1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

কৃষি খাত এখনও অর্থনীতির চাবিকাঠি

ডেস্ক রিপোর্ট : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

গেল দশকগুলোয় ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের গ্রামীণ রূপান্তরের গল্প প্রায় রূপকথার মতোই শোনায়। সাবসিস্টেন্স থেকে কমার্শিয়াল কৃষি, ৯০ ভাগ খানায় মোবাইল ফোন, স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, স্কুলের অন্তর্ভুক্তির হার, শিশুমৃত্যুর হার ইত্যাদির দিক থেকে। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোকে এসব সামাজিক ক্ষেত্রে পেছনে ফেলে সামনে আগুয়ান। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন খাদ্য বৃদ্ধির কল্যাণে উদর পূর্তি এবং দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস।

প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল লিপটন কয়েক বছর আগে ঢাকায় এসে বলেছিলেন, বাংলাদেশের গ্রাম রূপান্তরের কারিগর তিন ‘ফ’–ফারটিলিটি, ফার্ম ম্যানেজমেন্ট ও ফুড। ফুড বলতে তিনি বুঝিয়েছেন আধুনিক প্রযুক্তিতাড়িত খাদ্যের জোগানের কথা। এটা আজ সুবিদিত যে, দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে। স্বীকৃত এ সাফল্যের চিত্র ফুটে ওঠে বিবিএস কর্তৃক ২০২৩ সালে প্রকাশিত ২০২২ সালের খানার আয়ব্যয় জরিপের তথ্য থেকে। ওখানে দেখানো হয়, মাথা গণনাসূচক সহনীয় দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য কমেছে–২০১৬ সালের ২৪ ভাগ থেকে ২০২২ সালে প্রায় ১৯ শতাংশ; একই সময়ে মাথা গণনাসূচক চরম দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ (প্রায় ১৩ থেকে প্রায় ৬ শতাংশ)। এ সাফল্যের চালক গেল দশকের প্রাপ্ত গড়পড়তা জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেমন ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ৭ শতাংশ। এমনকি করোনাকালেও ৩ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি প্রদর্শন করে দেশটি হাতেগোনা কটি অর্থনীতির কাতারে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খাদ্য গবেষণা সংস্থা ইফ্রির আখতার ইউ আহমেদ দারিদ্র্য হ্রাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিশেষ করে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়ন করতে গিয়ে দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির স্তিতিস্থাপকতাÑইলাস্টিসিটি অব গ্রোথ অন পোভার্টি রিডাকশন পর্যালোচনা করেছেন । অর্থাৎ গড় জাতীয় আয় যদি ১ শতাংশ বাড়ে তাহলে দারিদ্র্যের হার কী পরিমাণ কমে তিনি তা দেখার প্রয়াস নিয়েছেন। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশে সহগটির মান গড়পড়তা মাইনাস ২ অর্থাৎ গড়পড়তা প্রকৃত মাথাপিছু আয় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে দারিদ্র্যের হার কমবে ২০ শতাংশ। তাহলে পাঠক বুঝে নিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য হ্রাসে কেন এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়, তোরা যে যা বলিস ভাই, প্রবৃদ্ধি আমার চাই। বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটা দেশে। তবে বাংলাদেশে সহনীয় দারিদ্র্যের প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা সত্যি খুব কম এবং তা-ও ২০০৫ সাল থেকে নিম্নগামী। তিনি হিসাব কষে বের করেছেন যে, ২০১৬-২০২২ সময়ে সহগটির মান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক আট শূন্য। এর অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১০ শতাংশ বাড়লে সহনীয় দারিদ্র্য কমে মাত্র আট শতাংশ (উন্নয়নশীল দেশের গড় ২০ শতাংশ)। এর বিপরীতে ২০১০-২০১৬ সময়ে সহগটি ছিল শূন্য দশমিক আট চার এবং ২০০৫-২০১০ সময়ে শূন্য দশমিক নয় ছয়। মোট কথা, হলো- বাংলাদেশে সহনীয় দারিদ্র্য হ্রাসে প্রবৃদ্ধির পারঙ্গমতা বেশ কম এবং সেটা ১৭ বছর ধরে ক্রমাগত নিম্নমুখী, এটাই প্রমাণ করে।

এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষি খাতের ভূমিকা কী? ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য কমাতে কৃষি খাত একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কৃষি থেকে জিডিপির যে হিসসাটা আসে, তা সমাজের সবচেয়ে শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ আয়ের সূত্রপাত ঘটায়। তা ছাড়া, শুধু সরাসরি দারিদ্র্য হ্রাস নয়, পুরো অর্থনীতিতে শক্তিশালী লিংকেজ প্রভাব নিয়ে হাজির হয় কৃষি খাত। কৃষির পরোক্ষ অবদান আসে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে। যেমন সার, সেচযন্ত্র, কীটনাশক এবং অন্যান্য উপকরণের চাহিদাসমেত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও প্যাকেজিং, পরিবহন, শিল্পজাত প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং কৃষিপণ্যের বাজারসমেত ফরওয়ার্ড লিংকেজ গড়ার মাধ্যমে। এ কর্মকাণ্ডগুলো ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটায় খামারবহির্ভূত খাতে যার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় বর্ধিত কর্মসংস্থান ও আয়। যাই হোক, দেশ যতই সম্পদশালী হবে দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধির ধার, খামারবহির্ভূত খাতের তুলনায়; ততই কমবে বলে ধারণা করা হয়।

প্রসঙ্গত এও বলে রাখা দরকার, ২০২২ সালেও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগ জীবিকার জন্য মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং জিডিপিতে মাত্র ১২ ভাগ অবদান নিয়ে শ্রমশক্তির ৪৫ ভাগ নিয়োজিত কৃষি খাতে। সুতরাং কৃষি খাতকে কোনোভাবেই অবহেলা করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। যেমন একটা উদাহরণই যথেষ্ট। বিবিএসের তথ্য ব্যবহার করে গবেষক বের করলেন, দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতার মান ২ দশমিক ২৬ অর্থাৎ ২০১৬-২০২২ সময়ে মাথাপিছু প্রকৃত কৃষি জিডিপি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাস ঘটায়। অথচ এর বিপরীতে অকৃষি প্রবৃদ্ধি স্থিতিস্থাপকতা হচ্ছে শূন্য দশমিক ৭২, যার অর্থ অকৃষি কর্মকাণ্ডে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে দারিদ্র্য হ্রাস পায় মাত্র ৭ শতাংশের কোঠায়। মনে হয় এমনতর পরিসংখ্যান এটা প্রমাণ করতে চায় যে, অন্তত দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি অকৃষি খাতের তুলনায় তিন গুণের বেশি শক্তিশালী। অর্থাৎ বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসে একই হারে প্রবৃদ্ধি অকৃষির চেয়ে কৃষিতে বেশি কার্যকর।

তাহলে কৃষিকে আরও গতিশীল, বেগবান করা যায় কীভাবে, যাতে দারিদ্র্য হ্রাস দ্রুততর করা যায়? আখতার ইউ আহমেদ বেশ কটা বিষয় সামনে এনেছেন, যা নীতিনির্ধারকদের জন্য নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়নে চিন্তার খোরাক হতে পারে। ভবিষ্যতে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন এমন প্রযুক্তির প্রসার করা যা উৎপাদন বাড়ায় এবং উঁচু মূল্যের ফসল, মাছ ও গবাদি পশুসহ ফসলবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে মনোযোগ আকর্ষণ করে। কৃষি খাতের দারিদ্র্য নিরসন ক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে প্রযুক্তিতে ব্যক্তি ও সরকারি খাতের নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ক্রমহ্রাসমান চাষের জমি, ক্ষয়িষ্ণু উর্বরতা, পোকার আক্রমণে বিশেষ ফসলের ঝুঁকি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবÑপ্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা মাথায় রেখে উৎপাদন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সময়ের দাবি। উপরন্তু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ও খামারের মধ্যকার উৎপাদন তারতম্য কমিয়ে আনা জরুরি। খুব গুরুত্বসহকারে গবেষক ভেবেছেন কৃষিতে অর্থায়নের কথা। বিশেষত ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য ঋণের বাজারে খুব সীমিত প্রবেশগম্যতা তাদের প্রযুক্তি প্রসারণ, জীবিকা বহুমুখীকরণ এবং পণ্য বাজারজাতকরণের পথে বড় বাধা। তা ছাড়া সময়মতো এবং ব্যয়সাশ্রয়ী উপকরণলভ্যতা তাদের লাভের মুখ দেখায়।

