২২

যশোরের অভয়নগর উপজেলার ছোট্ট শহর নওয়াপাড়া। নৌ, স্থল আর রেলপথ তিন যোগাযোগ সুবিধার কারণে নওয়াপাড়ায় গড়ে উঠেছে বিশাল ব্যবসাকেন্দ্র। কিন্তু যে নদ ঘিরে চলছে সবকিছু, সেই ভৈরব নদ নাব্য হারিয়ে এখন মৃতপ্রায়। নদের মধ্যে জেগে উঠেছে চর। এসব কারণে নৌ-বন্দর অচল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নদী খনন ও অবৈধ দখলমুক্ত করা না গেলে নৌযান চলাচল বন্ধ হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।

তবে এসবের মাঝে আশার কথা শোনালেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশালের দায়িত্বে থাকা এবং ‘নওয়াপাড়া নদীবন্দর এলাকায় টার্মিনালসহ বন্দর সুবিধাদি নির্মাণ’ প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন উর রশীদ। তিনি বলেন, ‘একনেকে প্রকল্প পাস হলেই যত দ্রুত সম্ভব বন্দরের কাজ শুরু হবে। ৪৫৪ কোটি টাকার প্রকল্পে বদলে যাবে নওয়াপাড়া নৌবন্দর।’

নদের প্রাণ ফেরাতে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে আন্দোলন করছেন বলে জানিয়েছেন বন্দরের হ্যান্ডলিং শ্রমিক নেতা ফাল্গুন। তিনি বলেছেন, ‘ভৈরবে নাব্য নেই। নদের মধ্যে জেগে উঠেছে চর। নামকাওয়াস্তে চলছে ড্রেজিং, দৃশ্যমান কিছুই হচ্ছে না। নওয়াপাড়া নৌবন্দরে এখন জাহাজের সংখ্যা দিন-দিন কমছে। এমন চলতে থাকলে আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে নওয়াপাড়া নৌ-বন্দর শুধু নামেই থাকবে। ১০ বছর ধরে নদ খনন করে দুপাশে গাইড ওয়াল নির্মাণ করে বন্দরকে বাঁচাতে আন্দোলন-সংগ্রাম করছি আমরা।’

যশোরের অভয়নগর উপজেলা শহর নওয়াপাড়ার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদ এবং যশোর-খুলনা রেলপথ ও মহাসড়ক। এই তিন পথ নওয়াপাড়ায় সমান্তরালে ১৫০-২০০ মিটার দূরত্বে রয়েছে। তিন পথের যোগাযোগ সুবিধার কারণে নওয়াপাড়ায় গড়ে উঠেছে অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র। বছরে বিদেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার আমদানি পণ্য এখানে খালাস হয়। এখান থেকে সারা দেশে যায় রাসায়নিক সার, কয়লা, খাদ্যশস্য ও পাথর।

শুধু আমদানি পণ্য নয়, প্রায় হাজার কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ পণ্যের বড় বাজার নওয়াপাড়া। যে নদ ঘিরে গড়ে উঠেছে এই ব্যবসাকেন্দ্র, সেই ভৈরব কিন্তু ধুঁকছে। দখল ও ভরাটের কারণে নদটি সরু হয়ে গেছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের দাবির পরও দখলমুক্ত হচ্ছে না নদ, হচ্ছে না নিয়মিত খনন।

অভয়নগর নওয়াপাড়া পৌর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফাল্গুন বলেন, ‘এই নৌবন্দরে ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর ও বাঘারপাড়াসহ আশপাশের বহু মানুষের জীবন-জীবিকা। বন্দরে ৫০০ মেট্রিক টন থেকে শুরু করে দেড় হাজার মেট্রিক টন পণ্যবাহী জাহাজ নোঙর করে। কিন্তু নাব্য সংকটে এখন আগের মতো জাহাজ ভিড়ে না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে নওয়াপাড়া নৌবন্দর অচল হয়ে যাবে।’

নাব্য সংকটে ভৈরব নদ এখন নালায় পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন নওয়াপাড়া সার, সিমেন্ট ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই নৌবন্দরের অন্যতম সমস্যা ভৈরব নদের নাব্য সংকট। নদের ভেতরে পলি জমে তা ভরাট হয়ে গেছে। আগে যে সংখ্যক জাহাজ ভিড়ত; এখন তার অর্ধেকে নেমে এসেছে। জেটি থেকে দুই-আড়াইশ ফিট দূরে জাহাজ ভিড়ে।

বাঁশের সাঁকো তৈরি করে শ্রমিকদের দিয়ে মালামাল আনলোড করা হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে, প্রক্রিয়াও বিলম্ব হচ্ছে। আগে মালামাল খালাস করতে ১৫-২০ দিন লাগলেও এখন তা মাস ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে জাহাজের জন্য আলাদা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। সে কারণে অনেকে এখন আগ্রহ হারাচ্ছেন এই বন্দর ব্যবহারে। আগে প্রতিদিন ঘাটে চার শতাধিক কার্গো থাকত; এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।’ একই কথা জানিয়েছেন অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ব্যবসায়ী এনামুল হক বাবুল। তিনি বলেন, ‘ভৈরব নদের বুকে বিভিন্ন স্থানে চর জেগে উঠেছে।

