1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

টেকসই উন্নয়নের একটি মাইলফলক সর্বজনীন পেনশন স্কিম

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২ মার্চ, ২০২২
ড. আতিউর রহমান

বাংলাদেশ বিশেষত ১২-১৩ বছর ধরে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের একটি উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে মাথাপিছু আয় নাটকীয় গতিতে বেড়ে দুই হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি হয়েছে এবং করোনাজনিত অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে প্রায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা গেছে; অন্যদিকে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে গড় আয়ু বৃদ্ধি ও ক্ষুধাসূচকের মতো সামাজিক-মানবিক উন্নয়নের সূচকগুলোতেও। নিঃসন্দেহে অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রান্তজনের কর্মসংস্থানে চাপ পড়েছে। তা সত্ত্বেও এ সংকট থেকে উত্তরণে তাদের প্রচেষ্টার শেষ নেই।

এমন প্রেক্ষাপটে সর্বজনীন পেনশন স্কিম আগামী ছয় থেকে ১২ মাসের মধ্যে শুরু করার যে ঘোষণা সরকারের তরফ থেকে এসেছে, সেটিকে সময়োচিত প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবেই দেখতে হবে। বলা চলে, এটি একটি সাহসী উদ্যোগও বটে।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও এটা তো মানতেই হবে যে সরকারের উদ্যোগ এবং অসরকারি খাতের উদ্ভাবনী সহায়ক ভূমিকার কারণে এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন নিতান্ত কম নয়। সরকারের ধারাবাহিক গণমুখিনতার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ একই সঙ্গে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে এবং স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হতে পেরেছে। তার সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও প্রশংসনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কাজেই এখন প্রথাগত ‘টার্গেটেড’ সামাজিক নিরাপত্তার চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে সর্বজনীন কর্মসূচি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এখন আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যখন সামাজিক নিরাপত্তার সর্বজনীনতা নিয়ে ভাবা ও উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসে গেছে বলা চলে।

সরকারের দিক থেকে যে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের কথা বলা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এই কর্মসূচিতে ধর্ম-বর্ণ-পেশা-আয়শ্রেণি-নির্বিশেষে সবাইকেই যুক্ত করার পথনকশা দাঁড় করানো হচ্ছে। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার এই লক্ষ্য যেমন মহৎ ও কাম্য, তেমনি এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর তা বাস্তবায়নে কিছু সতর্কতারও দরকার রয়েছে। এমন কিছু বিষয়ই এখানে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরছি।

প্রথমেই নজর দিই এই নতুন কর্মসূচির উপকারভোগীদের নিবন্ধন করার বিষয়টির ওপর। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিককেই এই কর্মসূচিতে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। অন্তত ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পর ৬০ বছরে গিয়ে হিসাবধারী মাসে মাসে পেনশন তুলতে পারবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম দিকে নাগরিকরা কিছুটা সন্দিহান অথবা অনাগ্রহী থাকবে। তাই তাদের ধীরে ধীরে আগ্রহী করে তুলতে হবে। আশার কথা—সরকার সে পথেই হাঁটতে চাইছে। বলা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে নিবন্ধিত হওয়াটি ঐচ্ছিক থাকবে এবং পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলক করা হবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, উপকারভোগীদের কী করে যুক্ত করা হবে। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে হয়তো আগ্রহ কম দেখাতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সরকারের তরফ থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা রকম আর্থিক ও করসংক্রান্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে। কাজেই সরকারের এ উদ্যোগে তাদের যুক্ত হওয়াটাই কাম্য। তার পরও আমার মনে হয় চাপিয়ে দেওয়া বা সাংঘর্ষিক পথের পরিবর্তে তাদের যথাযথভাবে প্রণোদিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমরা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে গ্রামাঞ্চলে শাখা খোলা এবং কৃষি অর্থায়নে আগ্রহী করতে বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে ভালো ফল পেয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখানেও এগোনো যেতে পারে।

আরো যে বিষয়টির দিকে লক্ষ করা বিশেষভাবে দরকার, তা হলো আমাদের অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক চরিত্র। আমাদের শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশেরও বেশি যুক্ত রয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। পেনশন স্কিমের সর্বজনীনতা নিশ্চিত করতে এদের অবশ্যই যুক্ত করতে হবে। তাই কোথায় কাজ করছেন তার ভিত্তিতে চিহ্নিত না করে বরং ব্যক্তি নাগরিক হিসেবেই এদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত কর্মজীবীদের যে সমিতিগুলো আছে সেগুলোর মাধ্যমেও এ খাতে যুক্ত নাগরিকদের স্কিমের আওতায় আনার কথা ভাবা যায়। সমবায় সমিতিগুলোও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। সারা দেশে অসংখ্য অসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারাও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