মোট কথা কৃষি খাতের উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির ভূমিকা বলিষ্ঠ করতে হলে একটা সমন্বিত পরিকল্পনার ছাতার নিচে থাকতে হবে প্রযুক্তির প্রসারণ, উঁচু মূল্যের ফসল উৎপাদনে স্থানান্তর, চলমান পুঁজির লভ্যতা; যা কৃষিকে দেবে দারিদ্র্য হ্রাস করার অধিকতর শক্তি। দেশের কৃষির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আধুনিকায়ন, উঁচু মূল্যের পণ্য উৎপাদন এবং ফসল বহুমুখীকরণের ওপর। বহু আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পুত্রকে লিখেছিলেনÑ‘অনুগ্রহ করে ওদেরকে বলো বসতভিটা ও ক্ষেতের সীমানায় যেখানে সম্ভব আনারস, কলা, খেজুর এবং অন্যান্য ফলের গাছ লাগাতে। আনারসের পাতা থেকে খুব ভাল এবং শক্ত আঁশ বের করা যায়। এই ফলটা আবার খুব সহজেই বাজারজাত করা যায়। ঝোপঝাড়ের বেড়া হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং শেকড় থেকে কীভাবে খাদ্য উৎপাদন বের করা যায় সে সম্পর্কে কৃষকদের জ্ঞান দেয়া দরকার। যদি তাদেরকে গোল আলু চাষে উদ্বুদ্ধ করা যায় সেটা হবে খুব লাভজনক। অফিসরুমে আমেরিকান ভুট্টা আছে, দ্যাখো এগুলো বোনা যায় কিনা।’

বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার কথা না বললেই নয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সত্তরের দশকের প্রায় ৩ শতাংশের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এলেও এখনও বছরে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশের মানবমহাসমুদ্রে। এ বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৩ লাখ টন চাল উৎপাদন বাড়াতে হবে। অন্যদিকে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে বার্ষিক ১ শতাংশ হারে। তবে সুখবর এই যে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সাপেক্ষে মাথাপিছু চালের ভোগের পরিমাণ কমছে বলে বাঁচোয়া। জলবায়ু পরিবর্তন চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে কৃষিতে যা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। সমস্যা দাঁড়িয়েছে খাবার ও খাবারবহির্ভূত পণ্য বাজারজাতকরণে করপোরেট সেক্টরের প্রবল প্রভাবে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের উদ্বৃত্ত হ্রাস করছে। এ ধরনের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান জরুরি। খাবার এবং বিশেষত চালবহির্ভূত পণ্য উৎপাদনে গবেষণাগত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ অত্যন্ত জরুরি। কারণ অদূর ভবিষ্যতে উন্নয়নের গতিধারা সাপেক্ষে কৃষি খাতে ধানের চেয়ে অন্যান্য ফসল ও গবাদি পশু এবং মাছ চাষের ভূমিকা বৃদ্ধি পাবে।

আমরা যেন ভুলে না যাই, এখনও কৃষি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ। কৃষিকে অবজ্ঞা করে তথাকথিত শিল্পায়ন বা উন্নয়ন অভিযাত্রা হোঁচট খেতে পারে। মাঝেমধ্যে ভয় জাগে কারণ- ‘অদ্ভুত আঁধার এক/ এসেছে পৃথিবীতে আজ/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী/ আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো/ প্রেম নেই–প্রীতি নেই/পৃথিবী অচল আজ/তাদের সুপরামর্শ ছাড়া’ (জীবনান্দ দাশ)।

লেখক: আব্দুল বায়েস – অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