নদের মূল চ্যানেল খালের চেয়ে সরু হয়ে গেছে। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, ড্রেজিংয়ের স্পয়েল ফেলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে কথাটি ঠিক নয়। নতুন ব্রিজের ওপরে দাঁড়ালে দেখা যায় জোয়ারের সময় বার্জগুলো কাদার ওপরে পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ, পলি পড়ে নদের বুক ভরাট হয়ে গেছে।’ অবিলম্বে নদের পলি অপসারণে ড্রেজিং চালু ও নদের জায়গা দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়ে এনামুল হক বাবুল বলেন, ‘নদ না থাকলে এই অঞ্চলের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া অভয়নগরে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) নির্মাণ হচ্ছে। আধুনিক নৌবন্দরের যে প্রকল্প ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় করা হয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানাই।’

ভৈরব নদে ড্রেজিং চলছে জানিয়ে নওয়াপাড়া নদীবন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে ড্রেজিংয়ের ফলে স্পয়েল ফেলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণে ড্রেজিংয়ে ধীরগতি। নৌবন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের স্পয়েল ফেলার জায়গার বিষয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক নিচু এলাকা ভরাট হয়ে গেছে।

তবে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলে ড্রেজিংয়ের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন আনা গেলে স্পয়েল ফেলার সুবিধা হবে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নৌ-পরিবহনের মাধ্যমে মালামালের সুষ্ঠু, নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন ওঠানামা নিশ্চিতকরণ ও পরিবহন খাতে নৌ-পরিবহনের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্যে ‘নওয়াপাড়া নদীবন্দর এলাকায় টার্মিনালসহ বন্দর সুবিধাদি নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় করা হয়েছে।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা বাস্তবায়ন করবে বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২৪। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের অধীনে নিরাপদ নৌ-বার্থিংয়ের জন্য প্রায় দুই লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং, ১৮ দশমিক পাঁচ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও দশমিক আট লাখ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন, ৯ হাজার ৬০০ বর্গমিটার আরসিসি কি ওয়াল, ২২ হাজার বর্গমিটার পার্কিং ইয়ার্ড, ১২ হাজার বর্গমিটার স্লোপ প্রটেকশন নির্মাণ, ৫৪০ বর্গমিটার বন্দর ভবন, প্রায় সাত হাজার ১৬৮ বর্গমিটার মালামাল মজুত এলাকা এবং শ্রমিক বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হবে। এর ফলে নওয়াপাড়া পূর্ণাঙ্গ নৌবন্দর হিসেবে যাত্রা শুরু করতে পারবে।
নওয়াপাড়া নদীবন্দর এলাকায় টার্মিনালসহ বন্দর সুবিধাদি নির্মাণ প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন উর রশীদ বলেন, ‘সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাস হয়েছে। এটি একনেকে ছাড় পেলেই নওয়াপাড়া নৌবন্দর এলাকায় টার্মিনালসহ বন্দর সুবিধাদি; বিশেষ করে নদের ড্রেজিং ব্যবস্থা দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অভয়নগর উপজেলার তালতলার নওয়াপাড়ায় নদীবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৭ সালের মে মাসে। বিআইডব্লিউটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, উপজেলায় ভৈরব নদের তীরে অবৈধ স্থাপনা ছিল ৮৬টি। ২০১৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও বিআইডব্লিউটিএ’র সহযোগিতায় দুই ধাপে ৫৯টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। বাকি ২৭টি স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছিল।

ভাটপাড়া থেকে মহাকাল শ্মশানঘাট পর্যন্ত নদের দুই পাড়ে ছয় কিলোমিটার করে ১২ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে ওসব অবৈধ স্থাপনা। ২৭টি স্থাপনার মধ্যে আঞ্চলিক কর কমিশনারের ভাড়া করা কার্যালয়, নওয়াপাড়া হাইওয়ে থানার সীমানাপ্রাচীর এবং কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর গুদাম রয়েছে।

ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জর্দান, কানাডা, সৌদিআরব, মরক্কো, অস্ট্রেলিয়া থেকে বড় জাহাজে আমদানি করা সার, বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যশস্য ও কয়লা চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দরে আসে। সেখান থেকে ছোট জাহাজে তা নওয়াপাড়ায় আনা হয়। ভারত থেকে স্থলপথে আমদানি পণ্য ট্রেনে ও ট্রাকে বেনাপোল এবং ট্রেনে দর্শনা স্থলবন্দর হয়ে নওয়াপাড়ায় আনা হয়।
প্রতিদিন ৪০০-৫০০ পণ্যবোঝাই জাহাজ নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদে অবস্থান করে। সেখান থেকে নামানোর পর এসব পণ্য প্রতিদিন স্থলপথে এক হাজারের বেশি ট্রাকে এবং নদীপথে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে দেশের উত্তর, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নেওয়া হয়।

আর্থিক লেনদেনের জন্য এখানে আছে ১৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের শাখা। আছে অর্ধশতাধিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন লেনদেন হয় কয়েকশ কোটি টাকা। নওয়াপাড়ার এই ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল প্রায় তিন লাখ মানুষ।

৯০’র দশকে বিদেশ থেকে আমদানি করা সারের ৬৫-৭০ শতাংশ নওয়াপাড়া থেকে বিপণন হতো। এখনো ৩৫-৪০ শতাংশ সার নওয়াপাড়া থেকে বিপণন হয়। ধীরে ধীরে সারের সঙ্গে খাদ্যশস্য, সিমেন্ট, রড, পাথর এবং সর্বশেষ কয়লার ব্যবসা যুক্ত হয়েছে। ব্যবসা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে নওয়াপাড়ায় তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
করোনাকালে শ্রমিকের পরিবর্তে যান্ত্রিকভাবে বার্জ, কার্গো ও কোস্টার থেকে পণ্য খালাস করতে নদের মধ্যে ২২টি জেটি নির্মাণ করা হয়। মাটি ভরাট করে তৈরি এসব জেটিও পরে আর অপসারণ করা হয়নি।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