আমাদের আলাদা করে মনোযোগ দিতে হবে আস্থার জায়গা তৈরির দিকে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশনের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে যে নানা রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখোমুখি হন, সেই অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণের মনে পেনশন নিয়ে এক ধরনের অনাগ্রহ কাজ করা খুব অস্বাভাবিক নয়। তাই এ নতুন সর্বজনীন স্কিমটি নিয়ে এমন কোনো বাজে অভিজ্ঞতা যেন কারো না হয়, সে বিষয়ে বিশেষ নজর রাখা চাই। শুরু থেকেই একটি ডিজিটাল ড্যাশবোর্ডভিত্তিক মনিটরিং ব্যবস্থা দাঁড় করানো যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে তো এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ঐচ্ছিক থাকবে। সে অবস্থায়ই ড্যাশবোর্ডভিত্তিক মনিটরিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে একটি টেকসই নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা দাঁড় করানো সম্ভব। নাগরিকরা নিজেরা স্বেচ্ছায় নিজেদের পেনশন হিসাব খুলবেন। এই হিসাবেই তাঁরা টাকা সঞ্চয় করবেন, সম্ভবত তাঁরা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, সেখান থেকেও একটি ভাগ আসবে এবং সর্বোপরি সরকারও সমান পরিমাণ টাকা সেখানে জমা করবে। এই সব টাকা বিনিয়োগ করে তার লাভের ভাগ দেওয়া হবে নাগরিকদের। কাজেই এই বিনিয়োগের সুফল পাওয়া নিয়েও একটি আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। কোথায় বিনিয়োগ করা হবে সে বিষয়টি যতটা সম্ভব সতর্কভাবে বাছাই করতে হবে। এই তহবিল নিয়ে অধিক লাভের আশায় বড় ঝুঁকি নেওয়ার কথা ভাবাই যাবে না।

এই কর্মসূচির আওতায় সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রক্রিয়াগুলো খুব সহজ করার দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। পেনশন স্কিমের টাকা জমা দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে সেই টাকা তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা থাকতে হবে। প্রয়োজনে আলাদা ‘অ্যাপ’ তৈরি করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, এক হাজার টাকা জমা দিতে গিয়ে কাউকে যেন ২০০ টাকা খরচ করতে না হয়। আরো লক্ষ রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে ‘ওয়ান সাইজ ফিটস অল’ ব্যবস্থা তথা সবার জন্য একই রকম সেবা নিয়ে এগোনোর পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে না। সর্বজনীনতার কারণে এই স্কিমের টার্গেট গ্রুপ হবে খুবই বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংগতি রেখেই একটি জাতীয় স্কিমের আওতায় বিভিন্ন রকম প্যাকেজ থাকা চাই। মোট তহবিলের অন্তত ৫০ শতাংশ ঋণ দেওয়ার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা যথার্থ। পাশাপাশি কোনো কোনো বীমা কর্মসূচিতে একটি-দুটি কিস্তি জমা না দিতে পারলে পুরো কর্মসূচি বাতিল করে দেওয়া হয়। এখানে তা হবে না বলেই মনে হয়। কেননা চাঁদার খেলাপি কিস্তি জরিমানাসহ পরবর্তী সময়ে শোধ করার প্রস্তাব করা হবে এই কর্মসূচিতে।

এই কর্মসূচি নিয়ে সব পক্ষের মতামত ও সবার মধ্যে সংলাপ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণাও চালাতে হবে। সরকারের দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই এমন উদ্যোগ থাকবে। কিন্তু নাগরিকসমাজ ও বিশেষজ্ঞ মহলকেও এ জন্য এখনই এগিয়ে আসতে হবে। সম্ভাব্য উপকারভোগীদের সচেতন করার এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজেরই এগিয়ে এসে উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে হয়।

সরকার এই পুরো বিষয়টি তদারকি করার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করতে যাচ্ছে। সেটিই প্রত্যাশিত। সব বিষয় সতর্কভাবে বিবেচনায় নিয়ে, সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতেই এই কর্তৃপক্ষকে এগোতে হবে। তাড়াহুড়া যেমন করা যাবে না, তেমনি আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার জালেও এই কর্মসূচিকে আটকানো যাবে না। তাই পরিকল্পনার পাশাপাশি জন-অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের উপযুক্ত পথনকশা আঁকার বিষয়টিও যেন সমান গুরুত্ব পায়।

লেখক : ড. আতিউর রহমান – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর । 


সর্বশেষ - জাতীয় সংবাদ